জনসাধারণের জন্য সহজ ভাবে বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করেছিলেন স্টিফেন হকিং। ছবি:এএফপি।
স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে আলাপ ১৯৮৪ সালে। আমি তখন কেমব্রিজে গবেষণা করছি। উনি অধ্যাপক। বিজ্ঞানের ঈশ্বরকে তো কাছ থেকে পেয়েইছি। ব্যক্তি হকিংকেও জানার সৌভাগ্য হয়েছে।
কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল নিয়ে মানুষের চিন্তা, গবেষণা বহু দিনের। বিজ্ঞানীদের দেওয়া ব্যাখ্যা এবং জটিল গাণিতিক সমীকরণ সাধারণ মানুষের বিচারবুদ্ধির অনেক বাইরে। মহাবিশ্ব কী? তার উৎপত্তিই বা হল কী ভাবে? এই প্রশ্ন মনে এলেও সেটা বোঝার ক্ষমতা বিজ্ঞানীরা ছাড়া আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের নেই। জটিল বিজ্ঞান আর সাধারণ মানুষের মধ্যে সেই যোগসূত্রটাই রচনা করেছিলেন এই প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী।
সালটা ১৯৮৪। জোরকদমে চলছে আমার গবেষণা। ব্ল্যাক হোল নিয়ে হকিংয়ের তত্ত্ব তখন বিজ্ঞানী মহলে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। প্রথম জনসাধারণের জন্য দরজা খুলে দিলেন হকিং। মহাবিশ্বের তত্ত্ব নিয়ে একটি আলোচনাসভার আয়োজন করলেন যার নাম ‘শর্ট হিস্ট্রি অব টাইম।’ সেই অভিজ্ঞতা ভাষায় বর্ণনা করার ক্ষমতা নেই। সেই প্রথম মানুষ জানল আপেক্ষিকতাবাদ কী, ব্ল্যাক হোল নিয়ে গবেষকদের চিন্তা ভাবনার গতি কোন দিকে। শ’য়ে শ’য়ে লোক যোগ দিল এই আলোচনাসভায়। এই বক্তৃতার বিপুল জনপ্রিয়তার পরেই, বিজ্ঞানীদের অনুরোধে ১৯৮৮ সালে কসমোলজি নিয়ে ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ লিখলেন হকিং। বিগ ব্যাং থিওরি থেকে ব্ল্যাক হোল— মহাবিশ্বের নানা তত্ত্ব নিয়ে এই বই সাদরে গ্রহণ করল বিজ্ঞানীমহল।
স্টিফেন হকিং এমন একজন মানুষ যিনি প্রথম দেখালেন কী ভাবে সহজ করে বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করা যায়। জনসাধারণের উপর তাঁর প্রভাব ছিল সাঙ্ঘাতিক। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাঁকে দমাতে পারেনি। সালটা মনে হয় ১৯৮৫-৮৬। জটিল স্নায়ুর রোগ তখন তাঁর শরীরকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে। একসময় গলার আওয়াজও চলে যায় তাঁর। আমার এখনও মনে আছে, কী অসীম দক্ষতায় কৃত্রিম ভোকাল বক্সের মাধ্যমে বক্তৃতা দিতেন তিনি। একটা একটা করে অক্ষর টাইপ করে আলোচনাসভায় সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। মুখে কখনও বিরক্তির লেশমাত্র দেখা যায়নি। মেধার সঙ্গে আত্মবিশ্বাসের এক আশ্চর্য মিশেল ছিলেন হকিং।
আরও পড়ুন: শিশুর মতো সহজ-সরল ছিলেন হকিং
এটা তো সবারই জানা যে, ১৯৯৭ সালে ব্ল্যাক হোল নিয়ে একটি বাজি ধরেছিলেন হকিং। তিনি জানিয়েছিলেন ব্ল্যাক হোল বলে মহাবিশ্বে কিছু হয় না। পরবর্তী কালে সেই তথ্য সংশোধন করেন তিনি। কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব যে রয়েছে যে বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দেন। হকিং যুগের আগে মানুষের ধারণা ছিল, ব্ল্যাক হোলের ভিতর মহাকর্ষীয় বল এতটাই বেশি যে এটি মহাবিশ্বের অন্য সকল বলকে অতিক্রম করে। এর থেকে কোনও কিছুই পালাতে পারে না। এমনকী তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণও নয়। হকিং প্রথম কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তথ্য দিয়ে দেখিয়েছিলেন, মহাবিশ্বে এমন বস্তুও রয়েছে যা ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষীয় বল অতিক্রম করতে পারে। এমনকী তাঁর বিখ্যাত আবিষ্কার ‘হকিং রেডিয়েশন’ দিয়ে বিজ্ঞানী প্রমাণ করা চেষ্টা করেছিলেন ব্ল্যাক হোলকেও ধ্বংস করা সম্ভব। কোনও শক্তিশালী বিকিরণ ব্ল্যাক হোলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলে ব্ল্যাক হোল তার শক্তি হারায়। ধীরে ধীরে তার ভর কমতে কমতে মহাশূন্যে বিলিন হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: স্টিফেন হকিং এক বিস্ময় প্রতিভার নাম
ইদানীং কালে হকিং ব্ল্যাক হোলের ভিতরে কী রয়েছে সেই গবেষণা শুরু করেছিলেন। ব্ল্যাক হোলের ভিতরে কোনও কিছু প্রবেশ করলে তার পরিণতি কী হয়, তা নিয়ে তাঁর গবেষণা অনেক দূর এগিয়েছিল। আমার ধারণা, ১০০ বছর পরেও এই গবেষণা নিয়ে আমরা আলোচনা করব। মহাবিশ্ব নিয়ে অনেক অজানা তথ্য আমাদের হাতে আসবে। তা ছাড়া, ব্ল্যাক হোলের তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে কী ভাবে ‘টাইম টেবল’ করা যায়, সেই নিয়েও হকিংয়ের গবেষণা রয়েছে। তবে, সেই গবেষণা এতটাই জটিল যে এখনও আমরা সঠিক ভাবে বুঝে উঠতে পারিনি।
বাস্তববাদী ছিলেন হকিং। ঈশ্বরের অস্তিত্বকে কোনও দিনই মানতে চাননি। আমি জানি, এমন অনেক বিজ্ঞানী রয়েছেন যাঁরা হকিংয়ের সঙ্গে এই বিষয়ে সহমত। আজকের গ্যালিলিওর মৃত্যুদিনে জন্ম হয়েছিল হকিংয়ের। আর আজ আইনস্টাইনের জন্মদিনে তাঁর মৃত্যু হল। এই জন্ম-মৃত্যু নিয়েও অনেকে রহস্য খোঁজার চেষ্টা করছেন। তবে, আমি বলব, গ্যালিলিও এবং আইনস্টাইনের মধ্যে সেতু রচনা করেছিলেন হকিং। গ্যালিলিও তুলে ধরেছিলেন মহাবিশ্বের তত্ত্ব। আইস্টাইন অঙ্ক কষে দেখিয়েছিলেন তার বাস্তব প্রয়োগ। আর হকিং, এই দু’জনকেই সঙ্গে নিয়ে সহজ ভাবে দেখিয়েছিলেন পদার্থবিদ্যাকে সঙ্গী করে কী ভাবে মহাবিশ্বকে জানা যায়। ছোট গবেষণাগারে বিজ্ঞান চর্চা করেও, সুদূর গ্যালাক্সির গোপন রহস্যের সমাধান কী ভাবে করা যায়, তারই হদিশ দিয়েছিলেন এই মহাবিজ্ঞানী।
(লেখক পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাসট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাসট্রোফিজিক্স (আইইউসিএএ)-এর ডিরেক্টর এবং পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy