Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ট্রফি দিলেও কোচকে গালমন্দ একমাত্র কলকাতাতেই হয়

মহাকাব্যিক পঁচিশ বছর! কখনও লাল-হলুদ, কখনও সবুজ-মেরুন। কখনও নীল জার্সির ভারত। পুরনো সেই সাম্রাজ্য বিস্তার আর তার ভাঙাগড়ার রুদ্ধশ্বাস কাহিনি নিয়ে দীর্ঘ এত বছর বাদে অকপট স্বয়ং প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ নবম কিস্তি। হাজার অপমান, দুঃখ-কষ্টের পরেও ময়দানের সেরা কর্তা বেছে নিলেন।ইস্টবেঙ্গলে আমার প্রথম ইনিংসে মরসুম যত গড়াচ্ছিল, ততই যেন দলের ধারাবাহিক সাফল্য নিয়ে ডা. দাসের হাবভাব পাল্টে যেতে দেখছিলাম। বাহাত্তরে যে মানুষটা লিগে ইস্টবেঙ্গল একটাও গোল না খেয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় আমাকে সপরিবার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে ডিনার খাইয়েছিলেন।

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

ইস্টবেঙ্গলে আমার প্রথম ইনিংসে মরসুম যত গড়াচ্ছিল, ততই যেন দলের ধারাবাহিক সাফল্য নিয়ে ডা. দাসের হাবভাব পাল্টে যেতে দেখছিলাম।

বাহাত্তরে যে মানুষটা লিগে ইস্টবেঙ্গল একটাও গোল না খেয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় আমাকে সপরিবার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে ডিনার খাইয়েছিলেন। ত্রিমুকুট জেতার পর বলেছিলেন, “প্রদীপ তোমার পেমেন্ট বাড়িয়ে পরের মরসুম থেকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা করলাম”, সেই একই মানুষ পঁচাত্তরের মরসুমের শেষের দিক থেকে বলা শুরু করেছিলেন, “আরে, পিকে আবার কী করল ইস্টবেঙ্গলে? আমাদের ক্লাবে আবার কোচের কী দরকার? এগারোটা ছেলেকে লাল-হলুদ জার্সি পরিয়ে মাঠে নামিয়ে দিলেই ইস্টবেঙ্গল জিতবে। ইস্টবেঙ্গল নামটাই যথেষ্ট! আর টিমে ডিসিপ্লিন? তার জন্য একজন মিলিটারি অফিসারকে রেখে দিলেই চলবে!”

বুঝতে পারছিলাম, বছরের পর বছর টানা ট্রফি জিততে জিততে কী ভাবে সেই দলের কর্তাদের ধারণা তৈরি হয় যে, তাঁরাই সেই কৃতিত্বের আসল রূপকার। কিনা, টিমের পিছনে টাকাটা তাঁরাই খরচ করেছেন!

কিন্তু টেকনিক্যাল লোকেদের, প্লেয়ারদের যে ঘাম-রক্ত, পরিশ্রম, কষ্ট, সাধনা সেই সাফল্যের পিছনে লুকিয়ে থাকে সেটা কর্তাদের কে বোঝাবে?


বলরাম ঘোষ স্ট্রিটের পুরনো অফিসবাড়িতে মোহনবাগানের প্রাক্ শতবর্ষের
পুজোয় ধীরেন দে-র সঙ্গে কমল বসু, শৈলেন মান্না, উমাপতি কুমার।

কোনও দল ব্যর্থ হলেই যখন সেই টিমের কোচের চাকরি যাওয়াটা ফুটবলজগতে প্রায় নিয়ম, তখন কোনও দলের সাফল্যেও তার কোচ কেন সমান প্রশংসা পাবে না, এই তর্কের বোধহয় ফুটবল খেলাটা যত দিন পৃথিবীতে থাকবে, তত দিন মীমাংসা হওয়ার নয়।

কিন্তু কোচের সাফল্য সত্ত্বেও তাঁর নামে গালমন্দ বোধহয় বিশ্ব ফুটবলে একমাত্র কলকাতা ময়দানেই হয়!

ভাবুন তো! বায়ার্ন মিউনিখ মরসুমের পর মরসুম বুন্দেশলিগা জিতে চলেছে, অথচ ক্লাব-প্রধান বলছেন, গুয়ার্দিওলা আবার কী করল টিমের জন্য?

আবার টিমের চূড়ান্ত ব্যর্থতায় ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড গতবার মরসুম শেষ হওয়ার আগেই কোচ ডেভিড মোয়েসকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু একটাও উল্টোপাল্টা মন্তব্য কি করেছিলেন ম্যান ইউ কর্তারা মোয়েস সম্পর্কে?

ডা. নৃপেন দাস আসলে তাঁর গুটিকয়েক সঙ্গীর উসকানিতে ভেসে গিয়েছিলেন।

পঁচাত্তরের শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানকে ইস্টবেঙ্গল পাঁচ গোল মারার পরেও এক দিন তিনি আমাকে উত্তেজিত ভাবে বললেন, “রাখুন, রাখুন, পাঁচ গোল নিয়ে নাচানাচি! আমি ডাক্তার নৃপেন দাস। এই শহরের এক নম্বর সার্জেন। আমি বলছি যখন, ইস্টবেঙ্গলে কোচের দরকার নেই, তখন দরকার নেই। দলটাই এত ভাল যে, মাঠে নামলে এমনিই জিতব আমরা।”

আমি আর সে দিন থাকতে না পেরে পাল্টা ওঁর মুখের উপর বলে দিয়েছিলাম, “আপনি যদি এই শহরের এক নম্বর সার্জেন হন, তা হলে আমি এই দেশের এক নম্বর কোচ। আমি বলছি, ভাল কোচিং ছাড়া কোনও টিম কোনও দিন ভাল খেলতে পারে না। সে আপনি আমাকে তার জন্য কৃতিত্ব দিন বা না দিন।”

তার পর থেকে ডা. দাসের উল্টোপাল্টা কথাবার্তা একটু কমলেও বুঝতে পারছিলাম, ইস্টবেঙ্গলের নাড়ির সঙ্গে আমার যেন কোথায় ছেদ পড়ছে!

আর ঠিক এই অবস্থার মধ্যেই পঁচাত্তরের ক্রিসমাসের দিন দুই আগে আমার সেই সময়ের কাইজার স্ট্রিটের রেল কোয়াটার্সে ধীরেন দে মহাশয়ের আগমন!

সঙ্গে ফ্লুরিজ-এর একটা বিরাট কেকের সুদৃশ বাক্স। একটা প্রায় সে রকমই পেল্লায় সাইজের মিষ্টির বাক্স। আর বগলে চাপা একটা বড়সড় সাইজের বোতল। রঙিন কাগজে মোড়া বলে সেটা কীসের বোতল প্রথমে বুঝিনি।

“কী বাবাজীবন? তোমার বাড়িতে আমি ঢুকতে পারি তো? হাজার হোক, তুমি ইস্টবেঙ্গল কোচ। আর আমি মোহনবাগান সেক্রেটারি,” আমার ফ্ল্যাটের খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকতে ঢুকতেই কিন্তু কথাগুলো বলেছিলেন ধীরেনদা। এত বছর পরেও স্পষ্ট মনে আছে।

তার পর আরতির দিকে তাকিয়ে ধীরেনদা আবার, “জানো তো এ পার বাংলার লোকেরা বাবাজীবন বলে কাকে ডাকে? বাড়ির জামাইকে। আর বাড়ির জামাই কে হয় জানো তো? বাড়ির মেয়েকে যে বিয়ে করে। তুমি আমার মেয়ের মতোই। সে জন্যই তোমার স্বামীকে বাবাজীবন বলে ডাকা আমার। কী, আপত্তি নেই তো মা?”

আরতি উত্তর দেবে কী! ধীরেন দে-র মতো সাবেকি আর বিরাট ধনী মানুষের ওই রকম কথায় ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়েই থাকল।

আমিও কেমন যেন তখন থতমত। তবে চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে ধীরেনদাকে সমাদরে বসিয়ে বলেছিলাম, “তা হলে বলুন, শ্বশুর সম্বন্ধীয় আপনাকে আমি কী ভাবে আপ্যায়ন করতে পারি?”


মোহনবাগান ক্লাবের প্রাক্ শতবষর্র্ উত্‌সবে সুভাষ চক্রবর্তী,
যতীন চক্রবর্তী, উমাপতি কুমার-এর সঙ্গে ধীরেন দে।

ধীরেনদা হো-হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বললেন, “আগে কেকটা কেটে সবাই মিলে খাওয়া হোক। তার পর এই বোতলটা খুলবে কি না সেটা তোমার বৌয়ের কাছে অনুমতি নাও। আমার মেয়ে যদি অনুমতি দেয় তবেই খুলবে। নয়তো শো-কেসে সাজিয়ে রাখবে।”

তার পর আরতির দিকে তাকিয়ে বললেন, “মা কি আমার উপর রাগ করবে, যদি আমি প্রদীপকে এক বোতল ওয়াইন প্রেজেন্ট করি? ও এ সব খায় না আমি জানি। কিন্তু মোহনবাগানের একটা আলাদা কালচার আছে। তাই বড়দিনের আগে এসেছি বলে এটা নিয়ে এলাম। এটা প্রদীপকে মোহনবাগানের তরফে একটা সম্মান।”

সে দিন বুঝতে পেরেছিলাম, খেলার মাঠেও বনেদিয়ানা বলতে কী বোঝায়! ওয়াইনটাও ছিল সাংঘাতিক দামি বিদেশি ব্র্যান্ডের।

মোহনবাগানের সঙ্গে আমার চুক্তির সময় উমাপতি কুমারের মতো ওই ক্লাবের বরেণ্য প্রাক্তন ফুটবলার পর্যন্ত উপস্থিত থাকলেও ধীরেন দে কিন্তু আশেপাশে কোথাও ছিলেন না।

তখন আবার সব শৈলেন মান্না আর গজু বসু। মান্নাদা আমার বাল্যকালের হিরো। আর গজুর সঙ্গে আমার ইস্টবেঙ্গলে থাকার সময় থেকেই মাঠে আলাপ। অনেক পরে আরও দু’জনশৈল আর বীরু চট্টোপাধ্যায়ও মোহনবাগানে আমার সাফল্যের পিছনে প্রচুর সাহায্য করেছে।

ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের সঙ্গে মোহনবাগান অফিশিয়ালদের প্রচুর তফাত।

ইস্টবেঙ্গলে যেমন ‘মাইরা খেলুম, কাইট্টা ফেলুম’...‘মাঠে নাইম্মা অরে চিবাইয়া আসি,’ গোছের মারমার-কাটকাট মানসিকতার কর্মকর্তায় ভর্তি, মোহনবাগানে আবার তেমনই ‘ঠিক আছে, ওরা ভাল টিম, ভাল খেলবেই, কিন্তু আমাদেরও ভাল খেলতে হবে...দেখা যাক’ টাইপের শান্তশিষ্ট গোছের কর্তাদের ভিড়।

ইস্টবেঙ্গলে যেখানে জেতাটাই জীবন, না জিততে পারলে মাঠেই মারা যাওয়া ভাল (জীবন চক্রবর্তী কোনও ফুটবলার খারাপ খেললেই তাকে বলত, “বিষ খাইয়া মরতে পারিস না?”), সেখানে মোহনবাগানের মানসিকতা ‘জিততেই তো মাঠে নামা। কিন্তু না জিততে পারলে আর কী করা যাবে’ গোছের মিনমিনে যুক্তি।

তা ছাড়া, শেষ চার-পাঁচ বছর না জিতে-জিতে ওদের নিজেদের উপর বিশ্বাসটাই যেন চলে যেতে বসেছিল যে, আমরাও জিততে পারি।

ছিয়াত্তরে মোহনবাগান কোচিংয়ের দায়িত্ব নেব, সেটা যে-হেতু আমি বেশ কিছু দিন আগেই চূড়ান্ত করে ফেলেছিলাম, সে জন্য টিম নিয়েও অনেক ভাবনা-চিন্তার সময় পেয়ে গিয়েছিলাম।

ভৌমিককে বোঝালাম, তোকে আমার যেমন দরকার, তেমনই তোরও মোহনবাগানে গিয়ে ওদের অনেক কিছু বোঝানোর, প্রমাণ করার দরকার আছে বলে আমি মনে করি। সুভাষ তেতে গেল।

হাবিব-আকবর বুঝেছিল, পঁচাত্তরে কোনও কোনও কর্তার ইন্ধনে আমাকে ছেড়ে ওদের অন্য ক্লাবে চলে যাওয়াটা উচিত হয়নি।

মরসুম শেষে হায়দরাবাদে গিয়ে হাবিব-আকবরকে বোঝানোর জন্য গজু বসুকে আমিই পাঠিয়েছিলাম নিজের খরচে। তখন আমার তেমন বড় রোজগার ছিল না। তা সত্ত্বেও।

কাঠ-বাঙাল সমরেশ চৌধুরী হঠাত্‌ ইস্টবেঙ্গলের উপর খাপ্পা হয়ে উঠেছিল পঁচাত্তরের মরসুমের শেষের দিকে। ওকেও সেই সুযোগে মোহনবাগানে নিয়ে এলাম। তবে গজুর তীব্র আপত্তি ছিল।

তাই যখন সাতাত্তরেই সমরেশ আবার ইস্টবেঙ্গলে ফিরে গেল, গজু আমাকে বলেছিল, “এত দিনে মোহনবাগান ক্লাবটা পুরোপুরি ইস্টবেঙ্গল-মুক্ত হল।”

মোহনবাগানে এসেও মান্নাদাদের সেই একই কথা বলেছিলাম যা আমি ইস্টবেঙ্গলের কোচ হয়ে ডা. দাসকে বলেছিলাম।

আমার টিম আক্ষরিক অর্থেই আমার টিম হতে হবে। দল নির্বাচনে কোনও কর্তার নাক গলানো বরদাস্ত করব না। ট্রেনিং শিডিউল নিয়ে কোনও নন টেকনিক্যাল লোক কোনও কথা বলতে পারবে না।

আর মোহনবাগানে একটা বাড়তি স্টেপ নিয়েছিলাম। প্লেয়ার্স ড্রেসিংরুমে টিমের সাপোর্ট স্টাফের বাইরে কোনও কর্তা-সদস্য-সমর্থকের ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলাম।

প্র্যাকটিস শুরু করেই বুঝেছিলাম, টিপিক্যাল জমিদার মনোভাবাপন্ন পরিবারে যেমন হয়, মোহনবাগানেও তেমনই অবস্থা। যে যাকে পারছে জ্ঞান দিচ্ছে। প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলে ক্লাব-তাঁবুতে ঢুকছি টিম নিয়ে, ল্যাংলা-প্যাংলা চেহারার মাঝবয়সি ক্লাব কর্মী, দেখলেই বোঝা যায়, জীবনে কোনও দিন পায়ে ফুটবল ঠেকায়নি, গম্ভীর গলায় ভৌমিককে বলে দিল, “সুভাষদা, সেন্টারটা আরও সোয়ার্ভ করালে পেনাল্টি বক্সে হেড থেকে গোলের চান্স বাড়ত।”

কিংবা সুব্রত ভট্টাচার্যকে কোনও ছুটকো কর্তা বলে বসল, “বাবলুদা, তোমার আরও আগে ট্যাকলে যাওয়া উচিত।”

আর এ সব কথা মোহনবাগান কর্তা-কর্মীরা বলত প্লেয়ারদের ড্রেসিংরুমে পর্যন্ত অবাধে ঢুকে পড়ে। সেটা আমি প্রথমেই বন্ধ করে দিলাম।

গজু এক দিন বলেছিল, “প্রদীপ, আমরা যে কাজ বছরের পর বছর ধরেও করতে পারিনি, তুমি এক সপ্তাহে করে দিয়েছ। তবে দেখো, রেজাল্ট দিতে না পারলে এই সব কর্তারা নখ-দাঁত বার করে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাতে মোহনবাগানের ক্ষতি হলেও এদের কোনও হেলদোল নেই। মোহনবাগানে এটাই দস্তুর।”

মান্নাদা আবার ছিলেন জমিদারবাড়ির মেজভাইয়ের মতো। ক্লাবের সব ভাল-মন্দ জানেন, বোঝেন। কিন্তু বড় পরিবারে অশান্তির ভয়ে সব কিছু চাপা দিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন।

সব সময় মুখে লেগে আছে, “ও কিছু নয়। রাগ করিস না বাবা। এটা মোহনবাগান ক্লাব। ও একটু ভুল বোঝাবুঝি হবেই। মানিয়ে নে একটু। জানিস তো, অশান্তি বাড়াতে চাইলেই অশান্তি বাড়ে। তার চেয়ে চুপ করে যা না বাবা।”

তবে ধীরেন দে ছিলেন একেবারে অন্য ধরনের মানুষ। নির্লিপ্ত। জিতলেও যা, হারলেও তাই। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড টেনশন করছেন, অথচ বাইরে থেকে দেখে বোঝার জো নেই। কোনও কিছুই যেন ওঁকে স্পর্শ করত না।

কসমসকে আনছে মোহনবাগান, পেলের বিরুদ্ধে আমরা খেলব, এ রকম একটা অভূতপূর্ব খবরও ধীরেনদা আমাকে প্রথম যে ভাবে, যে ভঙ্গিতে দিয়েছিলেন, ভাবা যায় না! তাও ম্যাচের মাত্র কিছু দিন আগে!

সেটা বড় ক্লাবের কর্মকর্তা সম্পর্কে আমার আর একটা ইন্টারেস্টিং অভিজ্ঞতা। যা সারা জীবন সঞ্চয় করে রেখেছি।

সাতাত্তরে তখন লিগে হটফেভারিট হয়েও ইস্টবেঙ্গলের কাছে দু’গোলে মোহনবাগান হেরে গিয়েছে। লিগ চ্যাম্পিয়নশিপও আমাদের হাতছাড়া। মোহনবাগান প্র্যাকটিসে রোজ সকালে টিটকিরি, গালাগালের বন্যা বইছে।

বেশি টার্গেট কোচ হিসেবে আমিই। চোয়াল শক্ত করে সব হজম করছি আর শিল্ডে উঠে দাঁড়াবার জন্য ছেলেদের পিছনে সর্বক্ষণ পড়ে আছি। শিবাজি-সুব্রত-শ্যাম-গৌতম-প্রসূন-সুভাষ-হাবিব-আকবরদের উদ্বুদ্ধ করে চলেছি।

এই অবস্থায় শিল্ড শুরুর সপ্তাহখানেক আগে এক দিন সকালে প্র্যাকটিসের পর দেখি ক্লাব টেন্টে ধীরেন দে হাজির। সচরাচর যা দেখতে মোহনবাগানে কেউ অভ্যস্ত নয়।

সেই ট্র্যাডিশন বর্তমানে টুটু-অঞ্জনও রেখে দিয়েছে ওদের ক্লাবে যে, মোহনবাগান প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি কদাক্কচিত ক্লাবের প্র্যাকটিসে সকালে দৃশ্যমান হবেন-টবেন!

তো ধীরেনদা এসেই ক্লাবের মালি মারফত আমার কাছে খবর পাঠালেন, আমি যেন একবার তাঁর সঙ্গে একান্তে দেখা করি। ভাবলাম, শিল্ড নিয়ে আমাকে সতর্ক করবেন, কিছু পরামর্শ-টরামর্শ দেবেন।

কিন্তু টেন্টে তাঁর নির্দিষ্ট ঘরে আমি ঢুকতেই ধীরেনদা বললেন, “বাবাজি বসো। একটা কথা আছে। পেলের কসমস টিম আমাদের সঙ্গে খেলতে কলকাতায় আসছে। ইডেনে, সামনের ২৪ তারিখ ম্যাচ। মোহনবাগানই নিয়ে আসছে কসমসকে। তোমার ছেলেদের ভাল করে তৈরি করো। দেখো, আবার দশ-বারো গোল না খেয়ে যাই!”

দশ-বারো কেন, একশো-দেড়শো গোল খাওয়াটাওয়ার কথাও তখন আমার মগজে ঢুকছে না।

পেলে ফুটবলসম্রাট পেলে কলকাতায় খেলতে আসছেন! আমার টিমের সঙ্গে খেলতে আসছেন! ইডেনে পেলের কসমস ভার্সাস মোহনবাগান ম্যাচ! এই তো, আর কয়েক সপ্তাহ পরেই ২৪ সেপ্টেম্বর!

অথচ ধীরেনদা কী অদ্ভুত নির্লিপ্ত ভাবে, যেন এটা তেমন কোনও একটা খবরই নয় ভঙ্গিতে ব্যাপারটা আমাকে শোনালেন! কী প্রচণ্ড অনাবেগী অথচ পেশাদার মানুষটা!

আজ এটা লিখিত ভাবেই স্বীকার করে রাখা যাক ধীরেন দে-ই আমার দেখা ময়দানের সেরা ফুটবল কর্তা।

জ্যোতিষ গুহর সঙ্গে সে ভাবে কাজ করার সুযোগ পাইনি বলে বেশি বলতে পারব না। তবে ধীরেনদার মধ্যে অদ্ভুত একটা ভিশন ছিল।

এত বছর পরে আরও ভাল করে বুঝতে পারি, তাঁর সমসাময়িক যুগের চেয়েও ধীরেন দে চিন্তাভাবনায় কেমন এগিয়ে ছিলেন! এটা আমি অশোক ঘোষ-জিয়াউদ্দিনের মতো তখনকার সর্বভারতীয় ফুটবল কর্তাদের কথা মাথায় রেখেই বলছি।

মোহনবাগানে সত্তরের দশকে আমার চার বছরের কোচিংয়ে দলের ফর্মেশন নিয়ে দেদার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। ঝুঁকি নিয়েছি। সফলও হয়েছি।

কিন্তু এ সবই করতে পেরেছিলাম ধীরেনদার কাছে প্রশ্রয় পেয়েছি, ওঁর কাছ থেকে সাহস পেয়েছি বলেই। এক দিন ধীরেন দে আমাকে প্রশ্ন করলেন, কোনও ফরোয়ার্ড ছাড়াই খেলিয়ে মোহনবাগানকে জেতাতে পারবে?

ধীরেনদার ওই প্রশ্নের কত-কত বছর বাদে স্পেনকে ‘ফলস নাইন’ বা গোদা বাংলায় কোনও স্পেশ্যালিস্ট স্ট্রাইকার ছাড়াই খেলিয়ে দেল বস্কি পরপর ইউরো কাপ আর বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন করিয়েছেন!

তবে ইস্টবেঙ্গলের মতো মোহনবাগানেও ক্লাবের কিংবদন্তি প্রাক্তনরা আমাকে মাঝেমধ্যে চেপে ধরে নানা পরামর্শ দিতেন।

ইস্টবেঙ্গলে পাখি সেনের মতো প্রবাদপ্রতিম প্রবীণ ফুটবলার এবং সে রকমই ওই ক্লাবের আরও কয়েকজন বিখ্যাত প্রাক্তন আমাকে বলতেন, “এটা কী? খালি পাস আর পাস খ্যালছ প্রদীপ? টল-টল খ্যালো... টল-টল!” মানে উঁচু-উঁচু বল খ্যালো।

আবার মোহনবাগান লনে উমাপতি কুমার, শৈলেন মান্না এক জন মোহনবাগানের সর্বকালের সেরা ইনসাইড ফরোয়ার্ড তো অন্য জন ভারতের সর্বকালের অন্যতম ফাইনেস্ট ডিফেন্ডার আমাকে বোঝাতেন, কী ভাবে আমার উচিত মোহনবাগানকে ডাইরেক্ট ফুটবল খেলানো।

এত স্কোয়ার পাস, ব্যাকপাস, ওয়াল পাস না খেলে পারলে শুধুই থ্রু-পাসে কী ভাবে খেলা উচিত টিমের... এ সব।

আর বেশির ভাগ সময় ঠিক তখনই ধীরেন দে এসে আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করতেন। কোনও অছিলায় আমাকে তুলে নিয়ে যেতেন। উমাপতি কুমারদের বলতেন, “ঠিক আছে-ঠিক আছে। প্রদীপ সব বুঝেছে। এ বার ওকে যেতে দিন।”

ধীরেনদা নিজে কি আমাকে ফুটবল নিয়ে কিছু বলতে আসেননি? অবশ্যই এসেছেন। অনেক বারই।

কিন্তু সেগুলো বেশির ভাগ ঘটত বেঙ্গল ক্লাবে আমরা শুধু দু’জনে যখন গিয়েছি কোনও দিন দুপুরে বা বিকেলে।

সেখানে নিজে এক পেগ দামি স্কচ নিয়ে ধীরেনদা আমাকে বলেছেন, ‘‘তুমিও বাবাজি কিছু একটা নাও। দেখবে আলোচনাটা ভাল জমছে! ঠিক আছে, তোমার জন্য একটা ভাল করে লাইম-কর্ডিয়াল বানিয়ে দিতে বলছি।”

বলে ঠিক সেটা অর্ডার দিয়েছেন। তার পর আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, মোহনবাগানের আরও ভাল খেলার জন্য আমি ঠিক কী-কী করতে চাই। আর কী-কী পরিকল্পনা আছে আমার। নতুন আর কী-কী ভাবছি আমি!

আমার তো মনে হয়, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, আর্সেনাল, আয়াখস, বেনফিকা, বায়ার্ন মিউনিখ, এসি মিলান, রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনার মতো বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাবেও টপ অফিশিয়াল আর চিফ কোচের মধ্যে এ রকমই উঁচুদরের বোঝাপড়া আর সম্পর্ক থাকে।

ধীরেন দে-র মতো ভিশন, পেশাদারিত্ব মোহনবাগানে আমার কোচিংয়ের দ্বিতীয় ইনিংসের সময় টুটু-অঞ্জন-দেবাশিসদের মধ্যে দেখিনি।

যতই ওরা মুখে নিজেদেরকে পেশাদার বলুক, কাজে মোটেই তা নয়।

(চলবে)

অনুলিখন: সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE