লিউরা কাসকেড
ছোটবেলায় স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে কত তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পাল্টে, ভাত খেয়ে, মাঠে পৌঁছে যাওয়া যায় তার জন্য থাকত অধীর অপেক্ষা। তার পর দারিয়াবান্ধা, লুকোচুরি, সাতচাড়া, লাল লাঠি— পাড়ার নানা বয়সের ছেলেমেয়েরা মিলে কত খেলা। তখন তো টিভি-কম্পিউটার-মোবাইল-এর যুগ নয়, তাই বিকেলে মাঠে খেলতে গিয়ে জ্ঞান ফলানোটাও ছিল আর এক খেলা। যাদের আত্মীয় বিদেশে থাকে তারা তো তখন সুপার হিরো। আর বাকিরা চোখ গোলগোল করে শুনত তাদের নানা রকম গল্প। এমনি করেই এক দিন জেনেছিলাম ব্লু মাউন্টেন-এর কথা। পরে আরও ভাল করে জেনেছিলাম জন্মদিনে উপহার পাওয়া ‘ওয়ার্ল্ড ন্যাচারাল ওয়ান্ডার্স’ বই পড়ে।
স্বপ্ন দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, আহা আমি যদি কখনও যেতে পারতাম! মনের মণিকোঠায় সযত্নে রেখেছিলাম তাকে। আজ বুঝি সে স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে! সিডনি বিমানবন্দরের মাটি কখন যেন ছুঁয়ে ফেললাম। বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছলাম সিডনির হোটেল সিবিডি-তে। এমনিতে এখানকার পরিবহণ ব্যবস্থা বেশ ভাল এবং সস্তা। কিন্তু বিমানবন্দরের এক কর্মী পরামর্শ দিলেন, “প্রথম বার তো, পরিবার এবং মালপত্র নিয়ে ট্যাক্সি করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।” ট্যাক্সি করেই পৌঁছলাম হোটেলে।
কাটুমবা এক্সপ্রেস
পর দিন খুব সকালে সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে টিকিট কেটে উঠলাম ইন্টারসিটি লিঙ্কড ট্রেনে। ঠিক সময়েই ট্রেন ছাড়ল। মনে দারুণ উত্তেজনা! চলেছি অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস-এ ব্লু মাউন্টেনস-এর উদ্দেশে। এক এর পর এক স্টেশন পার হয়ে দু’ঘণ্টা পরে এল কাটুমবা— পাহাড়ি স্টেশন। ট্রেন থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেই কাটুমবা শহর। সেখানেই রয়েছে নানান ট্যুর অপারেটরদের কাউন্টার, হোটেল ও খাবারের দোকান।
দেখেশুনে সিডনি এক্সপ্লোরার-এর কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে উঠে বসলাম বাসে। সঙ্গে রয়েছে ওদেরই দেওয়া রুট ম্যাপ ও প্ল্যানার। প্রথমেই ঠিক করে নিলাম, কোথায় কোথায় নামব আর কী কী দেখব। এগুলি সবই হল ‘হপ অন হপ অফ’ বাস। সারা দিন ধরেই বাস চলছে। নিজের ইচ্ছে মতো দর্শনীয় স্থানে নেমে, ঘুরে, দেখে আবার একই রকম বাস ধরে অন্য গন্তব্যে যাওয়া যায়। কোম্পানি অনুযায়ী ১০ থেকে ৩০ মিনিটের ব্যবধানে পাওয়া যায় বাস।
‘হপ অন হপ অফ’ বাস।
পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল দুপুর থেকে বৃষ্টি হবে। কাউন্টারে তাই জানতে চেয়েছিলাম, কোন জায়গা থেকে শুরু করলে ভাল হয়? ওঁদের পরামর্শ মতো সোজা গিয়ে নামলাম সিনিক ওয়ার্ল্ড-এ। এখানে বিভিন্ন রাইড রয়েছে। প্রথমেই উঠলাম সিনিক ‘কেবল ওয়ে’তে— ক্লিফের মাথা থেকে উপত্যকা পার হয়ে চলা। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়। নীচের দিকে তাকিয়ে বুক ধুকপুক করতে লাগল। আর উত্তেজনা? সে তো আছেই। একই জায়গায় দেখা যাবে পাহাড়, নদী, ঝরনা, মালভূমি ও উপত্যকা। পাহাড়-পর্বতের কথা বলতেই প্রথমেই মনে আসে সবুজে ঘেরা পাহাড়, না হয় শ্বেতশুভ্র বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা বা মাউন্ট এভারেস্টের কথা। কিন্তু নীল রঙের পাহাড়! চার পাশ দেখার ফাঁকে অস্ট্রেলীয় ধারাভাষ্যকারদের ভাষ্য শুনতে শুনতে এক সময় পৌঁছে গেলাম ‘মেরিস লুক আউট’। এই ভিউ পয়েন্টে আছে রেস্তোরাঁ, ক্যাফে, স্যুভেনিয়র শপ ইত্যাদি। নীল পর্বতের মাঝে, খোলা আকাশের নীচে বসে আমরা ‘ব্রাঞ্চ’ সেরে নিলাম। চার দিকে অসাধারণ নীলাভ সৌন্দর্য।
সিনিক ওয়ার্ল্ডে।
সিনিক ট্রেন
মেরিস লুক আউট থেকে চললাম সিনিক রেল স্টেশনের দিকে। এটা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দুর্গমতম রেলওয়ে (৫২ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল ও ১৭৮ মিটার ভার্টিক্যাল ডিসেন্ট)। বালি পাথরে তৈরি প্রাকৃতিক ক্লিফের মাথা থেকে তীব্র গতিতে (৪ মিটার প্রতি সেকেন্ড) ট্রেন নেমে আসে হু হু করে, খাড়াই পথে পাহাড়ি অন্ধকার টানেলের মধ্য দিয়ে ভ্যালির কাছাকাছি। প্রতি ১০ মিনিট অন্তর আসা-যাওয়া করে এই ট্রেন।
ঘুরে উপরে উঠে কাটুমবা পাহাড় দেখার পালা এ বার। এই পাহাড়েই আছে কাটুমবা কয়লা খনি। খনির শ্রমিকরা ওখান থেকে প্রায় একশো বছর আগে কী অমানসিক পরিশ্রম করে কয়লা তুলে আনতেন, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ বোর্ডে দেওয়া আছে। পড়লে বিস্ময় জাগে! শ্রমিকরা তখন কয়লা, তেল ইত্যাদি নামানোর জন্য ব্যবহার করতেন এক ধরনের ট্রাম। তাঁদের ব্যবহৃত এই ট্রামের রূপান্তরই হল সিনিক ট্রেন। এ সব কিছুই রাখা আছে রেপ্লিকা করে। কাটুমবা পাহাড়ের মাথায় অতিব সুন্দর কাটুমবা জলপ্রপাত। অন্য দিকে আছে দুর্গ। হাতে সময় কম, তাই দুর্গে যাওয়া হল না।
‘স্কাই ওয়ে’
আমরা গেলাম সিনিক ‘ওয়াক ওয়ে’তে। পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। পথ নির্দেশ আছে। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে হেঁটে উপত্যকায় পৌঁছলাম। ওখানে আছে খনি শ্রমিকদের ঘরবাড়ি। বিভিন্ন রকমের পাখি, পাহাড়ি সাপের পাশ কাটিয়ে ফিরে এলাম সিনিক ‘স্কাই ওয়ে’র বেস স্টেশনে। অ্যাডভেঞ্চার একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। তাই স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে উঠতে গিয়ে ঘাম ছুটে গেল। শীতের জামাকাপড় তখন মনে হচ্ছে বোঝা। ‘স্কাই ওয়ে’র তলাটা কাচ দিয়ে তৈরি হওয়ায় নীচের দিক-সহ চার দিকের ৩৬০ ডিগ্রির ভিউ পাওয়া যায়। ‘স্কাই ওয়ে রাইড’-এ উঠে ফিরে এলাম আবারও সিনিক ওয়ার্ল্ডে। তবে এটা অন্য পাশ। দুয়ারে প্রস্তুত বাস। উঠে পড়লাম।
নামলাম লিউরা কাসকেড স্টপেজে। অপূর্ব এই কাসকেডে পৌঁছে ক্লান্তি গেল কেটে। মনোরম এই জলের ধারা ধাপে ধাপে ক্রমাগত কেমন নেমে আসছে জীবন্ত হয়ে আর বয়ে যাচ্ছে শান্ত নদীটি হয়ে। তত ক্ষণে আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম। আবারও বাস ধরার পালা। এ বার যাব ‘থ্রি সিস্টার্স’— ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট-এর একটিতে। কিন্তু নামতে পারলাম না। বেশ জোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাসেই চক্কর দিতে থাকলাম। এক সময় ছটফট করতে করতে নেমে পড়লাম ব্লু মাউন্টেন চকোলেট কোম্পানিতে। হাতে তৈরি নানা ধরনের চকোলেট দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। খেলাম ঝাল চকোলেট। দাম খুব। আমাদের ওখানে লোকাল ট্রেনে বিক্রি হওয়া গোল মরিচ, যষ্টি মধু, কাবাব চিনি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি ঝাল লজেন্সের কথা মনে পড়ে গেল।
‘থ্রি সিস্টার্স’
বৃষ্টিটা বেশ কমে এসেছে। ছাতা মাথায় দিয়ে ‘হপ অন হপ অফ’ বাসে করে গেলাম ‘থ্রি সিস্টার্স’ ছুঁয়ে দেখতে। বাস থেকে নামতেই আবার জোরে বৃষ্টি এল। কোনও ক্রমে বুড়ি ছুঁয়ে আসা গেল ভিজতে ভিজতে। আদিগন্ত নীলের মাঝে ‘থ্রি সিস্টার্স’ যেন পাহাড় কেটে তৈরি কোনও ভাস্কর্য। এ নিয়ে নানা লোককথাও আছে। সত্যিই চমৎকার। চারিদিকে হালকা নীলের আভা। মনে হল হালকা, রেশমি নীল পর্দা দিয়ে কেউ যেন ঢেকে রেখেছে পাহাড়গুলিকে। আসলে এখানে প্রচুর ইউক্যালিপটাস গাছ রয়েছে। আর তা থেকেই ক্রমাগত বেরোয় ইউক্যালিপটাস তেল। সেই তেল বাষ্পাকারে ছড়িয়ে এই নীলাভ মায়াবি আবরণ তৈরি করে।
ব্লু মাউন্টেনের সৌন্দর্যে ডুবে গেলাম। আধ ভেজা জামাকাপড় আর পাহাড়ি হাওয়ার কারণে খুব ঠান্ডা লাগছে। এক সময় ঘড়ির দিকে চোখ গেল। শেষ বাসের সময় হয়ে এসেছে। তাই এ বারের মতো তিন বোনকে টাটা করে ফিরে এলাম বাস ধরতে।
উত্তর ২৪ পরগনার মেয়ে পেশায় চিকিৎসক। প্রথম প্রেম বাংলা কবিতা। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মঞ্চে আবৃত্তির অনুষ্ঠান করেছেন। ১৯৯৪ সালে মার্কিন মুলুকে পাড়ি। তার পর বছর দশেক ধরে নানা দেশ ঘুরে ২০০৪ সাল থেকে মালয়েশিয়ার বাসিন্দা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy