ধরা যাক, দূরে, বহু দূরে, মহাবিশ্বের অন্য কোনও প্রান্তে কোনও এক গ্যালাক্সিতে একটি দৈত্যাকার তারার মৃত্যু হল। অসম্ভব রকমের উষ্ণ, উদ্দাম তাপ-পারমাণবিক বিক্রিয়ায় সেই তারার দেহের প্রায় পুরোটাই চুর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল সেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে। আমরা লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে বসে সাক্ষী হয়ে থাকলাম সেই নজরকাড়া মহাজাগতিক ‘আতশবাজি’র!
মহাশূন্যে শব্দের বিস্তার ঘটে না বলে আমরা সেই ‘মহাবজ্রে’র ঝঙ্কার শুনতে পেলাম না। কিছু দিন বাদে সেই বিস্ফোরণের ফলে দৈত্যাকার তারাটির ধ্বংসাবশেষ চার দিকে ছড়িয়ে পড়লে হয়তো সেই জায়গায় পড়ে থাকবে অসম্ভব রকমের ঘন ও ভারী কোনও অবশিষ্ট। যা, নিউট্রন তারা হতে পারে। হতে পারে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর।
আর কিছু হল কি সেই বিস্ফোরণের ফলে ?
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ বলছে, আমাদের চোখের আড়ালে আরও অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে সেই বিস্ফোরণে। বিস্ফোরণে ওই তারার ‘শরীরে’ উপাদানের পুনর্বণ্টন হয়েছে। আর, তার ফলে তার আশপাশে অনেকটাই পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে তার মহাকর্ষের।
আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে বলা হচ্ছে, যে কোনও দুটো বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষীয় আকর্ষণের কারণ হল, তাদের ভরের ফলে তারা তাদের আশপাশের স্থান-কালকে বিকৃত করে দেয়। টানটান করে বাঁধা একটি চাদরের মাঝে একটা পাথর রাখলে যেমন তৈরি হয় একটি উপত্যকার। সেখানে যদি একটা ছোট্ট গুলিকে গড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে সেই গুলির গড়িয়ে যাওয়াকে আমরা ভাবতে পারি, যেন তা কোনও বড় পাথরের আকর্ষণেরই ফল।
আপেক্ষিকতাবাদ বলে, এই আকর্ষণকে আমরা যেন দেখি ওই অবতরণের ফল হিসেবেই। তার মানে, ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্রই স্থান-কাল আছে যেন এক চাদরের মতো। বস্তুর গতি অন্য বস্তুর আকর্ষণের ফলে নয়, ওই স্থান-কাল-চাদরের বিকৃতির ফলেই।
তাই যদি হয়, তা হলে তারার মৃত্যুতে যে আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটল, তাতে উথালপাথাল হওয়া উচিত ওই স্থান-কাল চাদরের। সুদূরপ্রসারী ঢেউ খেলে যাওয়া উচিত সব দিকে এই বিস্ফোরণের খবর পৌঁছে দিয়ে। শব্দ-বিস্তার নাই-বা হল। এটাই এ ক্ষেত্রে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের ভাবীকথন।
এই দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া স্থান-কালের অন্তরালে, আমাদের সীমিত দৃষ্টির বাইরে, মহাবিশ্বে সব সময় ঘটে চলছে অনেক চমকপ্রদ ঘটনা। গ্যালাক্সি-গ্যালাক্সিতে মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়া, তারায় তারায় ধাক্কা, ব্ল্যাক হোল আর নিউট্রন তারার মধ্যে সঙ্ঘাত-সঙ্ঘর্ষ। এ সব ঘটনায় আলো উত্পন্ন হয় না, তাই কখনওই আমাদের চোখে পড়বে না সেই সব নাটকীয়তা। অথচ স্থান-কালের চাদর এতে আলোড়িত হচ্ছে। তাই বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মধ্যেই লুকিয়ে থাকবে বিজ্ঞানের অনেক জটিল রহস্যের সমাধান।
তবে এই ধরনের মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্বের সরাসরি খোঁজ মেলেনি এখনও। খোঁজ-তল্লাশটা চলছে কিন্তু বিশ্ব জুড়েই।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সব বস্তুর মধ্যে দিয়েই বাধাহীন ভাবে চলে যেতে পারে। তাই এদের খোঁজ পাওয়া আর তাদের শনাক্ত করাটা খুবই শক্ত।
২০০৬ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্টের দু’টি প্রদেশের মধ্যে চার কিলোমিটার লম্বা ‘লাইগো’য় (লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি) চলছে সেই খোঁজার কাজ। অনেকটা ইংরেজির ‘L’ আক্ষরের মতো। ওয়াশিংটনের হ্যানফোর্ড আর লুইজিয়ানার লিভিংস্টনে দুই মানমন্দিরে চলেছে সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের খোঁজ-তল্লাশ। লেজার রশ্মির মাধ্যমে সরাসরি সেই স্থান-কাল চাদরের উত্থান-পতন মেপে নেওয়ার চেষ্টার মধ্যে দিয়েই চলছে ওই তরঙ্গের সন্ধান।
২০১৫-র অক্টোবরে শুরু হয়েছে অ্যাডভান্সড লাইগো। মানে, ওই একই যন্ত্রের দ্বিতীয় প্রজন্মের অনুসন্ধান। সেই যন্ত্রের একটি আমেরিকার সহযোগিতায় ভারতের মাটিতেও বসানো হবে। যার নাম-নাম ‘লাইগো-ইন্ডিয়া’।
আমার ধারণা, সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের শতবর্ষে আমরা প্রথম দেখা পাব ওই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy