ইফতারের আয়োজন।
দু’বছরের অতিমারির দুঃসময় অতিক্রান্ত। রমজান মাসে কলুটোলা-জাকারিয়ার জমজমাট ইফতার-সন্ধ্যা ফের হাজির।সামাজিক মাধ্যমের সৌজন্যে আদমের কাবাবের সূক্ষ্ম বর্ণনা অনবরত ভেসে আসছে। কলকাতায় ইফতারের ইতিহাস ও অনন্য স্বাদগন্ধের কথা বললে জাকারিয়ার কথাই আগে চলে আসে। অথচ দেড় দশক আগেও জাকারিয়ার ইফতার আয়োজনের বহর ছিল, কিন্তু শহরবাসীর কাছে তা ছিল অনেকটাই অজানা।
বছর কুড়ি আগে কবি শঙ্খ ঘোষ ‘সম্পর্কের উৎসব’ শীর্ষক প্রবন্ধে আক্ষেপ করেছিলেন, “সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে পথ চলতে চলতে হঠাৎই ঢুকে পড়ি কলুটোলার এক গলিতে। ঢুকে একটা চমক লাগে। অজস্র লোকের ভিড়ে সেখানে জমে উঠেছে চমৎকার এক মেলা। কিসের মেলা এটা? মুহূর্ত পরে মনে পড়ে আজ ইদের দিন, এ নিশ্চয় ইদের মেলা তবে।... হঠাৎ এ গলিতে ঢুকে না পড়লে মেলাটির অস্তিত্ব বিষয়ে কোনো জ্ঞানই কিথাকত আমার?”
শঙ্খবাবু বেঁচে থাকলে রমজান মাসকে কেন্দ্র করে মানুষের এই উদ্যাপন দেখে হয়তো বেজায় খুশি হতেন। যেমন ভাবে শহর জুড়ে দুর্গাপূজা বা ডিসেম্বর শেষের পার্ক স্ট্রিটকে কেন্দ্র করে শহরবাসীর সামাজিক মেলামেশার পরিসর তৈরি হচ্ছে, রমজান মাস জুড়ে কলকাতার এই জনপদে বাস্তবিক ইফতারির মেলা চলে, যা ক্রমশ এক সর্বজনীন রূপ পাচ্ছে। এ ছাড়া কলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাগুলো, যেমন পার্ক সার্কাস, রাজাবাজার বা খিদিরপুর, তালতলা, বেলগাছিয়া, মেটিয়াবুরুজ ইত্যাদি জায়গায় ইফতার বাজার জমে উঠে। এই সব অঞ্চলের ইফতার বাজারের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠছে। রমজান মাসের ইফতারের বাইরেও কিছু ধর্মীয় অনুষঙ্গ ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা নিয়ে অবশ্য আলোচনা নগণ্য।
রমজান মাসে নিরম্বু উপবাস ইসলামের পাঁচটি ‘ফরজ’-এর (অবশ্য কর্তব্য) মধ্যে অন্যতম। ‘রমজান’ ইসলামিক ক্যালন্ডারের নবম মাস। রমজান ‘সিয়াম’ সাধনার মাস। ‘সিয়াম’ বহুবচন। এর একবচন হল ‘সাওম’, যার অর্থ বিরত থাকা। ফারসি, উর্দু, হিন্দি ও বাংলায় সাওম বা সিয়ামকে ‘রোজা’ বলা হয়। খুব ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকাকে রোজা বলে। সিয়ামকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়, অর্থাৎ কেবল কঠোর উপবাস নয়, সব রকমের পাপ কাজ থেকে চিরতরে বিরত থাকার অভ্যাস তৈরি করা। রমজানের চাঁদ দেখা, ভোররাতে সেহরি, সূর্যাস্তের পর পরই ইফতার করা, ‘তারাবিহ’ নমাজ ইত্যাদি এই সময়ের অবশ্য পালনীয় কিছু আচার। এই মাসেই মানুষের জন্য পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়।
এক দশক আগেও রমজানের চাঁদ দেখাকে কেন্দ্র করে যে উৎসবের আমেজ থাকত, সে অভ্যাসে খানিক ভাটা পড়ছে। তখনকার দিনে চাঁদ দেখতে পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা ছিল, তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকত এক চাপা আনন্দ। পরিবারের সদস্যেরা বাড়ির ছাদে জড়ো হন, বিশেষ করে ইদের চাঁদের অপেক্ষায়। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে চাঁদ দেখার আনন্দ খানিক ফিকে হয়ে আসছে। ভারতের এক দিন আগে আরবে রোজা শুরু হয়, সে খবর ক্ষণিকেই চলে আসে। তা শুনেই রমজানের সূচনা হয়।
আর চাঁদ দেখা দিলে সেই রাত থেকেই রাতের দীর্ঘ সময়ের নমাজ শুরু হয়, যাকে ‘তারাবিহ’র নমাজ বলা হয়। এর অর্থ বিশ্রাম নেওয়া ও প্রশান্তি লাভ করা। প্রতি চার রাকাত অন্তর (চার বার ওঠা ও বসার) বিরতির মাধ্যমে বিশ্রাম নেওয়া হয় বলে, এর নাম তারাবিহ। এক মাস ধরে রাতের প্রার্থনা প্রধানত মসজিদে আয়োজন করা হয়। এই প্রার্থনা চলাকালীন ইমাম কোরআন পড়ে শোনান। গত এক দশকে ‘তারাবিহ’ নমাজের এক পরিবর্তন চোখে পড়ছে, মসজিদের বদলে ছোট ছোট দলে, বিশেষ করে ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে এই নমাজের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মুসলমান পাড়াগুলোয় গিয়ে দেখা যায়, বেশ কিছু ছাদ থেকে কোরআন পড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে। কোথাও তিন দিনে, কোথাও দশ বা পনেরো দিনে এক বার কোরআন পড়া শেষ করে ‘তারাবিহ’র নমাজ হচ্ছে। শেষ দিনকে ‘খতম তারাবিহ’ বলা হয়, এই দিন ছোট করে অনুষ্ঠান করা হয়, মূলত ইমাম বা সহকারী ইমামের পরিশ্রমের জন্য ‘নজরানা’ তুলে দেওয়া হয়। ‘তারাবিহ’ নমাজ আয়োজনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, মেয়েদের জন্য ‘তারাবিহ’-র বিশেষ ব্যবস্থা। খিদিরপুর অঞ্চলে তিন-চার জায়গায় শুধু মেয়েদের জন্য ‘তারাবিহ’-র ব্যবস্থা থাকছে। মোমিনপুরের হোসেন শাহ পার্কে গত বছর থেকে ইদেও মেয়েদের জামাতে প্রায় দু’শো মহিলা ইদের নমাজে অংশগ্রহণ করেছেন।
রোজার আর এক অনুষঙ্গ ভোররাতে কিছু খাবার খাওয়া, যা ‘সেহরি’ নামে প্রচলিত। শব্দটি আরবি ‘সাহর’ থেকে উদ্ভূত। ‘সাহর’ শব্দের অর্থ হল রাতের শেষভাগ বা ভোররাত। মুসলমানরা রোজা পালনের উদ্দেশ্যে শেষরাতে যে আহার করে থাকেন, তাকে ‘সেহরি’ বলা হয়। এখন প্রশ্ন হল, ভোররাতে গভীর নিদ্রা থেকে রোজাদারকে জাগাবে কে? বহু বছর ধরে ‘ঘুম ভাঙানিয়া দল’ বা দরবেশ ও তাঁদের রচিত ছোট ছোট ছড়া ভোররাতে রোজাদারদের ঘুম ভাঙাতে সাহায্য করত। এই দলগুলো প্রধানত পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে কলকাতায় জড়ো হত। পুণ্যের সঙ্গে রমজান মাসে বাড়তি কিছু আয়ের আশায় শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষায় শোনা যেত তাদের গলার জোর। কিছু ক্ষেত্রে কাঁসা বা বাসন বাজানোর প্রথাও ছিল। গত এক দশকে মোবাইলের সর্বগ্রাসী উপস্থিতিতে ‘ঘুম ভাঙানিয়া দল’ বা কাফেলা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে তাঁদের রচিত মুখে মুখে ফেরা ইসলামিক ছড়া বা ‘নাত’। তাঁদের দৃপ্তকণ্ঠে শোনা যেত— ‘আ গ্যায়া মোমিনো মাহে রমজান শার ঝুকাও খুদা কি ফারমান’ বা ‘জাগে গা পায়েগা, সোয়ে গা খোয়ে গা’, ‘ওঠ যাও মাই বাবা— সেহরি কা ওয়াক্ত হো চালা— ওঠ যাও মাই বাবা’ ইত্যাদি। প্রতি পাড়ায় এই ধরনের একটা করে দল থাকত, যার প্রধান কাজ রোজাদারদের ঘুম থেকে ডেকে তোলা।
কোলের শিশু থেকে পরিবারের বয়স্ক-সহ সবার জন্যই ইদ মানেই নতুন জামাকাপড়। ইদের পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে কলকাতার মুসলমানদের মধ্যে এখন এক ধরনের সাবেকিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। আর্থিক সঙ্গতির সঙ্গে সঙ্গে অভিজাত শপিং মলে অনেকেই জামাকাপড় কেনেন, তবে রমজানের প্রথম সপ্তাহে ধর্মতলার গুজরাতি বোরা মুসলিমদের ১১৫ বছরের পুরনো কাপড়ের দোকানে চোখে পড়ার মতো ভিড় হয়। এর পর তালতলা, পার্ক সার্কাসে বা খিদিরপুরের অখ্যাত অথচ দক্ষ দর্জির দোকানে লম্বা লাইন