পেন্টহাউস। আনন্দ স্টুডিয়ো। মুম্বই। ১৯৯২ সাল।
সবে বিদেশ থেকে ফিরেছেন শ্যুটিং শেষ করে। বিশাল মেহগনি রঙের সোফায় বসে দেব আনন্দ।
কলকাতার সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে দেবের কণ্ঠে তখন শুধুই কিশোরকুমারের প্রশংসা। তা হলে দেবের সেরা ছবি ‘গাইড’-এ কেন কিশোরকুমারের ‘গাতা রহে মেরা দিল’ ছাড়া বাকি সব গানেই মহম্মদ রফি?
প্রশ্নের উত্তরে দেব হাসলেন। বললেন, “আমি চেয়েছিলাম, সব গানই কিশোরকে দিয়ে গাওয়াতে। কিন্তু সুরকার (শচীন দেববর্মন) অন্য রকম ভেবেছিলেন। উনি জানতেন ‘গাইড’-এর জন্য যেমন ধরনের সুর করেছেন, তা সার্থকতা পাবে রফির কণ্ঠেই।”
“রফিসাব এমন একজন গায়ক, যাঁর গানকে স্বরলিপি দিয়ে ধরা যায় না,” মনট্রিয়ল থেকে জানালেন কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। কেন? “ওঁর গলায় সাঙ্ঘাতিক একটা রেঞ্জ। তার সঙ্গে মসৃণ একটা ধাঁচ। গানে কোনও অনভূতি প্রকাশ করার সময়, যখন এক নোট থেকে আর এক নোটে যেতেন, মনে হত, তাঁর কণ্ঠ যেন ভেসে চলে যাচ্ছে। ধরুন, ‘হাম দোনো’ ছবির ‘কভি খুদপে’ গানটার কথা। কেউ যদি রাগাশ্রয়ী গানে পারদর্শী হন তিনি বড়জোর স্বরলিপি করতে পারবেন। কিন্তু গায়কির মধ্যে কোন সময়ে ইনফ্লেকশন আর গ্রেস নোট ব্যবহার করতে হবে, সেটা বোঝাটা খুব মুশকিল। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারদর্শী হলেও একজন গায়কের যদি রোম্যান্টিক অনভূতি এবং রফি সাবের মতো গলার সূক্ষ্ম আন্দাজ না থাকে, সে শুধুমাত্র ভাসা-ভাসা ভাবে গান পরিবেশন করতে পারবে। গানের আসল নির্যাসটা তাতে প্রকাশ পাবে না।” তাই কিশোর-কণ্ঠী পাওয়া যায় অসংখ্য, কিন্তু রফি-কণ্ঠী সংখ্যা হাতে গোনা।
মুম্বইয়ে সে বার সামনে শাম্মি কপূর। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, “রফি সাব না থাকলে কি এতটা সফল হতেন আপনি?”
মেহবুব স্টুডিও। পাহাড়প্রমাণ সাইজের একটি সোফায় বসে আছেন শাম্মি। অনিল কপূর-শ্রীদেবীর ‘হীর রঞ্ঝা’ ছবির শ্যুটিং চলছে। ঘণ্টা খানেক পরে ডাক আসবে শাম্মির।
শুরুতেই চমকে দিলেন প্রশ্নকর্তাকে। বললেন, “রফি আর শাম্মিকে আলাদা করা যায় না। উই ওয়্যার মেড ফর ইচ আদার।”
সে দিন শাম্মি অকপটে স্বীকার করেছিলেন, “আমার সাফল্যের পিছনে রফিসাবের অবদান বিশাল। ‘তুমসা নহি দেখা’ থেকে ‘আন্দাজ’— আমার যে-কোনও ছবির গানে রফিসাব তাঁর সেরাটা দিয়েছেন।”
ফেলে আসা দিনে ফিরে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, রেকর্ডিংয়ের দিন রফিসাব তাঁকে ডেকে নিতেন স্টুডিয়োয়। দু’জনের মধ্যে গান নিয়ে আলাপ-আলোচনা হত।
কী রকম? ‘কাশ্মীর কি কলি’র ‘তারিফ করু কেয়া উসকি’ লাইনটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন শাম্মি। রাজিও হয়ে গেলেন রফিসাব। কিন্তু সুরকার ও পি নায়ার নারাজ। “অনেক কষ্টে তাঁকে রাজি করালাম দু’জনে, তার পরেরটা তো ইতিহাস। পিকচারাইজেশনের পরে আমাকে জড়িয়ে ধরে নায়ার বলেছিলেন, “আরে ভাই, তুমলোক তো কমাল কর দিয়ে।”
গানের দৃশ্যে কোন নায়ক কখন কী করবেন, এই বাপারে রফির আন্দাজ ছিল বিস্ময়কর, বলছিলেন শাম্মি। “আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়। কোন দৃশ্যে আমি কখন লাফ দেব, কখন শুয়ে পড়ব, বা কখন মাথা ঝাঁকাব, এ সব ব্যাপারে ওর আন্দাজ শতকরা একশো ভাগ নিখুঁত ছিল। আমাকে বিশেষ কিছু বলতে হত না।”
দুই মহারথী
বাংলার আর এক গায়ক রাঘব চট্টোপাধ্যায় কী বলছেন শুনে নেওয়া যাক। “কিশোরকুমার শুধু গায়ক নন। তিনি নায়ক-গায়ক-সুরকার সব। তাঁর বহুমুখী এবং বিস্ময়কর প্রতিভা। কিন্তু মহম্মদ রফি আউট অ্যান্ড আউট একজন গায়ক। রাগাশ্রয়ী গানে তিনি অনবদ্য। তাঁকে আমি গায়কের গায়ক বলব। কিশোরের গান জেনারেল। রফি তালিম নেওয়া একজন গায়ক। ফলে তাঁর গাওয়া গানের জন্য যে সুর, তাল, ছন্দের দরকার হয়, সেটা রীতিমতো চর্চা না করলে গাওয়া সম্ভব নয়, ” মন্তব্য রাঘবের।
মুম্বইবাসী আর এক বাঙালি গায়ক, অভিজিৎ কী বলছেন? ছোটবেলায় তিনি ভাবতেন রেডিয়ো মধ্যে রফিসাব বসে আছেন। আর ওখান থেকেই গান গাইছেন। “তখনও কিশোরদার গান শুনিনি। রফিসাবের গান না শুনলে আমি কিশোরদার ফটোকপি হতাম। কিশোরদার ‘স্যাডনেস’ আর রফিসাবের ‘সফটনেস’, কিশোরদার ঘরানা, রফিসাবের টাচ— সব মিলিয়েই আমি গাইতে চেষ্টা করি। আমার উপরে রফিসাবের ইনফ্লুয়েন্স আছে। আজকেও যত বার ভাল গান শুনি, তত বারই মনে হয়, মিউজিক মানেই রেডিও, মিউজিক মানেই মহম্মদ রফি।”
৩১ জুলাই সকাল থেকে টেলিভিশনের নানা চ্যানেলে এখনও বাজে রফির গান। তাঁর সেই রাজকীয়, অনন্য কণ্ঠস্বরের অবিরাম মণিমুক্তো বর্ষণেও চাপা থাকে না কত শ্রোতার হৃদয় ফুঁড়ে উঠে-আসা মাত্র ৫৪ বছর বয়েসে অকালে তাঁকে হারানোর বেদনার হাহাকার।
মিউজিক হোক কিংবা নিউজ চ্যানেল— তাঁর প্রয়াণদিবসে সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত মহম্মদ রফির জাদুকণ্ঠের স্বর্ণালি গানের সম্ভার একটিই কি বার্তা বয়ে আনে না তাঁর শ্রোতাদের কাছে? চলে যাওয়ার ৩৫ বছরেও একদা বলিউডের ভরসা মহম্মদ রফি কী ভাবে ডটকম শাসিত এই একুশ শতকেও জীবন্ত থাকেন তাঁর শ্রোতাদের মননে, স্মৃতিতে, ফেলে আসা দিনে?মস্তি চ্যানেলের ‘গোল্ডেন এরা উইথ অন্নু কপূর’-এর অনুষ্ঠান হোক কিংবা ‘লভ কাল আজ ঔর কাল’ অনুষ্ঠান। অথবা মিউজিক ইন্ডিয়া বা সোনি মিক্সের মতো চ্যানেলে ঘুরে ফিরে প্রতিদিনই নিয়ম করে নানা সিনেমার দৃশ্যে শোনানো হয় রফির গান।
আজও যে-কোনও রিয়্যালিটি শো-এ তাঁর গান ঘুরেফিরে উঠে আসে ।
প্রতিযোগীদের কণ্ঠে। জি টিভি-র ‘সা-রে-গা-মা-পা’র মহামঞ্চে এই সে-দিন বাংলার অনীক ধরকে জড়িয়ে ধরেছিলেন সুরকার হিমেশ রেশমিয়া। দর্শকাসনে তখনও চলছে হাততালির ঝড়। সবে অনীক শেষ করেছেন ‘কেয়া হুয়া তেরা বাদা’ গানটি। “মেরা ভি ফেভারিট গানা হ্যায় ইয়ে”, দর্শকদের দিকে তাকিয়ে এই মন্তব্য করার সময় হিমেশের মুখেচোখে কেবলই মুগ্ধতা। এই গানটির জন্যই ১৯৭৭-এ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন মহম্মদ রফি। সঙ্গে আরও একটি সর্বভারতীয় শিরোপা।
কত বড় গায়ক ছিলেন মহম্মদ রফি?
স্টুডিওয় তৈরি করা সিমলা শহর। রাতবিরেতে যৌবনের দূত সুদর্শন দেব আনন্দ খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁর প্রেমিকার বাড়ি। দেবের ঠোঁটে গান। ‘তু কহাঁ ইয়ে বাতা, ইস নসিলি রাত মে’।
নেপথ্য গায়কের সুরেলা এবং দরদী কণ্ঠের মর্মস্পর্শী আকুলতায় পর্দা জুড়ে উপচে পড়ছে নায়কের বিরহ। গানের প্রতিটি শব্দের সঙ্গে সঙ্গে।
“‘তেরে ঘর কে সামনে’ ছবির দৃশ্যটি মনে আছে তো? সুুপারহিট ছবির সুপারহিট সব গান! বিশেষ করে ভৈরবী রাগে ‘শুনলে তু দিল কে সদা’। বার বার শুনলেও যেন মন ভরে না। যেমন যোগ্য গায়ক, তেমনই যোগ্য সুরকার।” মত ছিল সঙ্গীত-বিশেষজ্ঞ রাজু ভারতনের।
অথচ হিন্দি সিনেমায় সেরা গায়কের বিতর্কে রফি বনাম কিশোরকুমারকে নিয়ে চায়ের কাপে তুফান তুলে দেবে বাঙালি। রফির তুলনায় কিশোরের কণ্ঠ অনেক গমগমে, অনেক তাজা। ‘ফ্ল্যামবয়ান্ট’ গায়ককে নিয়ে বেশির ভাগ বাঙালি গর্বিত। যদিও তাঁর জন্ম খান্ডোয়ায়, বাংলা লিখতে পড়তে জানতেন না। কিন্তু তিনি তো ভাত-মাছ-রসগোল্লা খাওয়া বাঙালি। হিন্দি সিনেমার গানে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব এবং দক্ষতা নিয়ে কোনও চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়তে চায় না এই জাতি। কিশোরকুমারের সঙ্গে তুলনায় রফি? এক কথায় খারিজ হয়ে যাবেন। রফি বাঙালির চোখে বহু যোজন দূরে।
বাবুল সুপ্রিয়র মতে, “বলিউডে এক নম্বর গায়কের নাম কিশোরকুমার। তবে কিশোরকুমার আর রফির মধ্যে তুলনা করতে হলে আমি বলব, সন্দেশ আর রসগোল্লার মধ্যে কি তুলনা হয়? যাঁরা গান করেন, তাঁদের বলব, দু’জনের গান থেকেই আনন্দ নিন।”
সবাই জানেন বলিউডের স্বর্ণযুগে মুকেশ ছিলেন রাজ কপূরের প্রিয় গায়ক। মনোজকুমারের প্রথম পছন্দের গায়কও তিনি। তার পরে মহেন্দ্র কপূর। দেব আনন্দের যেমন কিশোর। কিন্তু ১৯৪৮-৬৮, এই কুড়ি বছরে রফি ছিলেন বাকি নায়কদের সাফল্যের টেক্কা। রাজু ভারতনের মতো হিন্দি সিনেমার গানের বিশেষজ্ঞের মতে, রফি ছিলেন ‘মোস্ট কমপ্লিট সিঙ্গার’। রাগাশ্রয়ী থেকে ভজন, রোম্যান্টিক থেকে গজল, হিপহপ থেকে রক-অ্যান্ড-রোল থেকে কাওয়ালি বা ডিস্কো। এবং আরও অনেক কিছু।
মুম্বই আসার পরে শুরু হয়েছিল তাঁর অগ্নিপরীক্ষা। বান্দ্রার ভেন্ডি বাজার থেকে রোজ সকালে হেঁটে চলে আসতেন দাদারে। তার পরে এক দিন কারদার স্টুডিয়োয় প্রবাদপ্রতিম সুরকার নৌশাদের দেখা পেলেন।
লম্বা রেসের ঘোড়াটিকে চিনতে ভুল হয়নি কিংবদন্তি সুরকারের। ‘পহলে আপ’ ছবিতে ‘হিন্দুস্তান কে হম হ্যায়’ গান দিয়ে তাঁর কদম কদম চলা শুরু হয়েছিল স্বপ্ননগরীতে। ‘আনমোল ঘড়ি’ ছবিতে রফির গাওয়া ‘তেরা খিলোনা টুটা বালক’ তাঁকে জায়গা করে দিয়েছিল বলিউডে।
স্ত্রীর সঙ্গে
আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৪৮-এ ‘দুলারি’ ছবিতে রফি গাইলেন এমন এক গান যা আজও আধুনিক, আজও অমলিন। ‘সুহানি রাত ঢল চুকি, না জানে তুম কব আওগি’। মনে আছে নায়কের নাম? গীতিকারের নাম? সেই প্রথম এক জন গায়কের অলরাউন্ড দক্ষতা সম্পর্কে আভাস পেল বলিউড। অনুভব করল, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সুরের উপরে সেই গায়কের বিস্ময়কর নিয়ন্ত্রণ।
“ওর মধ্যে আগুন ছিল, ধৈর্য ছিল, ছিল নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ”, একবার মন্তব্য করেছিলেন নৌশাদ।
যা সার্থকতা পেয়েছিল ১৯৬৩ সালে লন্ডনের স্কালা থিয়েটারে জলসার পরে। রফির গানের অনুষ্ঠান শেষে এক অন্ধ শ্রোতা এসে তাঁকে বলেছিলেন, ‘যত দিন আমার কান শুনতে পাবে আপনার গান, তত দিন এ জগতে আমার চোখের প্রয়োজন হবে না’।
মহম্মদ রফিকে ‘তানসেন’ বলে ডাকতেন রবীন্দ্র জৈন। নৌশাদই তাঁকে তানসেন তৈরি করেছিলেন। ‘বৈজু বাওরা’ ছবির পরে সব সুরকারের প্রথম পছন্দের তালিকায় শীর্ষস্থানে মহম্মদ রফি। রফি-নৌশাদ রাগাশ্রয়ী গানে একে অপরের পরিপূরক। ‘উড়ন খটোলা’ ছবিতে “ও দূরকে মুসাফির’ গানটি বার-কুড়ি রিহার্সাল দেওয়ার পরেও ফাইনাল টেকের আগে আরও এক দিন সমানে ঝালিয়ে নিলেন। কারণ ওই গানটিই ছিল দিলীপকুমারের ওই হিট ছবির প্রাণভোমরা। তার পর কী হয়েছিল শ্রোতারা জানেন। রফি-নৌশাদ যুগলবন্দিতে বলিউড পেয়েছে ১৭৯টি চিরকালীন গান। তাই বারবার শুনলেও কখনও পুরনো হবে না ‘বৈজু বাওরা’ ছবির দরবারি রাগে গাওয়া ‘ও দুনিয়া কে রখওয়ালে’ (এমন হাই স্কেলের গান কে কবে গেয়েছেন বলিউডে), মালকোষে হরিভক্তদের আপ্লুত করে দেওয়া ‘মন তড়পত হরি দর্শন কো আজ’। “রফি ছিল আমার আত্মা’, মন্তব্য করেছিলেন নৌশাদ। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে রফি ছুটতেন। বড় পর্দার জন্য মোট ৪৭০০টি গান গেয়েছিলেন তিনি।
শুধু নৌশাদই নন, শঙ্কর-জয়কিষেণ বা ও পি নায়ারের সেরা অস্ত্রের নামও ছিল মহম্মদ রফি। এস-জে জুটির সুরে রফি গেয়েছেন মোট ৩৭৩টি গান। প্রায় সব গান শুধু হিট তা-ই নয়, চিরসবুজ এ সব গানের কোনও ‘এক্সপায়ারি ডেট’ নেই। বলিউডে লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলাল জুটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তাঁর ঈশ্বরদত্ত কণ্ঠ। ‘পরশমণি’ বা ‘দোস্তি’ ছবির সাফল্যের পিছনে ছিল কেবলই রফির গান। এই জুটির সুরে তিনি গেয়েছিলেন ৩৪৬টি গান।
দেব আনন্দের ছবির জন্য ১৯৪৭-৫৬ রফি ডাক পাননি শচীনকর্তার কাছ থেকে। দেব আনন্দের ছবি ওই সময় কিশোরময়। তার আগে বর্ষীয়ান সুরকার রফিকে সুযোগ দিয়েছিলেন গুরু দত্তের ‘কাগজ কে ফুল’ এবং ‘পিয়াসা’ ছবিতে। গোল্ডি আনন্দের অনুরোধে ‘নও দো গ্যায়ারা’ ছবিতে রফিকে ডাক দিলেন শচিনকর্তা।
রফি এলেন এবং জয় করলেন দেবভক্তদের হৃদয়। দেবের ঠোঁটে কিশোরের কণ্ঠে গান শুনতে অভ্যস্ত শ্রোতারা শুনলেন অসম্ভব এক মিষ্টি গান— ‘ও আজা পঞ্ছি অকেলা হ্যায়’। আর কী আশ্চর্য রফির জন্যই কিনা কে জানে, কিশোরও ওই ছবিতে দুরন্ত— ‘আঁচলে মে কেয়া জি’, অসম্ভব মেলোডিয়াস।
এর পরে দেব আনন্দের ‘কালাপানি’, ‘কালা বাজার’, বোম্বাই কা বাবু’ ‘তিন দেবিয়াঁ এবং ‘গাইড’ ছবিতে রফির জাদুকণ্ঠ এমন এমন সব গান শ্রোতাদের উপহার দিল, যা আজ কেবলই ইতিহাস। ‘চলে গয়ে হম বেখুদি মে তুম কো পুকারে’, ‘খোয়া খোয়া চাঁদ’, ‘সাথী না কোই না কোই মঞ্জিল’ ‘কেয়া সে কেয়া খো গয়া’, ‘দিন ঢল জায়ে হ্যায়’,— এ সব গান চিরকালীন আসন পেয়েছে বলিউডের স্বর্ণযুগের আর্কাইভে।
তখন সেল ফোন, কম্পিউটার কেবলমাত্র কল্পবিজ্ঞানে। রফির যুগ মানেই চিঠি লেখার যুগ, রেডিয়োর যুগ। সেরা বিনোদন বলতে ছায়াছবি। সেই যুগে নায়িকার জন্য বিরহী নায়কদের যাবতীয় দুঃখকষ্ট গানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে, শ্রোতা এবং দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করার মতো এমন গায়কি অন্য কোনও গায়ক দেখাতে পেরেছেন কি? দিনের পর দিন? বছরের পর বছর? রফিসাবকে অনন্য গায়ক বলতে কি এর পরেও দ্বিধা থাকবে? প্রশ্ন তোলেন তাঁর ভক্তরা।
প্রায় বিশ বছর ধরে ঠিক কোন জায়গায় রফি এগিয়ে ছিলেন তাঁর সমসমাময়িক গায়কদের থেকে? বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত উষা খন্না। এই ৭০ বছর বয়সেও তাঁর কণ্ঠস্বর তাক লাগিয়ে দেয়। ল্যান্ডফোন নিজেই তুলেছিলেন। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি, “একটা কথা বলি, কিশোরকুমার, মুকেশ, মান্না দে, মহেন্দ্র কপূর বা তালাদ মাহমুদ সবাই ‘গ্রেট সিঙ্গার’। প্রত্যেকে ‘আপনা আপনা স্টাইল মে গাতে থে’। কিন্তু রফিসাব ‘ওয়াজ স্পেশ্যাল। আ জিনিয়াস’, সেন্ট ফ্রম দ্য হেভেন বাই গড’।”
উষার মতে, আবেগ, মাদকতা, স্বরক্ষেপণ, বিশুদ্ধ উচ্চারণ, এবং সিচ্যুয়েশন অনুযায়ী গান গাওয়ার দক্ষতায় সবার আগে ছিলেন রফি। “গান গাওয়ার স্টাইলে ‘কোই ভি অ্যায়সা গা নহি সকতা’। যেমন ডিমান্ড করতাম, হুবহু বা তার থেকেও ‘বড়িয়া’ গাইতেন। সাধে কী আর বলছি, ‘হি ওয়াজ স্পেশ্যাল’। মাত্র ১৬ বছর বয়সে উষা সুর দিয়েছিলেন তাঁর প্রথম ছবি ‘দিল দেকে দেখো’-তে। মোট ১২টি গানের সবই হিট। শাম্মি কপূর-আশা পারেখ জুটির এই ছবি সুপারডুপার হিট হয়।
“এখনও যদি শোনেন ‘প্যার কি কসম সে না দেখো প্যার সে’, তা হলে বুঝতে পারবেন এমন মেলোডিয়াস ভয়েস হিন্দি ছবিতে আর আসেনি। সুরে তো সবাই গায়। কিন্তু গানের মধ্যে এমন ‘জান’ দিয়ে দিতে কাউকে দেখিনি।” আর কী গুণে রফিকে এগিয়ে রাখছেন? হেসে ফেললেন উষা। “আর কিতনা বলু?” এটাই শেষ প্রশ্ন। “গানের দৃশ্যে নায়কের শরীরী ভাষার সঙ্গে নিজের কণ্ঠস্বর এমন ভাবে মেশাতেন মনে হত, ওই গান গাইছেন নায়কই। জনি ওয়াকার হলেও।”
‘আরাধনা’ পরবর্তী যুগে কিশোরকুমার-আর ডি বর্মনের দাপটে রফি যখন বেশ কোণঠাসা, তখনও থেমে থাকেনি রফির কণ্ঠ। তাঁকে গানভিক্ষা করতে হয়নি কখনও কোনও সুরকারের দরজায়। কিশোরকুমারের সেরা দিনেও রফি বলিউডে আবার ফিরে এলেন উষা খন্নার সুরে ‘হাওয়াজ’ ছবির ‘তেরে গলিয়োঁ মে না রাখেঙ্গে কদম আজ কে বাদ’ গানের মাধ্যমে। তার পরে আবার হিটের পর হিট। ‘কেয়া হুয়া তেরা বাদা’, বা ‘পর্দা হ্যায় পর্দা হ্যায়’-এর মতো ধুঁয়াধার সব গান গেয়েছেন এই সময়ে।
শুধু নায়কই নন, গায়কের জন্যও গান করেছেন রফি, ‘শরারত’ আর ‘রাগিনী’ ছবিতে তিনি গান গেয়েছেন কিশোরের ঠোঁটে। রাগিনী ছবির রাগাশ্রয়ী ‘মন মোরা বাওরে” গাইতে হয়েছিল রফিকেই।
আদ্যন্ত পারিবারিক ছিলেন রফি। সঙ্গীত, সাত সন্তান আর স্ত্রীর বাইরে তাঁর অন্য কোনও জগৎ ছিল না। সপ্তাহান্তে লোনাভালায় তাঁর বাগানবাড়িতে চলে যেতেন সপরিবার। সেখানে সুইমিং পুলে সাঁতার কেটে, ব্যাডমিন্টন খেলে, ঘুড়ি উড়িয়ে গোটা দিন কাটিয়ে দিতেন। আর বিদেশ ভ্রমণ করতেন। গানের জলসার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন গোটা দুনিয়া। আদ্যন্ত মার্জিত, অজাতশত্রু রফি ছিলেন সবার প্রিয়। প্রিয় বন্ধু মুকেশের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অসুস্থ শরীরে হাসপাতালে শুয়ে থাকা রফি দৌড় দিয়েছিলেন শশ্মানঘাটের দিকে।
চাননি তাঁর সন্তানেরা গান নিয়ে মাতামাতি করুক। তিনি জানতেন এই দুনিয়ায় সফল হওয়া সবচেয়ে কঠিন কাজ। মেজ ছেলে শহিদের গায়ক হওয়ার বাসনায়। জল ঢেলে দিয়েছিলেন। সবাইকে ব্যবসাবাণিজ্যে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ঠিকই করেছিলেন। না হলে ছেলেদের হয়তো সারা জীবন বাবার সঙ্গে তুলনার পিছিয়ে থাকার সমালোচনায় সংকুচিত হয়ে থাকতে হত!
মান্না দে-কে ফোন করে মহম্মদ রফির মৃত্যুসংবাদ জানিয়েছিলেন সুরকার নৌশাদ। বলেছিলেন “আজ সাত সুর সে এক সুর চলা গয়া।”
গায়ক হিসেবে সারা জীবনে মান্না দে-র ওই একটাই আফসোস। যদি মহম্মদ রফির মতো গানটা গাইতে পারতাম। বারবার বলেছেন, বলিউডে রফি এক নম্বরে, কিশোর দু’নম্বরে আর তিনি তিন নম্বরে। “যখনই মহম্মদ রফির গান শুনি, তখনই মনে হয় ওর থেকে সর্বোত্তম গায়ক আর হয় না। যে-কোনও দিন ও সবার থেকে আগে।”
পাশে দিলীপকুমার
সাক্ষাৎকারে এমন স্বীকারোক্তি করতে দু’মিনিট ভাবেননি মান্না দে। যিনি নিজে ‘সুর না সাজে’ বা ‘পুঁছো না ক্যায়সে ম্যায়নে রয়েন বিতাই’র মতো গান গেয়েছিলেন।
রফি কেন কালোত্তীর্ণ?
বেশ কয়েক বছর আগে একটি সর্বভারতীয় পত্রিকা একটা সার্ভে করেছিল। গত ৭৫ বছরে বলিউডে সেরা ৩০টি গান। এই কঠিন কাজটির দায়িত্বে ছিলেন প্রায় ৩০ জন নামকরা গায়ক-সুরকার-গীতিকার এবং সঙ্গীত সমালোচক।
কোন গানটিকে সেরা হিসেবে বাছা হয়েছিল জানেন কি?
‘চিত্রলেখা’ ছবিতে রোশনের সুরে রফির গাওয়া সেই বিখ্যাত গানটি কি আপনার মনে আছে? ‘মন রে তু কাহে না ধীর ধারে’। মনে আছে? ঠিকই ধরেছেন, সর্বোত্তম গান হিসেবে বিচারকদের সর্বাধিক ভোট নির্বাচিত করেছিল ওই গানটিকেই। আর দ্বিতীয় সেরা গান? ‘গাইড’ ছবির ‘তেরে মেরে সপ্নে আব এক হি রং হ্যায়’। ভাবা যায়? এর পরেও তাঁকে কালোত্তীর্ণ, বলিউডের সর্বকালের সেরা বলতে দ্বিধা করবেন?
২০০১-এ ‘ঘোস্ট ওয়ার্ল্ড’ ছবির সাউন্ডট্র্যাকে ব্যবহার করা হয়েছিল ‘গুমনাম’-এর সেই বিখ্যাত গানটি ‘জান পহেচান হো’। গায়কের নাম? মহম্মদ রফি। ‘মনসুন ওয়েডিং’ ব্যবহার করেছিল ‘লোফার’ ছবিতে রফির গাওয়া ‘ও আজ মওসম বড়া বেইমান হ্যায়’ গানটি।
মনে আছে ‘পিয়াসা’ ছবির সেই বিখ্যাত গান— ‘ইয়ে দুনিয়া অগর মিল ভি জায়ে তো কেয়া হ্যায়’? ২০০৯-এ ‘গুলাল’ ছবির থিম সং হিসেবে রফির এই গানটি রিমিক্স করে ব্যবহার করা হয়েছিল। শুধু এই-ই নয়, রফির গাওয়া ১৬টি গান নিয়ে ‘সিটি অব বার্মিংহাম সিমফনি অর্কেস্ট্রা’ রিলিজ করেছিল একটা ডাবল সিডি। রফি অনুরাগী সোনু নিগম নতুন করে গানগুলো গেয়েছিলেন। সংস্থার প্রোমোশনাল ট্যুরে অংশ নিয়ে সোনু গিয়েছিলেন লন্ডনের ন্যাশনাল অপেরা, ম্যাঞ্চেস্টারের অ্যাপোলো থিয়েটারে আর বার্মিংহামের সিম্ফনি হলে। রফির শেষযাত্রার আসল ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল একটি হিন্দি ছবির দৃশ্যে। বান্দ্রা এবং পুণের রাস্তার নামকরণ হয়েছে রফিসাবের স্মরণে।
জীবনে এমন কী পুরস্কার নেই, যা রফি পাননি? এক জীবনে এক জন গায়ক যদি পাঁচ বার জাতীয় পুরস্কার পেয়ে থাকেন, তো তাঁর আর চাইবার কী-ই বা থাকতে পারে?
“রফি সাব একলা চলে যাননি, সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন তাঁর গোটা স্কুলটি, সঙ্গীত জগতের রফি ঘরানাও তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই বিদায় নিয়েছে”, এমনই মন্তব্য করেছিলেন মান্না দে। রফিসাবের মৃত্যুর পরে। আজ মান্না দে’ও চলে গিয়েছেন, থেকে গিয়েছে তাঁর মন্তব্য।
মহম্মদ রফি আমাদের প্রাত্যহিক, গতানুগতিক জীবনের জেলখানা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সেই গুপ্ত চাবি। মারা যাওয়ার পয়ঁত্রিশ বছরের পরেও।
আজও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy