Advertisement
E-Paper

আতিফের বাবা

ছোট গল্প

ছবি: কুনাল বর্মণ।

সুদীপ জোয়ারদার

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৫ ১০:২৮
Share
Save

লাল রঙের জামাটার নাম বিপিন দিয়েছে ‘কলহপ্রিয়’। কারণ ও দেখেছে, এই জামাটা পরে বেরোলেই কারও না কারও সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়ে যায়। তাই বিপিন এটা আর পরে না। আলমারিতে তুলে রেখে দিয়েছে।

বিপিনের এ রকম আরও দু’-একটা জামা আছে, যাদের অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। যেমন কালো চেক জামাটা। জামাটা দেখতেও সুন্দর, আরামদায়কও। কিন্তু এটা পরে রাস্তায় বেরোলেই যানজটে আটকে যায়। এমনিতেই যাতায়াতের রাস্তাটায় গাড়িঘোড়া বেশি, নেহাত ট্রাফিক থাকে তাই রক্ষে। কিন্তু এই জামাটা পরলে ট্রাফিকও কিছু করতে পারে না। এই জামাটার জন্য স্কুলে তিনটে সিএল গিয়েছে ওর। ফলে এই ‘পথে হল দেরি’ জামাটাও বিপিন এড়িয়ে চলে।

ফুলহাতা জামা বিপিনের খুব পছন্দ নয়। কিন্তু উপহারের জামার উপর তো বিপিনের হাত নেই। জামাটা দিয়েছিল ছোট শালি, কী একটা উপলক্ষে। এই জামাটা শুনেছে খুব দামি, এটায় ওকে মানায়ও চমৎকার। তবু জামাটা পরার জো নেই। এটা পরলেই ওর উপর বেশি কাজ চেপে যায়। স্কুলে তো এই জামাটা পরে গেলে চারটে রুটিনের ক্লাস বাদেও একটা-দুটো সাপ্লিমেন্টারি ক্লাস অবধারিত। এ ছাড়া, ফোনে আসতে থাকে রিনির ফরমায়েশের পর ফরমায়েশ। মজা করে জামাটাকে ‘কাজপাগলা’ বললেও, জামাটা আলমারির শোভাবর্ধক হয়েই আছে।

বিপিনের বিশ্বাস, জামার মতো ওর প্যান্টেও এ রকম অনেক ক্ষমতা লেপ্টে আছে। কিন্তু প্যান্টের সংখ্যা বড়ই কম। আসলে কেনাকাটার অভ্যেস বিপিনের তেমন নেই। ওর বস্ত্রসম্ভার অনেকটাই উপহার-নির্ভর। উপহারে প্যান্ট বা প্যান্টের কাপড় খুব কম আসে। ফলে পরার জন্য বিপিনের সাকুল্যে তিনটে প্যান্ট। ফলে প্যান্টের ক্ষমতা যাচাই করার সুযোগ ওর আর হয়ে ওঠেনি।

উপহারসূত্রে পাওয়া জামাও যে কয়েক গন্ডা আছে, তা নয়। কিন্তু তবু গুনলে একটা টি-শার্ট নিয়ে সাতটা তো হয়েই যাবে। এর মধ্যে গোটা তিনেক জামা না পরলে কী আর অসুবিধে!

স্কুলে যাওয়ার জন্য আজ একটা নতুন জামা ভেঙেছিল বিপিন। জামাটা গুঁজে আয়নায় দাঁড়িয়ে নানা পোজ়ে নিজেকে দেখে নিচ্ছিল। এমন সময় রান্নাঘর থেকে হুকুম, “একটা ফিনাইল এনে দিয়ে স্কুলে যাও।”

স্কুলে যাওয়ার আগে দোকানে কিছু আনতে গেলে খুব বিরক্ত লাগে। সময়ও খুব বেশি নেই। তবু ফিনাইল আনতে ফ্ল্যাটের নীচের মুদির দোকানটায় যেতেই হল। কিন্তু দোকানে দাঁড়াতেই বিপত্তি। কী যেন নেবে ও? ফাইনাল? এ রকম নামে কী পাওয়া যায়? ফলো অন? দূর! সে তো ক্রিকেটে হয়। না, কী আনতে হবে, মনে পড়ছে না তো মোটেই!

বিপিন মনে করার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুতেই নির্ভুল জিনিসের নামটা মনে পড়ল না!

না, আর এটার পিছনে ছোটা ঠিক হবে না। ফোন করে নেওয়া যাক রিনিকে। ফোনে অবশ্য সরাসরি বলল না, পাছে বেকুব বনে যায়, “রিনি, বাড়িতে কী যেন শেষ হয়ে গেছে? আনতে বললে?”

“কেন, ফিনাইল! নেই দোকানে?”

নাম জানা হয়ে গেছে। তাই এ বার, “খুঁজছে। দেখা যাক।” বলে বিপিন পাশ কাটায়।

আজ কিন্তু একটু দেরিই হয়ে গেল ফিনাইলের চক্করে। স্কুল বেশি দূরে নয়। স্কুটিতে মিনিট দশেক। কিছুটা যাওয়ার পরে বিপিন খেয়াল করল, নিজেকে কেমন হালকা-হালকা লাগছে। কী ব্যাপার? আরে, স্কুলব্যাগটাই তো ফেলে এসেছে বাড়িতে! স্কুলব্যাগে টিফিন থাকে, থাকে জলের বোতল। ঘুরে নিয়ে আসবে কি? ঘড়ির দিকে তাকাল বিপিন। অনেকটা চলে এসেছে। বাড়িতে ফিরে ব্যাগ নিতে গেলে খাতায় লাল দাগ পড়ে যাবে।

বিপিন আর ঝুঁকি নিল না। জল-টিফিন এক দিন না হলেও চলে যাবে, স্কুলে ক্যান্টিনের চা-বিস্কুট আছে। কলের জলও খুব খারাপ নয়, ছেলেরা তো ওই জলই খাচ্ছে!

সেকেন্ড পিরিয়ডে স্টাফরুমের চেয়ারে বসে গল্প করছিল ইতিহাসের সাত্যকির সঙ্গে। ফিজ়িক্স নিয়ে পড়েছে বিপিন। কিন্তু ইতিহাস ওর খুব প্রিয়। সাত্যকির পাশে বসলেই ইতিহাস নিয়ে টুকিটাকি কথা হয়। আজ হচ্ছিল নৌবিদ্রোহ নিয়ে। সাত্যকি বোঝাচ্ছিল, কী ভাবে নৌবিদ্রোহ এ দেশে ইংরেজ রাজত্বের কফিনে শেষ পেরেকটি গেঁথে দিয়েছিল। বিপিন জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, প্রতিটি রাজনৈতিক দল নৌবিদ্রোহকে অশোভন, অবাঞ্ছিত, অরাজক ইত্যাদি বিশেষণে দেগে দিল কেন?”

প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই হেডস্যর ঢুকলেন। বিপিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমিও এটাকে অবাঞ্ছিত, অশোভন, অরাজকই বলব। না, নৌবিদ্রোহ নয়। পর পর দু’পিরিয়ড শিডিউলড ক্লাসে না গিয়ে বসে বসে এই আসর গরম করাকে!”

“ক্লাস? আমার!” আকাশ থেকে পড়ল বিপিন। মঙ্গলবারে তো সেকেন্ড পিরিয়ডে ওর ক্লাস নেই! সে তাড়াতাড়ি উঠে রুটিনের কাছে গেল। মঙ্গলবারে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় আমার ক্লাস!”

“তুমি তো মঙ্গলবারে হাত দিয়ে রেখেছ! আজ কি মঙ্গলবার? আজ তো বুধবার!” গমগম করে ওঠে হেডস্যরের গলা।

“আজ বুধ!” আকাশ থেকে পড়ে বিপিন। হে ভগবান! বিরাট ভুল হয়ে গেছে তো! বিপিন চক-ডাস্টার নিয়ে ছুটল ওর এই পিরিয়ডের রুটিন-ক্লাস সেভেন ডি-এর উদ্দেশে।

বাড়ি এসে আজ সব দোষ কিন্তু পড়ল জামাটির উপর। বিপিন ওটা কাচার জন্য ওয়াশিং মেশিনে ফেলল। কালই এই ‘ভুলভুলাইয়া’ জামাটাকে ইস্তিরি চাপিয়ে তুলে রাখতে হবে।

কয়েক দিন পরে ব্যাপারটা নজরে পড়ল লিপির। চারটে জামা নানা কুলক্ষণের চক্করে আলমারি বন্দি হয়েছে। টি-শার্ট পরে স্কুলে যায় না। তাই দুটো জামা-ই পরা চলছিল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। এর মধ্যে একটা জামা ভুল করে একই সঙ্গে ভেজানো একটা গামছার বদান্যতায় ছোপ ছোপ হয়ে গেল সে দিন। ফলে একটা জামা রোজই পরা ছাড়া উপায় রইল না। স্কুল থেকে ফিরে কেচে দেওয়া, আবার পরের দিন সেটি পরে যাওয়া।

সে দিন স্কুলে যাওয়ার আগে আগের দিন কেচে দেওয়া জামাটা শুকিয়েছে কি না, দেখছিল বিপিন। লিপি জিজ্ঞেস করল, “তোমার আর জামা নেই! একটাই রোজ পরে যাচ্ছ!” বলে লাল জামাটা আলমারি থেকে বার করে বিছানায় ফেলল, বলল, “খুব বেশি তো লাল নয়, এটাই পরে যাও!”

বিপিন জামাটা দেখেই বলে উঠল, “রং সমস্যা নয়, এটা পরে গেলে খামোখা লোকের সঙ্গে খুব ঝগড়া হয়ে যায়!”

অবাক হয়ে লিপি বলে, “মানে!”

এত দিনের গোপনীয় সংস্কারের ঢাকনাটা যেন সরে যায়। বিপিন বলে ফেলে, “এটা খুব অলক্ষুনে জামা!”

“অলক্ষুনে! আলমারির আর তিনটে জামাও কি তাই?” লিপি চোখ সরু করে।

বিপিন অসহায় চোখে লিপির দিকে তাকায়।

“এত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন নিয়ে তুমি স্কুলে বিজ্ঞান পড়াও কী করে?”

বিপিন লিপির ভর্ৎসনা চুপচাপ হজম করে যায়। কিন্তু তবু লাল শার্টটা পরে না। কালকের কেচে দেওয়া শার্টটা গলিয়েই রওনা দেয়।

স্কুলে যেতে যেতে কিছুটা আত্মবিশ্লেষণও করে বিপিন। হ্যাঁ, নানা বিষয় নিয়ে একটু-আধটু সংস্কার ওর সত্যিই আছে। পথে জোড়া শালিক দেখলে মন প্রসন্ন হয়, এক শালিক দেখলে অস্বস্তি হয়। ঠাকুর-দেবতা, শুভাশুভ খুব মানে। পোশাকের মতো মানুষেরও পয়া-অপয়া আছে ওর কাছে। যেমন, ওর নীচের ফ্ল্যাটের বাসুদা ওর কাছে মূর্তিমান অপয়া। শুভকাজে গেলে বাসুদা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে টের পেলেই বিপিন চোখ বন্ধ করে নেয়। ঠিক তেমনই উপরের সরখেলবাবুকে বিপিনের বেশ পয়া মনে হয়। খেয়াল করে দেখেছে, যাত্রার সময় উনি সামনে পড়ে গেলে যে কাজে যাচ্ছে সেটা হয়ে যায়।

এই সব সংস্কার তো ওর নিজস্ব ব্যাপার, এর জন্য কারও তো সমস্যা হচ্ছে না! তা হলে? লিপির কথায় এত বড় সংস্কারের রাজ্যপাট ও কি তুলে দিতে পারে! এই সব ভাবতে ভাবতে স্কুটিটা একটু যেন ধীরেই এগোচ্ছিল। কিন্তু স্কুলের কাছাকাছি এসে সিগন্যালের মুখে জোর দিতেই হল গাড়িতে। কারণ সিগন্যাল সবুজ হয়ে আছে অনেক ক্ষণ। লাল হল বলে!

ঠিক এই সময়েই বিপত্তি। একটা বিড়াল ওর সামনে দিয়ে দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে গেল। থেমে যে যাবে সে উপায় নেই। পিছনের সকলেরই তাড়া। বিপিন দাঁড়ালেই পিছনের গাড়ি ওকে ধাক্কা মারবে। পাশেও একফোঁটা জায়গা নেই। অগত্যা খচখচ করা মন নিয়েই বিপিন স্কুটি চালু রাখল।

স্কুলের গেটে ছাত্রদের ভিড় এই সময়টায় রোজই থাকে। তবু স্কুটি চালিয়েই বিপিন গেট পেরোয়। ছাত্ররা স্যরকে যাওয়ার রাস্তা করে দেয় সসম্ভ্রমে। আজও তা-ই করছিল। কিন্তু বেখেয়ালে বিপিনই একটা ছেলের ব্যাগ ঘেঁষে চলে গেল। ছেলেটার ব্যাগে জলের বোতল ছিল, সেটা ঠকাস করে এসে ওর ডান হাতের কনুইয়ে লাগল।

একটু টনটন করলেও আঘাত বড় কিছু নয়। বিপিন আঘাত নিয়ে তত চিন্তিতও হল না। কিন্তু বিড়াল নিয়ে ওর সংস্কারটা জিতে যাওয়ায় আজ বাড়ি ফিরে লিপিকে বলার মতো একটা বিষয় হাতে পেয়ে গেল। এতে একটু যেন খুশিই হল বিপিন।

বিপিন সেন নামের বিজ্ঞান শিক্ষকের অবয়বে যে আদ্যন্ত এক জন সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ বাস করে, সেটা ও যতই নিজেকে সামলে রাখুক, স্কুলে জানে প্রায় সকলেই। এ জন্য টিটিকিরি-টিপ্পনী প্রায়ই ভেসে আসে। সে দিন ক্লাস এইটে সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ পড়িয়ে স্টাফরুমে ঢুকতে ঢুকতেই শুনল, বরদাবাবু ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছেন, “এ মাসের তেরোয় আবার চন্দ্রগ্রহণ। বিজ্ঞান যা-ই বলুক, আমি বাপু গ্রহণ-টহন এখনও মেনে চলি। শুনছি সাড়ে আটটায় গ্রহণ লাগবে। ছাড়বে যখন, তখন বাসনপত্র ধুয়ে রান্নাবান্না করে খেতে অনেক রাত হয়ে যাবে। পরের দিন ইস্কুলে আসতে পারব কি না কে জানে...” বলে বিপিনের দিকে তাকিয়ে এমন একটা হাসি ছুড়লেন যে, বিপিন সারাটা দিন নিষ্প্রভ হয়ে থাকল।

সুনীলবাবু ইলেভেনে ফিলসফি নেন। ওর সামনাসামনি হলেই কাউকে না কাউকে ধরে ওকে শুনিয়ে বলে ওঠেন, “ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি পেলাম আর শিক্ষিত হয়ে গেলাম! শিক্ষিত হওয়া কি এত সহজ! শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষা শব্দটা জোড়া থাকে। সংস্কারে পরিপূর্ণ মানুষ শিক্ষা পায়, দীক্ষা পায় না!”

ছাত্রেরা ওকে টিজ় করার জন্য বা কারও প্ররোচনায় বলে কি না, বিপিন ঠিক জানে না, তবে ওদের বেশ কিছু প্রশ্নের ও প্রায়ই সম্মুখীন হয়, যেগুলো বেশ অস্বস্তিকর। যেমন, “স্যর কাল আমার মাথায় টিকটিকি পড়েছিল। মাথায় টিকটিকি পড়া নাকি ভাল! ওতে কী হয় স্যর?” অথবা, “স্যর, ওঝা কি সত্যিই ভূত ছাড়াতে পারে?” কিংবা, “সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেলে কি পাপ হয় স্যর? তা হলে কি পরীক্ষায় ফেল নিশ্চিত?”

ছাত্রদের ধমক দিয়ে চুপ করানো বিপিনের স্বভাববিরুদ্ধ। খুব সতর্ক ভাবেই ওকে সামলাতে হয় এ সব প্রশ্ন। এই সামলাতে সামলাতে সে দিন একটা প্রশ্নের সামনে ও স্তব্ধ হয়ে যায়। সেভেন ডি-তে সে দিন অণু-পরমাণু বোঝাচ্ছিল। পড়ানো শেষ হয়ে গেলেও কয়েক মিনিট সময় বেঁচেছিল হাতে।

“তোদের কোনও প্রশ্ন থাকলে কর!” বলে বিপিন তাকিয়েছিল সবার দিকে। এই সময় থার্ড বেঞ্চ থেকে একটা ছেলে বলল, “স্যর, পড়ার বাইরে একটা প্রশ্ন করব?”

শঙ্কিত হয়েছিল বিপিন। পড়ার বাইরে প্রশ্ন মানেই ওই ধরনের প্রশ্ন।

“কর!” বলে বিপিন ভুরু কুঁচকে তাকাল ছেলেটার দিকে।

ছেলেটি বলে, “ছেলেপুলে না হলে ঠাকুরের কাছে মানত করলে কি স্যর কাজ হয়?”

মানতের কথাটা ও আর রিনি ছাড়া তো কেউ জানে না! নাকি জানে? রিনি আর ও, যার পরামর্শে কপালী মায়ের কাছে মানত করেছে ক’দিন আগে, সেই সরকার জেঠিমা কি বাইরের কাউকে…

“হঠাৎ এ প্রশ্ন!”

“এক জন বলছিল, তাই!”

মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বানানো কথা। উত্তরের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার হাত থেকে বাঁচাল পিরিয়ড শেষের ঘণ্টা।

“আর এক দিন বলব,” বলে ক্লাসরুম ছাড়ল বিপিন।

পরদিন সকালে রিনিকে আবার বলল কয়েক দিন আগে বলা প্রস্তাবটা, “বাবা-মা মারা গেলে কে আর দায়িত্ব নেয়! দায়িত্ব ছাড়তে পারলে কাকাটা বেঁচে যায়। কাকা, থানা সবাই সহযোগিতা করবে বলেছে, তুমি মত করলেই হয়!”

“কিন্তু ও যে আতিফ শেখ!”

বিপিন হেসে বলে, “শিশুর আবার জাত কী! তবু যদি সমস্যা হয় তোমার, ওকে না-হয় আস্তিক সেন করে নিয়ো! মাত্র কয়েকটা শব্দেরই তো এ দিক-ও দিক! তাতে কিচ্ছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না!”

থানাটা স্কুলের পাশে। প্রাথমিক কথাবার্তার ঢেউ স্কুলে আসতে দেরি হয় না। হেডস্যর অভয় ঘোষ বিপিনকে চেম্বারে ডেকে নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করেন, “কী শুনছি বিপিন? তুমি নাকি ফাইভের আতিফ শেখকে… শেষ পর্যন্ত তুমি এ রকম একটা ডিসিশন নিয়েছ, আমি তো ভাবতেই পারছি না!”

বিপিন হেসে রিনিকে বলা কথাটাই রিপিট করে, “শিশুর আবার জাত কী, স্যর?”

অপুত্রক অভয় ঘোষের মুখে কথা সরে না। শিক্ষিত হয়েও তিনি কেবল মুখেই জাতপাত-সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠেছেন। যে কারণে জন্মপরিচয়হীন কাউকে ঘরে আনার কথা ভাবতেই পারেননি কোনও দিন! আপাদমস্তক কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষটাকে দেখে বিস্ময়ের থেকেও অভয় ঘোষের আজ হিংসে হল বেশি।

করিডরে সুনীলবাবু আজ সাত্যকিকে পাকড়াও করেছেন। বিপিনকে শুনিয়ে সাত্যকিকে বলেন, “সরকারি হোম থেকে নিলে কী জাত কেউ জানতেও পারে না। কত জনই তো দত্তক নিচ্ছে ও সব জায়গা থেকে! কিন্তু জেনেশুনে এমন কাণ্ড কেউ করে! অ্যাঁ! কী কাণ্ড বলুন তো! আরও কী কী দেখতে হবে কে জানে...”

রাতে রিনি বলে, “আমার কিন্তু একটা শর্ত আছে।“

বিপিন বলে, “কী?”

“তোমাকে এই স্কুল থেকে ট্রান্সফার নিতে হবে!”

“সে আর বলতে! এখানে থাকলে আমি কি ওর বাবা হয়ে উঠতে পারব, না কেউ আমাকে সে সুযোগ দেবে!”

আতিফের বাবা হওয়ার সঙ্গে সংস্কারের সদ্ভাব না হলেও বিজ্ঞানের তো কোনও বিরোধ নেই! এ বার কি তবে মনে মনেও একটু বিজ্ঞান শিক্ষক হওয়ারও চেষ্টা করবে বিপিন?

রিনি অবাক হচ্ছে। হোক। পরদিন স্কুলে বেরোনোর আগে লাল রঙের ‘কলহপ্রিয়’ জামাটা গুঁজে আয়নার সামনে দাঁড়ায় বিপিন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Literature story

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}