Advertisement
E-Paper

বাস্তব অনুসারী মায়াজীবনের তত্ত্ব আর ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’

২৫ বছর পূর্ণ করেছে ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ সিনেমাটি। এই কল্পবিজ্ঞান কাহিনি জনপ্রিয় করে তুলেছে বেশ কিছু ধারণা। যেমন, আমরা যেন তরল আধারে ভাসছি, অথবা ‘বাস্তব’ বলে আমরা যা জানি, সবই মায়া, বিভ্রম। বাস্তব নয়, কিন্তু তার মতোই একটি জীবন ও জগতের ধারণা দিয়েছিল অনুকৃতির তত্ত্ব। অতনু বিশ্বাস

কল্পবৈজ্ঞানিক: ১৯৯৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ ছবির একটি অসাধারণ দৃশ্যে কিনু রিভস।

কল্পবৈজ্ঞানিক: ১৯৯৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ ছবির একটি অসাধারণ দৃশ্যে কিনু রিভস।

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৫ ১০:২২
Share
Save

১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় প্রোফেসর শঙ্কুর গল্প ‘আশ্চর্য প্রাণী’। একটি কাচের ফ্লাস্কের মধ্যে সেখানে তৈরি হয়েছে এক মিনি-পৃথিবী, যাতে হয়েছে ‘পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের হাতে তৈরি প্রথম একটি প্রাণীর সৃষ্টি’। যা ক্রমে পরিণত হয় ‘ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর একটি অতি-সংক্ষিপ্ত সংস্করণ’-এ। বহু বার ভেবেছি, কী ভাবে ব্যাখ্যা করব সেই পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির এবং প্রাণের বিবর্তনের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ প্রদর্শনকে। এ কি সত্যি, নাকি মায়া? ফ্লাস্কের ভিতরের ছোট্ট প্রাণীটা, যে রূপ নিল প্রোফেসর শঙ্কু-তে, তার কি চিন্তাশক্তি ছিল? যদি থেকে থাকে, তবে সে কী ভেবেছে নিজের সম্পর্কে, তার পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে? সে কি নিজেকে ‘বাস্তব’ ভেবেছে, না কি বুঝেছে যে সেবানিয়ে-তোলা বাস্তবতার এক রূপ মাত্র? ‘আশ্চর্য প্রাণী’র এই গল্পটা কি আদতে একটা ছোট্ট ‘সিমুলেশন’-এর বর্ণনা?

ভাবনাটা গাঢ়তর হয় গত শতকের শেষ দিকের হলিউড-ছবি, কিনু রিভস অভিনীত ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ দেখে, ২০২৪-এ পূর্ণ হল যার পঁচিশ বছর। হলিউডের কল্পবিজ্ঞানের অনেক ছবিই চিন্তার রসদ জোগায়। তবে আর পাঁচটা ছবির চেয়ে এটি খানিক আলাদা। এটি নাড়া দেয় আমাদের চেতনাকে। আমাদের অস্তিত্বকে এনে ফেলে প্রশ্নের মুখে।

‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ ছবির প্রধান চরিত্র এক কম্পিউটার প্রোগ্রামার, টমাস অ্যান্ডারসন— হ্যাকিংয়ের জগতে যে পরিচিত ‘নিয়ো’ নামে। নিয়ো বাস করে ২১৯৯ সালে, কিন্তু তার বিশ্বাস যে সে আছে ১৯৯৯-তে, এক বানানো জগতের মধ্যে। মানুষকে দাসে পরিণত করার জন্যই যার নির্মাণ হয়েছে একুশ শতকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তিতে। সিনেমাটি জনপ্রিয় করে তোলে বেশ কিছু ধারণা। আমরা যেন তরল আধারে ভাসছি, মানুষই কম্পিউটার ‘রান’ করার মালমশলা এবং ‘বাস্তব’ বলে আমরা যা কিছু জানি, যা কিছু দেখি, সবই মায়া, সবই বিভ্রম।

বাস্তব যে মায়াময়, এ ধারণাটা অবশ্য বেশ পুরনো। যুগ-যুগান্তর ধরে এই দার্শনিক চিন্তাধারার মন্থন হয়ে চলেছে নানা দেশে, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে প্লেটোর ‘রিপাবলিক’-এ ‘অ্যালিগরি অব দ্য কেভ’ বা গুহার রূপকের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে এই ধারণা। প্রাচীন চিনের টেক্সট ‘ঝুয়াংজি’-তে রয়েছে ‘বাটারফ্লাই ড্রিম’-এর গল্প। সেখানে দাওবাদী এক দার্শনিককে এক ব্যক্তি বলে তার স্বপ্নের কথা, বলে সে একটি প্রজাপতি। সে অবশ্য নিশ্চিত হতে পারে না যে, সে সেই মানুষ কি না যে প্রজাপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে, নাকি সে এক প্রজাপতি যে স্বপ্ন দেখেছে মানুষ হওয়ার। ভারতীয় দর্শনে আবার রয়েছে ‘মায়া’র কথা। এমন ধারণা নানা রূপে প্রবাহিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন দেশের দর্শনে। আজকের ধনকুবের ইলন মাস্কের ‘এক্স’ পোস্ট পর্যন্ত তার বিস্তার।

বহু বছর ধরেই কল্পবিজ্ঞান রসদ জুগিয়েছে কম্পিউটার গেম, ভার্চুয়াল জগৎ, এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবয়ব কল্পনা আর নির্মাণে। ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ সিনেমাটির সঙ্গেও ওতপ্রোত জড়িয়ে রয়েছে এক বিশেষ তত্ত্ব, যার নাম ‘সিমুলেশন থিয়োরি’।

‘সিমুলেশন’ যে ঠিক কী বস্তু তা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। ‘সিমুলেশন’ একটি প্রক্রিয়া বা সিস্টেমের অনুকরণীয় উপস্থাপনা, যা বাস্তবজগতে ঘটতেই পারে। বাস্তবে ঘটছে কি না সেটা নয়, এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার বাস্তবানুগতা। যেমন, একটা পয়সা নিয়ে দশ বার ‘টস’ করলে ‘হেড’ ও ‘টেল’-এর যে কোনও একটা সারণি পাওয়া সম্ভব। কম্পিউটারে কাজটা করে পাওয়া যাবে এমনই কোনও সারণি, যাকে আমরা বলতে পারি দশ বার টস করার একটা ‘সিমুলেশন’। আবার পর পর দশটা ক্রিকেট ম্যাচে টসে হেড-টেলগুলো পাওয়া গেল যে পর্যায়ক্রমে, সেটা পর পর লিখে ফেললে আমরা পেয়ে যাব বাস্তবের এমনই একটা সারণি। বাস্তবের যে কোনও তথ্য তাই একটা বাস্তব সিমুলেশন মাত্র। যেমন, অসংখ্য ওঠাপড়া, অগণিত বাঁক সহযোগে একটা মানুষের জীবন চলতে পারে অজস্র পথের যে কোনওটাতে। জীবনের ‘সিমুলেশন’ হল এই অগণন সম্ভাব্য জীবনপথের মধ্যে যে কোনও একটা পথ। একটা রেখামাত্র। বাস্তবজীবন এরই একটা বাস্তব উপস্থাপনা। রিয়েল-লাইফ সিমুলেশন।

আমার-আপনার জীবন তাই এমনই এক-একটা বাস্তব সিমুলেশন। নিশ্চিন্দিপুর-কাশী-কলকাতা, আবার নিশ্চিন্দিপুর— কোনও বাস্তব বাঙালির জীবনে এমনটা ঘটেছে কি না জানা নেই। কিন্তু ঘটা তো সম্ভব, এটা তো বাস্তবানুগ। কিংবা স্বর্গছেঁড়া-জলপাইগুড়ি-কলকাতা, নকশাল আন্দোলনের ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পড়া, মাধবীলতা-স্নিগ্ধ জীবন, এমনটাও বাস্তবানুগ তো নিশ্চয়ই— ঠিক এমনই ছাঁচে যদি কারও জীবন কেটে থাকে তা হলেও, না কাটলেও। অপু কিংবা অনিমেষ তাই ‘সিমুলেটেড’ চরিত্র। বাস্তবানুগ। কিন্তু বাস্তব নয়। তেমনই, শিশুর পুতুল খেলাও কি জীবনের এক সিমুলেশন নয়?

বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়— যেমন রাশিবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, যেখানে প্রচুর তথ্য পাওয়া অসম্ভব কিংবা কঠিন বা ব্যয়সাপেক্ষ অথবা সময়সাপেক্ষ— বাস্তবানুগ সিমুলেশনই পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বিজ্ঞানীদের প্রধান আশ্রয়, বিভিন্ন সম্ভাব্য ফলাফল বুঝতে। সিমুলেশনের মধ্য দিয়ে পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রভাবের হদিস করা হয়, জলবায়ুর পরিবর্তনে ক্ষয়ক্ষতির বিশ্লেষণ করা হয়। এ সব ক্ষেত্রে বাস্তবানুগ পরিস্থিতিকে বার বার তৈরি করা হয় কম্পিউটারের সাহায্যে। কোন পরিস্থিতিতে ধ্বংসের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি, তা দেখতে একাধিক বার চালানো হয় সিমুলেশন।

ফিরে আসা যাক ‘ম্যাট্রিক্স’-এর আবর্তে। সিনেমাটির অন্তর্নিহিত সিমুলেশন তত্ত্বের ক্ষেত্রে ড্যানিয়েল গ্যালউয়ের ১৯৬৪-র উপন্যাস ‘সিমুলাক্রন-৩’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উপন্যাসটিতে মার্কেট রিসার্চের প্রয়োজনে কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে তৈরি করা হয় একটি বিমূর্ত শহর— ভার্চুয়াল সিটি। সেখানকার মানুষজনও সিমুলেশনের নির্মাণ। এবং তাদের রয়েছে চেতনা। কিন্তু কেবল এক জন ছাড়া তাদের কেউই জানে না যে, তারা সিমুলেশন দ্বারা তৈরি।

মোটামুটি মনে করা হয়, ফ্রান্সে দেওয়া ফিলিপ কে ডিক-এর ১৯৭৭-এর একটা বক্তৃতাই রসদ জুগিয়েছে ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ ছবিটির, এবং আধুনিক ‘সিম থিয়োরি’ বা সিমুলেশন তত্ত্বের রূপায়ণের। বক্তৃতাটি আবার তৈরি ‘দ্য ম্যান ইন দ্য হাই ক্যাসল’ এবং ডিক-এর অন্যান্য বইতে বর্ণিত পরাবাস্তবতার ভিত্তিতে। ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ ছবিটি মুক্তির বছর কয়েক পরেই দানা বাঁধে সিমুলেশন তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুসারে, আমরা যে ডিজিটাল বিশ্বে বাস করি, তার মানুষজন কম্পিউটার কোডের সাহায্যে নির্মিত, যার ‘প্যাটার্ন’ পূর্বনির্ধারিত। আমরা ‘বাস্তব’ নই, আমরা এক কম্পিউটার সিমুলেশন জগতের বাসিন্দা।

২০০৩ সালে সাড়া-জাগানো একটি গবেষণাপত্র ছাপান সুইডিশ দার্শনিক নিক বসট্রম। শিরোনাম, ‘আর ইউ লিভিং ইন আ কম্পিউটার সিমুলেশন?’ বসট্রম এখানে যুক্তি দিচ্ছেন, ভবিষ্যৎ দুনিয়ার মানুষদের, অর্থাৎ ‘পোস্টহিউম্যান’দের, নিশ্চয়ই থাকবে অতি-শক্তিশালী সুপারকম্পিউটার, যার সাহায্যে তাদের পূর্বপুরুষদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বাস্তবানুগ অনুকরণীয় উপস্থাপনা বা ‘সিমুলেশন’ চালানো সম্ভব। এমনকি সেই সিমুলেশনের দুনিয়ার কুশীলবদের এক প্রকার কৃত্রিম চেতনা উৎসারিত হওয়াটাও সম্ভব, অনেকটা আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চেতনা সঞ্চারিত হওয়ার মতোই। এই ‘সিমুলেশন’ যেন আমাদের দ্বারা কম্পিউটারের সাহায্যে প্রাচীন রোম, আথেন্স বা উজ্জয়িনীর বাস্তবানুগ চিত্ররূপ তৈরির চেষ্টার মতো।

বসট্রমের যুক্তি প্রবাহিত ত্রিধারায়। এক, ভবিষ্যৎ মানুষ এমন সিমুলেশন করেনি। যার কারণ হতে পারে, প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা কিংবা মানুষের সভ্যতা ভবিষ্যতে কখনও ধ্বংস হয়ে গিয়ে থাকবে এমন সিমুলেশন করার আগেই। দুই, ভবিষ্যৎ মানুষদের সভ্যতা সিদ্ধান্ত নিয়েছে পূর্বপুরুষদের বা প্রাচীন যুগের এমন সিমুলেশন না করার। তিন, আমরা প্রায় নিশ্চিত ভাবেই বাস করছি এমনই কোনও সিমুলেশনের জগতে।

বসট্রম বলছেন, এই তিনটি সম্ভাবনার যে কোনও একটি হওয়াই সম্ভব। এবং আমাদের সত্যিকারের বায়োলজিক্যাল জীব না হয়ে সিমুলেশন-সৃষ্ট মনন হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। যদি ভবিষ্যৎ মানুষদের এক অতি ক্ষুদ্র অংশও এ ভাবে পূর্বপুরুষদের সিমুলেশন করে, তা হলেও এই সিমুলেশন-সৃষ্ট পূর্বপুরুষ— যাদের বলা হয়েছে ‘সিম’— তাদের মোট সংখ্যা সত্যিকারের পূর্বপুরুষদের চাইতে বহু গুণ বেশি হওয়াটাই সম্ভব। সম্ভাবনা-ত্রয়ীর অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে বসট্রম বলেছেন, যদি আমরা এখন সিমুলেশনের মধ্যে বসবাস না করি, তবে আমাদের বংশধররা প্রায় নিশ্চিত ভাবেই পূর্বপুরুষদের সিমুলেশন চালাতে পারবে না।

অন্যান্য দার্শনিকরাও বিস্তৃত করেছেন বসট্রমের যুক্তিকে। ধারণাটির আরও স্পষ্ট ব্যাখ্যা করেছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির কম্পিউটার বিজ্ঞানী রিজ়ওয়ান ভির্ক, তাঁর ২০১৯-এর বই ‘দ্য সিমুলেশন হাইপোথিসিস’-এ, যা বুঝতে সাহায্য করতে পারে এই খরগোশের গর্তের গভীরতা কতটা। ভির্ক বলছেন, ‘বেস রিয়েলিটি’ বা সত্যিকারের বাস্তবতা একটিই, আর বাস্তবের অনুকরণীয় উপস্থাপনা বা ‘সিমুলেটেড রিয়েলিটি’ সংখ্যায় অনেক। যদি ‘বেস রিয়েলিটি’ একটাই হয়, আর ৯৯টি ‘সিমুলেটেড রিয়েলিটি’ থাকে, তা হলে কোন বাস্তবতায় আমাদের থাকার সম্ভাবনা বেশি? নিশ্চয়ই কোনও একটি সিমুলেশন-সৃষ্ট বাস্তবতায়। ইলন মাস্ক ২০১৬-তে বলেছেন, আমাদের বাস্তবের দুনিয়ায় অর্থাৎ ‘বেস রিয়েলিটি’তে থাকার সম্ভাবনা একশো কোটির মধ্যে এক!

মাস্কের তত্ত্ব নিয়ে জমাটি আলোচনা করেছেন নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির দর্শনের অধ্যাপক ডেভিড চ্যালমারস, তাঁর ২০২২-এর বই ‘রিয়েলিটি প্লাস: ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডস অ্যান্ড দ্য প্রবলেমস অব ফিলসফি’তে। এই সম্ভাব্য অতি-বাস্তববাদী সিমুলেশনের জন্য দায়ী উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের এক ভিন্ন মহাবিশ্বের প্রোগ্রামার হিসাবে বর্ণনা করেছেন চ্যালমারস। বলছেন, আমরা যাদের ‘গড’ বলি তারা হয়তো তাই, হয়তো এক ভিন্ন অর্থে। এক কিশোর বা ‘বিরাট শিশু’ হয়তো কম্পিউটার হ্যাক করে ব্যাকগ্রাউন্ডে চালাচ্ছে পাঁচটি মহাবিশ্ব।

এমআইটি-র পদার্থবিদ সেঠ লয়েড আবার সিমুলেশন তত্ত্বকে নিয়ে গিয়েছেন অন্য পর্যায়ে। তিনি বলছেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটাই আসলে একটা প্রকাণ্ড কোয়ান্টাম কম্পিউটার মাত্র। এই বাস্তবতা যদি সিমুলেশন-সৃষ্টই হয়, তা হলে তার গতিপ্রকৃতি কি বদলানো সম্ভব? আমরা কি ‘হ্যাক’ করতে পারি এই কম্পিউটার প্রোগ্রামকে? এমন আকর্ষণীয় প্রশ্ন করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে-র কম্পিউটার বিজ্ঞানী ডেভিড অ্যান্ডারসন।

বাস্তবে হয়তো ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ ছবিটি থেকে উৎসারিত সিমুলেশন তত্ত্ব আরও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে আজকের দিনে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যখন ডানা ঝাপটাচ্ছে অস্থির ভাবে। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় পূর্ণমাত্রায় হাবুডুবু খেতে থাকা মেটাভার্সের যে দুনিয়া তৈরি করতে চেয়েছেন মার্ক জ়ুকারবার্গ, সেটাও হয়তো এ থেকে অনেকখানি অনুপ্রাণিত। প্রকারান্তরে সেও হয়তো ম্যাট্রিক্সেরই দুনিয়া।

সিমুলেশন তত্ত্বের বিরুদ্ধেও যুক্তি সাজিয়েছেন বহু বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক। অনেকেই যেমন বলেন যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে সিমুলেশন দ্বারা তৈরি করার মতো গণনার ক্ষমতা, বিদ্যুৎশক্তি অর্জন করা কঠিন। একটা আকর্ষণীয় যুক্তি দিয়েছেন পদার্থবিদ মার্সিলো গ্লেইজ়ার। বলছেন, ভবিষ্যতের মানুষ বা পোস্টহিউম্যান এতই উন্নত হবে যে তাদের কাছে অতীত সম্পর্কে থাকবে যথেষ্ট পরিমাণে তথ্য; সিমুলেশন দ্বারা বিশ্বসংসার সৃষ্টি তাদের কাছে হবে সময়ের চূড়ান্ত অপব্যবহার। এ সব করার কোনও কারণ তাদের থাকবে না।

বহু মানুষই বিশ্বাস করেছে সিমুলেশন তত্ত্ব। রডনি অ্যাশার পরিচালিত ২০২১-এর তথ্যচিত্র ‘আ গ্লিচ ইন দ্য ম্যাট্রিক্স’-এর কথা উল্লেখ করতেই হবে এ প্রসঙ্গে। সেখানে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে সাংবাদিক এবং দার্শনিক-সহ বিভিন্ন পেশার কিছু মানুষের, যাঁরা বিশ্বাস করেন, আমরা সিমুলেশন-সৃষ্ট দুনিয়ার পুতুলমাত্র।

মূল প্রশ্নটা কিন্তু অমীমাংসিতই থেকে যায়। জগতের এই আনন্দযজ্ঞটাই শঙ্কুর ‘আশ্চর্য প্রাণী’র মতো বানিয়ে তোলা এক পুতুল খেলা কি না, সেই জটিল ধাঁধাটাই থেকে যায় অধরা। আমাদের বর্তমানের সঞ্চিত জ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়ে সিমুলেশন তত্ত্বকে নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ কিংবা অপ্রমাণ, কোনওটাই যে করা সম্ভব নয়।

কিন্তু তত্ত্বটা যদি ঠিক হয়, তবে কি আমাদের জীবনসংগ্রামের পুরোটাই অর্থহীন হয়ে যায় না? হয়তো তা-ও নয়। ইলন মাস্ক তো ব্যাট করেছেন এই তত্ত্বের পক্ষে। কিন্তু মাস্ক কি এ গ্রহের শীর্ষস্থানীয় ক্যাপিটালিস্ট নন? তিনি কি দুরন্ত গতিতে ছুটছেন না আরও সম্পদের অভীপ্সায়? না কি, পুরোটাই একটা আলট্রা রিয়েলিটি? ওই যে, ‘সে’-তে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “যে রশ্মি বেগ্‌নির সীমা পেরিয়ে গেছে তাকে দেখা যায় না ব’লেই সে মিথ্যে নয়, সেও আলো। ইতিহাসের সেই বেগ্‌নি-পেরোনো আলোতেই মানুষের সত্যযুগের সৃষ্টি। তাকে প্রাগৈতিহাসিক বলব না, সে আলট্রা-ঐতিহাসিক।” এ কি অনেকখানি সে রকমই?

সত্যিই তো! ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’, নিক বসট্রম, সিমুলেশন তত্ত্ব, ইলন মাস্ক, কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা, সব অতিক্রম করেও এটা অবশ্যই সম্ভব যে, আমরা বাস করি যাকে বলে ‘বেস রিয়েলিটি’ সেখানে। কিংবা আমরা যে দুনিয়ায় বাস করি তা-ই আমাদের কাছে ‘বেস রিয়েলিটি’। যেমন, প্রোফেসর শঙ্কুর কাছে তাঁর জীবন, তাঁর পারিপার্শ্বিকই তাঁর ‘বেস রিয়েলিটি’। আশ্চর্য ফ্লাস্কের অভ্যন্তরে ক্রমবিবর্তিত হতে থাকা প্রাণীটা— যে হয়ে যায় শঙ্কুরই প্রতিরূপ— তার যদি খানিক চেতনা থেকে থাকে, তবে তার কাছে তার ফ্লাস্কটা, সেখানকার পরিবেশ, চরম একাকিত্ব-সহ তার নিজের স্থায়িত্বটাই হয়তো ‘বেস রিয়েলিটি’। কে জানে! ওই যে, ‘হলদে পাখির পালক’-এর শেষ লাইনে লীলা মজুমদার লিখেছেন, “সত্যি যে কোথায় শেষ হয়, স্বপ্ন যে কোথায় শুরু হয় বলা মুশকিল।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Science Science Fiction

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}