পড়ে। বংশপরম্পরায় এই দর্জিরা আসলে পোশাকশিল্পী। রেডিমেড পোশাকের এত রমরমার মাঝেও মফিদুল ইসলাম লেনের ‘কামার টেলারিং’ বা দেদার বক্স লেনের হাজী ঘাউসুল্লাহের দর্জির দোকানে রমজানের প্রথম সপ্তাহেই অর্ডার নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সাবেক পোশাক তৈরিতে কেন এখনও আগ্রহ এত বেশি? কামার টেলারিংয়ের সাদাব কামার বলেছিলেন, “রেডিমেড সব কে লিয়ে, মেরা কাম সির্ফ আপকে লিয়ে।” দেশভাগের সময় নিরাপত্তা ও নানা কারণে মুসলমানদের অনেকেই যখন কলকাতা ছেড়ে যাচ্ছিলেন, তখন খানিক ঝুঁকি নিয়েই দর্জিদের একটা বড় অংশ এ শহরে থেকে যান।
এই শহরেও রমজান উদ্যাপনের দীর্ঘ ইতিহাস আছে, তবে কঠোর ধর্মীয় অনুষঙ্গের কারণে আগে তা মুসলমান সমাজ-সম্প্রদায়ের ভিতরেই আয়োজন করা হত। বিগত কয়েক দশক ধরে কলকাতাতেও ইফতারের পরিধি বাড়ছে।
দেশে যখন রাজনীতির স্বার্থে অনবরত ঘর ভাঙার খেলা চলছে, তখন এই শহরে কিছু ছক-ভাঙা, আপন করে নেওয়া ইফতারের মজলিশে হাজির হওয়ার সুযোগ হল। ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত ডন বস্কো স্কুল, পার্ক সার্কাস-এর প্রাক্তনীরা এই রকম এক অভিনব ইফতারের আয়োজন করছে ২০০৫ সাল থেকে। ইফতারের মজলিশের পরিচালনায় তদারকি করছেন অভিজ্ঞান চক্রবর্তী। প্রাক্তন ছাত্র ওয়াসিম বক্স, আঞ্জার খান প্রমুখ যত্ন করে ইফতারের সামগ্রী সব টেবিলে পড়েছে কি না, তার দেখাশোনা করছেন। এই কাজে সাহায্য করেছেন ওয়াল্টার কুজুর ও মার্টিন ওস্তা-র মতো কয়েক জন। প্রাক্তন ছাত্র ছাড়া ডন বস্কো সেলসিয়ানদের, যেমন ব্যান্ডেল ও লিলুয়া থেকে অনেকে এসেছেন। স্কুল চত্বরে আজানের ও নমাজের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পেয়ারি কাবাব, হালিমের আস্বাদে মেতে উঠেছিলেন প্রায় চারশো অতিথি, আর অ্যাসেম্বলির পোডিয়ামের এক দিকে স্বয়ং জিশু, অন্য প্রান্তে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ডন বস্কো যেন হাত তুলে আশীর্বাদ করছেন রোজাদারদের— এখনও আশা আছে... সম্প্রীতির, ভালবাসার, মানবিক সহাবস্থানের।
ইফতারের মজলিশে কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনার মধ্যে সাংস্কৃতিক মেলামেশা বা পারস্পরিক বিনিময় ক্ষেত্রের একটা পরিসর তৈরি করছে ‘নো ইয়োর নেবার’ নামে একটা সামাজিক সংগঠন। গত সাত বছর ধরে কলকাতার বিভিন্ন জায়গার অ-মুসলমান বন্ধুরা, যাঁরা আগে কখনও ইফতারে শামিল হতে পারেননি, তাঁদের জন্য এই আয়োজন। ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ-পরিচয়ের বেড়া ভেঙে ইফতার এক ছক-ভাঙা মিলনমেলায় পরিণত হচ্ছে। অন্য দিকে হাওড়ার প্রিয় মান্না বস্তির সর্পিল গলিতে ইফতারের আয়োজনে বস্তিবাসী জনসাধারণের যোগদান দেখে চমক লাগে, ছোট শিশু থেকে শুরু করে পুরুষ এবং মহিলা সমান ভাবে ইফতারের আয়োজনে হাত লাগাচ্ছেন। বস্তিতে প্রবেশদ্বারে কেউ পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, আবার কেউ শরবত পরিবেশন করছেন। এই আয়োজনে অতিথিরা বেশির ভাগই অপরিচিত, তাই এটাই তো সেরা সময় পাশের লোকটিকে চিনে নেওয়ার! আর তাই তো জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে অসংখ্য মানুষের জমায়েত! সকলের সঙ্গে ইফতারে বসে অকৃত্রিম আত্মীয়তার অনুভূতি পাওয়া যায়, সুদৃঢ় হয় সৌভ্রাত্রের বন্ধন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy