বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক সোমক রায়চৌধুরী (ইনসেটে)।
• চাঁদ নিয়ে কাব্য ও কাহিনীর শেষ নেই। শেষ নেই ফ্যান্টাসি, ফিকশনের। কাব্যে চাঁদ হয়েছে ‘কাস্তে’! ঝলসানো রুটি! রয়েছেন ‘চাঁদ মামা’ও। বিজ্ঞানে চাঁদ রয়েছে আমাদের বাঁচাতে। ভাটাই হত না চাঁদ না থাকলে। চাঁদ ধীরে ধীরে আমাদের ছেড়ে দূরে চলে গেলে দিনের আয়ু বেড়ে যাবে আরও। মায়াবী অন্ধকারের মেয়াদ কমবে। চাঁদ কী ভাবে বাঁচিয়েছে আমাদের, ইতিহাসে-মহাকাব্যে, সেই কাহিনী যদি বলতেন একটু...
সোমক রায়চৌধুরী: চাঁদ নিয়ে কথা ও কাহিনীর শেষ নেই। ইতিহাস ও মহাকাব্যগুলিতে এমন বহু ঘটনার উল্লেখ রয়েছে, যেখানে আমাদের বার বার বাঁচিয়েছে চাঁদ। আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন যে ক্রিস্টোফার কলম্বাস, তিনি তো আসলে ১৫০৩ সালে পৌঁছেছিলেন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের জামাইকা দ্বীপে। সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা তো কলম্বাসকে দেখে ভেবে বসলেন বাইরে থেকে আসা কোনও শত্রু। দল বেঁধে গিয়ে তাঁরা ঘিরে ফেললেন কলম্বাসকে। তাঁকে জেলে বন্দি করে ফেললেন। সেটা ১৫০৪ সাল। বরাত ভালই ছিল বলতে হবে কলম্বাসের। তিনি পাঁজি দেখতে জানতেন। তাই জানতে পেরেছিলেন, আর ক’দিন পরেই হবে চন্দ্রগ্রহণ। আর সেটা হবে এ বারের মতোই ব্লাড মুন। ভাবলেন, এটা বলে ভয় দেখিয়ে যদি ছাড়া পাওয়া যায় জেল থেকে। দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দাদের তখন কলম্বাস বললেন, ‘‘আমাকে ধরে রাখলে ঈশ্বর খুব চটে যাবেন। আর ক’দিন পরেই চাঁদ রেগে লাল হয়ে যাবে। আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা। না হলে তোমাদের ক্ষতি হবে।’’ সত্যি-সত্যিই কয়েক দিন পর চন্দ্রগ্রহণ হল। আর দেখা গেল লাল ‘ব্লাড মুন’ও। ভয় পেয়ে গেলেন জামাইকা দ্বীপের বাসিন্দারা। ভাবলেন, কলম্বাসকে জেলে পুরে রাখায় ঈশ্বর তাঁদের ওপর খুব রুষ্ট হয়েছেন। আরও রুষ্ট হতে পারেন ভেবে সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা জেল থেকে ছেড়ে দিলেন কলম্বাসকে।
• কলম্বাসের মতো বিপদ থেকে বাঁচতে আর কি কেউ শরণ নিয়েছিলেন চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণের?
সোমক রায়চৌধুরী: মনে পড়ে সেই ‘প্রিজনার্স অফ দ্য সান’-এর গল্প? টিনটিনও বেঁচে গিয়েছিল প্রায় একই রকম ভাবে। আগন্তুক টিনটিনকে শত্রু ভেবে তাকেও ঘিরে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু বরাত ভালই ছিল বলতে হবে টিনটিনের। সে কলম্বাসের মতো পাঁজি দেখতে জানত না ঠিকই, কিন্তু হঠাৎই খবরের কাগজের একটা ঠোঙার লেখা পড়ে জানতে পেরেছিল, পরের দিনই হবে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। দিনেই রাত নেমে আসবে পৃথিবী জুড়ে। চার পাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যাবে। পরের দিন যখন সত্যি-সত্যিই সেটা হল, ভয় পেয়ে তখন ছেড়ে দেওয়া হল টিনটিনকে।
মার্ক টোয়েনের বই ‘কানেক্টিকাট ইয়াঙ্কি ইন কিং আর্থার্স কান্ট্রি’-র গল্পে একই ভাবে পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের ভয় দেখিয়ে বড় বিপদের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন এক মার্কিন নাগরিক।
গ্রহণে যে ভাবে চাঁদ ধীরে ধীরে হয়ে উঠবে ‘ব্লাড মুন’
চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে খুব কুসংস্কার ছিল আথেন্সবাসীদের। যুদ্ধের জন্য যে দিন জাহাজে যাত্রা করার কথা ছিল গ্রিক সেনাদের, সে দিনটি ছিল পূর্ণিমা। কিন্তু সেই পুর্ণিমাতেই ছিল চন্দ্রগ্রহণ। তাই সে দিন যাত্রা স্থগিত রাখেন গ্রিক সেনারা। এক মাস পরের পূর্ণিমায় যাত্রা শুরু করবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন গ্রিক সেনারা। কিন্তু তার আগেই স্পার্টানরা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁদের ওপর। ফলে, যুদ্ধে হেরে যেতে হয় গ্রিকদের।
আরও পড়ুন- আজ চন্দ্রগ্রহণ: এমন বিরল মহাজাগতিক ঘটনা ফের ১০৫ বছর পর!
আরও পড়ুন- চাঁদ কেন হয়ে যাবে ব্লাড মুন? কেন এত উজ্জ্বল হবে মঙ্গল?
• সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সময় প্রকৃতি যখন আক্ষরিক অর্থেই হয়ে পড়ে একটু অন্য রকম, তখন তার কি কোনও প্রভাব পড়ে প্রাণীদের ওপর?
সোমক রায়চৌধুরী: দিনে যদি হঠাৎই রাত নেমে আসে আর পূর্ণিমার রাতের সব আলো ফুৎকারে উড়ে গিয়ে চার পাশে নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার, তা হলে সেটা তো পশু, পাখিদের রোজকার নিয়ম, অভ্যাসে ব্যাঘাত ঘটাবেই। ওরা ঘাবড়ে যায়। তাই ওই সময় পশু, পাখিদের অস্বাভাবিক আচার, আচরণ করতে দেখা যায়। কিন্তু সেটা একেবারেই আচরণগত। বিজ্ঞান বলছে, তার ওপর গ্রহণের কোনও প্রভাব নেই।
• জোরে ঘোরার কি দম কমছে পৃথিবীর? দিন বড় হচ্ছে?
সোমক রায়চৌধুরী: চাঁদ একটু একটু করে দূরে চলে যাচ্ছে বলেই পার্থিব দিন আগের চেয়ে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। সাড়ে ৪০০ কোটি বছর আগে যখন অনেক জোরে লাট্টুর মতো ঘুরতো পৃথিবী, তখন পার্থিব দিন ছিল মাত্র ২৩ হাজার সেকেন্ড বা সাড়ে ৬ ঘণ্টার। ৩০০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর লাট্টুর গতি যখন একটু কমল, তখন পার্থিব দিনের আয়ু বেড়ে হয় ৮ ঘণ্টা। ৬২ কোটি বছর আগে পার্থিব দিন ছিল ২২ ঘণ্টার। আজ যেটা দাঁড়িয়েছে ২৪ ঘণ্টাতে। আরও ৬৫ কোটি বছর পর হবে ২৭ ঘণ্টার দিন। অর্থাত্ যত দিন যাবে, এই সময় আরও বাড়তে থাকবে।
সূর্য, পৃথিবী (মাঝে) আর চাঁদ যে ভাবে থাকলে হয় পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ
• চাঁদ আমাদের কী কী উপকার করেছে, করে চলেছে?
সোমক রায়চৌধুরী: চাঁদ আছে বলেই অনেক বেশি সময় ধরে দিনের আলো দেখতে পেয়েছে পৃথিবী। আর তা প্রাণ সৃষ্টি ও বিকাশের সহায়ক হয়েছে। পৃথিবীর ‘লাট্টু’টা খুব জোরে ঘুরলে দিন বা রাত কোনওটাই খুব বেশি ক্ষণের জন্য স্থায়ী হতে পারতো না। সেই লাট্টুর ঘোরার গতি কমানোর কাজটাই এত দিন ধরে করে গিয়েছে চাঁদ। তার অভিকর্ষ বলের টানে। যেমন কোনও চলমান সাইকেলের চাকায় হাত বা অন্য কিছু ছোঁয়ালে তার ঘোরার গতি কমে যায়। চাঁদ সেই কাজটাই করেছে, করে চলেছে। পৃথিবীর খুব কাছে থাকার সময়ে তো বটেই। এমনকী, পৃথিবীর ‘মায়া’ কাটিয়ে তাকে ছেড়ে দূরে চলে যেতে যেতেও। চাঁদের জন্যই জোয়ার, ভাটা। তার ওপর নির্ভরশীল যেমন মৎস্যজীবীদের জীবন, জীবিকা, তেমনই নির্ভরশীল জলজ অণুজীবের জীবন-চক্রও।
• চাঁদ কি আর অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে হয়ে উঠবে ভিন গ্রহে যাওয়ার ‘হল্টিং স্টেশন’?
সোমক রায়চৌধুরী: সে তো বটেই। আর ৩০/৪০ বছরের মধ্যেই চাঁদ হয়ে উঠবে আমাদের ভিন গ্রহে যাওয়ার জন্য এক ও একমাত্র ‘হল্টিং স্টেশন’। কারণ, ব্রহ্মাণ্ডের ভিন মুলুকে যাওয়ার রুটে চাঁদই আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। অদূর ভবিষ্যতে মানবসভ্যতাকে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে একটু একটু করে ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলে বানাতেই হবে ‘দ্বিতীয় উপনিবেশ’। আর সেটা তো এক দিন বা একটা বছরে হবে না। কারণ, মঙ্গল রয়েছে অনেক অনেক দূরে। সভ্যতার একটা অংশকে তার যাবতীয় লটবহর নিয়ে মঙ্গল মুলুকে উঠে যেতে হলে কাছের চাঁদেই আগে পা রাখতে হবে। সেখান থেকেই চালিয়ে যেতে হবে একের পর এক মঙ্গল বা অন্য কোনও গ্রহে অভিযান।
• শুধুই ‘হল্টিং স্টেশন’? চাঁদ কি আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি মেটাতে পারে না সাহায্য করতে?
সোমক রায়চৌধুরী: খনিজ পদার্থ চাঁদের অনেক গভীরে রয়েছে। তাই চাঁদ থেকে খনিজের উত্তোলন করা কষ্টসাধ্য। খনিজ পদার্থ আনার জন্য যেতে হবে গ্রহাণুগুলিতে। আর তার জন্য চাঁদকেই বানাতে হবে আমাদের ‘হল্টিং স্টেশন’। শুধু তাই নয়, সেই সব খনিজ পদার্থের গুদামও বানাতে হবে চাঁদে। খনিজ পদার্থের নিষ্কাশন ও প্রক্রিয়াকরণের কাজটাও করতে হবে চাঁদেই। যে দ্রুত হারে পৃথিবীতে মজুত করা খনিজ পদার্থ আমরা শেষ করে ফেলছি, তাতে সেই কাজ শুরু করে দিতে হবে তাড়াতাড়ি।
আরও পড়ুন- শুক্রবার চার ঘণ্টার চন্দ্রগ্রহণ, কোথা থেকে কেমন দেখতে পাবেন, জেনে নিন
আরও পড়ুন- পৃথিবীতে এক দিন আর কোনও গ্রহণই হবে না!
• কেন এই পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণকে বলা হচ্ছে শতাব্দীর দীর্ঘতম?
সোমক রায়চৌধুরী: চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে। এক বার পাক খেতে সময় নেয় গড়ে প্রায় সাড়ে ২৭ দিন। এই সাড়ে ২৭ দিনে চাঁদ তার কক্ষপথে এক বার পৃথিবীর নিকটতম বিন্দুতে (পেরিজি বা অনুভূ) থাকে। আর এক বার থাকে দূরতম বিন্দুতে (অ্যাপোজি বা অপভূ)। ২৭ জুলাই চাঁদ থাকবে অ্যাপোজিতে। বা, তার কক্ষপথের দূরতম বিন্দুতে। ওই অবস্থানে থাকার সময় চাঁদের গতিবেগ কম হবে। শুধু তাই নয়, এই গ্রহণে চাঁদ পৃথিবীর ছায়া-কোণের প্রায় কেন্দ্রস্থল দিয়ে অতিক্রম করবে। তার মানে, কম গতিবেগে তার কক্ষপথে থাকা চাঁদ তার গ্রহ পৃথিবীর ছায়া-কোণের প্রায় দীর্ঘতম পথ অতিক্রম করবে। আর ওই সময় চাঁদের গতিবেগ কম থাকবে বলে পৃথিবীর ছায়া-কোণের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে বেশি সময় লাগবে চাঁদের। তাই এটি হবে শতাব্দীর দীর্ঘতম চন্দ্রগ্রহণ।
• পূর্ণগ্রাসের সময় চাঁদ কেন লাল আভার (ব্লাড মুন) হয়? তার কি কোনও বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে, নাকি তা চোখের বিভ্রান্তি?
সোমক রায়চৌধুরী: পৃথিবীর ছায়া চাঁদকে পুরোপুরি ঢেকে ফেললেই হয় পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ। ওই সময় চাঁদকে কিছুটা লালচে দেখায়। এ ক্ষেত্রে চাঁদ পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায় না পৃথিবীর ছায়ায়। ঠিকই, পূর্ণগ্রাস চলার সময় সূর্যের আলো চাঁদের গায়ে পড়ে না। কিন্তু পৃথিবীর ওপর যে বায়ুমণ্ডলের স্তর রয়েছে, তার ওপর তো সূর্যের আলো এসে পড়ে। সূর্যের সাদা আলো সাতটি রংয়ের আলোর সংমিশ্রণ। তাদের মধ্যে বেগুনি, নীলের মতো কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি বায়ুমণ্ডলে বেশি বিচ্ছুরিত (স্ক্যাটার্ড) হয়। ফলে ওই রংয়ের আলো চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
অন্য দিকে, কমলা ও লাল- এই দু’টি দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কম বিচ্ছুরিত হয়। ওই দু’টি আলোকরশ্মি তাই বেশি ছড়িয়ে পড়তে পারে না। বায়ুমণ্ডলে ওই দু’টি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মির প্রতিসরণ (রিফ্র্যাকশন) ঘটে। আর তার ফলে সেই আলো কিছুটা বেঁকে গিয়ে পড়ে চাঁদের গায়ে। তাই পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের লাল আভা দেখা যায়।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy