দু’জন অমল দত্তকে আমি দেখেছি!
একজন অমল দত্ত আমার ধর্মতলা থেকে কোলে মার্কেট পর্যন্ত ট্রাম-টিকিট কেটে দিয়েছেন। বেশ কয়েকবার।
সেই সময়, যখন পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি কলকাতার ক্লাবে প্রথম খেলতে এসে আমার পুঁজি বলতে প্রায় কিছুই ছিল না।
তখনকার দিনে ট্রামের ছ’পয়সা ভাড়াও রোজ মেটাতে আমার মাঝেসাঝে সমস্যা হত।
অন্য অমল দত্ত তাঁর টিমের ফুটবলার সাইডলাইনে আমার সামনেই চোট পেয়ে যন্ত্রণায় কাতরানোয় সেই প্লেয়ারকে আমি একজন পেশাদার কোচের তাৎক্ষণিক মানবিক তাড়নায় মাঠে ঢুকে শুশ্রূষা করায়, চিৎকার করতে-করতে ছুটে এসে আমাকে প্রচণ্ড এক ধাক্কায় মাটিতে প্রায় ফেলে দিয়েছিলেন!
আমি কিনা সে দিনের ম্যাচে অমলদার প্রতিদ্বন্দ্বী দলের কোচ! সেদিনের সেই চোট পাওয়া ফুটবলার মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য তখন ভারতের এক নম্বর স্টপার। তাই শুশ্রূষায় দেরি ঘটলে দেশের ফুটবলের মহাক্ষতি হয়ে যেতে পারে ভেবে আমি মনার সাহায্যে ছুটে গিয়েছিলাম। ও সেদিন বিপক্ষ দলের প্লেয়ার হওয়া সত্ত্বেও।
এখানে ইস্ট-মোহন কোনও ব্যাপার নেই। দেশের স্বার্থ সবার আগে। কিন্তু অমলদা এক ধাক্কায় আমাকে সরিয়ে দিয়ে প্রচণ্ড চেঁচিয়ে বলেছিলেন, “কোন সাহসে তুমি আমার ফুটবলারকে টাচ করেছ? এক্ষুনি এখান থেকে কেটে পড়ো!”
একজন অমল দত্তকে আঠারো-উনিশের আমি প্রথম কলকাতার ক্লাবে খেলতে এসে নানা ভাবে অপমানিত হওয়ার দুঃখ-কষ্ট বলে মনে-মনে খানিকটা হালকা বোধ করেছি।
অন্য অমল দত্ত আমি যখন কোচ, আমাকে পদে-পদে অপমান করেছেন! অভব্য আচরণ করেছেন। আমার সাফল্য নিয়ে ট্যারাব্যাঁকা কথা বলেছেন। এমনকী আমাকে ছোট করতে গিয়ে আমার টিমের ফুটবলারদের নামেও যা-তা বলেছেন!
দু’টোর মধ্যে কোনটা আসল অমল দত্ত এত-এত বছরের মধ্যেও আমি পরিষ্কার বুঝে উঠতে পারিনি!
বয়সে আমার চেয়ে পাঁচ-ছ’বছরের বড়। সে জন্য বরাবর ‘অমলদা’ বলে ডাকি। অমলদা আর আমি উনিশশো চুয়ান্নয় একসঙ্গে এরিয়ানে খেলেছি। তার আগে অমলদার ইস্টবেঙ্গলে শেষ বছর বাহান্ন সালে শোনা গিয়েছিল, তাঁকে জ্যোতিষ গুহ মহাশয় নিজের ক্ষমতাজোরে কোয়াড্রাঙ্গুলার টুর্নামেন্টে ভারতীয় দলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ইস্টবেঙ্গলের প্রবাদপ্রতিম কর্তা জ্যোতিষবাবু সেই সময় ভারতীয় ফুটবল দলের অন্যতম নির্বাচকও ছিলেন।
লেফট হাফ অমল দত্ত অবশ্য ভাল প্লেয়ার ছিলেন। টেকনিক বেশ ভাল। যথেষ্ট ফুটবলবুদ্ধি। ইংলিশ ফুটবল স্টাইলে খেলতেন। কিন্তু একটা জিনিস খুব কম ছিল। সেটা হল গতি। ওটাতেই মার খেয়ে যেতেন বিপক্ষের কাছে।
অমলদার বিরুদ্ধে যখন খেলেছি, রাইট উইঙ্গার হিসেবে আমি লেফট হাফ অমলদাকে স্পিডে বলে-বলে ‘বিট’ করেছি। তবু পূরণবাহাদুরের মতো লেফট হাফকে বাদ দিয়ে জ্যোতিষবাবু জাতীয় দলে অমলদাকে সুযোগ দিয়েছিলেন।
তার পর এরিয়ানে যখন আমরা দু’জন একসঙ্গে খেলেছি, মাঠে আমাদের দলের কোচ দাশু মিত্রের আমাকে বলা তীব্র অপমানজনক কথা নিয়ে প্র্যাকটিস বা ম্যাচের পর অমলদাই কিন্তু সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। ‘চামচিকেও আবার পাখি’... ‘ল্যাঙ্গটের আবার পকেট’... বিহারের বাঘ কলকাতায় এসে বেড়াল হয়ে গিয়েছে’—এ রকম অনেক কথা বলে দাশু মিত্র আমাকে এরিয়ানে খেলার সময় অপমান করতেন।
খেলার পর আমি হাঁটতে-হাঁটতে ময়দান থেকে ধর্মতলা গিয়ে তখন যেখানে থাকতাম, শিয়ালদহের সেই কোলে মার্কেট যাওয়ার ট্রাম ধরতাম। কিন্তু অনেক দিনই অমল দত্ত আমার সঙ্গে ধর্মতলা এসে আমাকে কুমারটুলির ট্রামে চাপিয়ে ওঁর বাড়ি নিয়ে যেতেন।
যেতে-যেতে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, দাশু মিত্রের কথায় আমি যেন দমে না যাই। কিংবা আসলে আমি সে দিন ম্যাচে ঠিক পাসই বাড়িয়ে ছিলাম সতীর্থকে, কিন্তু সঠিক রিটার্ন পাস পাইনি। তা হলে আমার কী দোষ! ইত্যাদি।
অনেকেই হয়তো জানেন না, অমলদাদের জন্তু-জানোয়ার বিক্রির পৈতৃক ব্যবসা ছিল। নানান ধরনের পাখি, খরগোশ, বাঁদর পর্যন্ত কেনাবেচা করতেন অমলদার পূর্বপুরুষরা।
অনুশীলনে মোহনবাগান খেলোয়াড়দের সঙ্গে পিকে
আমাকে অমলদা ওঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কোনটা সাউথ আমেরিকান ম্যাকাও আর কোনটা অস্ট্রেলিয়ান ম্যাকাও দেখিয়ে বোঝাতেন। খরগোশের নানা জাত চেনাতেন। তার পর অনেক দিনই ওখান থেকে কোলে মার্কেট যাওয়ার ট্রাম ভাড়ার পয়সাটা আমাকে হাতে গুঁজে দিয়েছেন।
অমল দত্ত কোচও বিরাট বড়। যথেষ্ট উঁচু মানের। ফুটবল নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা আছে। আন্তর্জাতিক ফুটবল সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। ফুটবলবিদগ্ধ মানুষ বলতে যা বোঝায় একেবারে তাই-ই। আজ লিখিত ভাবে বলছি, অমলদার কোচিংকে আমি বরাবর শ্রদ্ধার চোখে দেখে এসেছি।
ওঁর বাড়িতে গানবাজনার দারুণ চর্চা ছিল। অমলদা নিজেও খুব ভাল সেতার আর তবলা বাজাতে পারেন। হয়তো কাকতালীয়, কিন্তু খেলা কিংবা কোচিংয়ের সঙ্গে সঙ্গীতের দারুণ একটা সম্পর্ক আছে। আমি নিজেও গানবাজনার ভীষণ ভক্ত।
যখন পুরোদমে বড় ক্লাবে কোচিং করাতাম, রাতের পর রাত চোখে ঘুম আসত না। যেন চোখের সামনে পরের দিন যে ম্যাচটা আছে ভিসুয়ালি সেটা উপলব্ধি করতাম। যেন সিনেমার মতো আমার চোখের সামনে দেখতে পেতাম ম্যাচটা কেমন ভাবে খেলা হবে। কী-কী স্ট্র্যাটেজি আমি নিচ্ছি। আর সেই না-ঘুমনো রাতগুলোতে গানই আমার সঙ্গী হত।
খুব কম ভল্যুমে টেপ রেকর্ডারে নিজের কোনও প্রিয় গানের ক্যাসেট চালিয়ে দিতাম। পাছে আমার স্ত্রী বা বাচ্চা মেয়েদের ঘুম ভেঙে যায়। অমলদা গানবাজনার পরিবেশে বড় হয়ে ওঠায় হয়তো এই ব্যাপারটা আরও ভাল উপলব্ধি করে থাকবেন।
আরও একটা ব্যাপার অমলদার কোচিংয়ের বিশেষত্ব। কোচিং নিয়ে উনি অনেক স্বপ্ন দেখতেন। যে কোচ স্বপ্ন দেখে না, সে কোনও দিন বড় কোচ হতে পারে না। খেলাটা নিয়ে বড় স্বপ্নই একজন কোচকে আরও ভাল করার জন্য তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।
দুই বড় ক্লাবের একটায় আমি আর অন্যটায় অমলদা কোচ, এ রকম মরসুম ছয়-আট বার এসেছে আমাদের দু’জনের কোচিং কেরিয়ারে। আসলে আমি মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল কোনও টিমের কোচ হলে অন্য দলটা ভাবত আমার দলকে আটকাতে পারেন একমাত্র অমল দত্ত। আবার অমলদা মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল যে দলেরই কোচ হতেন, অন্য ক্লাবটা ভাবত অমলদার টিমকে একমাত্র আমিই হারাতে পারি।
দুই বড় ক্লাবের কর্তা, সদস্য-সমর্থকদের এই ভাবনা থেকেই ভারতীয় ফুটবলে পিকে বনাম অমল অন্য সব কোচেদের দ্বৈরথের তুলনায় বাড়তি তাৎপর্য, আলাদা মাত্রা পেয়েছে বলে আমার ধারণা।
অমলদার সেই ডায়মন্ড সিস্টেমে মোহনবাগানকে খেলানোর মরসুমে প্রথম বার আমার ইস্টবেঙ্গলের সামনে পড়া সেবারের ফেড কাপ সেমিফাইনালে।
এত বছর পরেও ম্যাচের তারিখটা মনে আছে। ১৩ জুলাই, ১৯৯৭। তার আগের ম্যাচেই গুয়াহাটিতে সে বারের জাতীয় লিগ রানার্স চার্চিল ব্রাদার্সকে ৬-১ হারিয়েছে অমলদার মোহনবাগান। চিমা একাই পাঁচ গোল করেছিল ফেড কাপের সেই কোয়ার্টার ফাইনালে। আর অমলদাও সেমিফাইনালের আগে আমার ইস্টবেঙ্গল ফুটবলারদের নাম তুলে-তুলে ব্যঙ্গাত্মক সব উক্তি করে বাজার গরম করা শুরু করে দিয়েছিলেন।
কোনও দিন কাগজে ভাইচুংকে ‘চুং-চুং’ বলে দিচ্ছেন। কোনও দিন সোসোকে ‘শশা’। আবার কোনও দিন ওমোলোকে বলছেন ‘অমলেট’। ওই সময় একটা কাগজেই পড়েছিলাম, ইস্টবেঙ্গলের ওমোলোর মতো ডিফেন্ডার মোহনবাগানে কেউ আছে কি না, কোনও এক সাংবাদিকের এই প্রশ্নে অমলদা উত্তর দিয়েছিলেন, “এ আর এমন কী ব্যাপার? আমার বাঘাকে (সত্যব্রত ভৌমিক) আলকাতরা মাখিয়ে নামিয়ে দিলেই ওমোলো হয়ে যাবে!”
আবার সেই অমলদার ‘ডায়মন্ড’ মোহনবাগান আমার ইস্টবেঙ্গলের কাছে তখনকার বাচ্চা ছেলে ভাইচুংয়ের হ্যাটট্রিকে ১-৪ গোলে হারার পরের দিন নিজের দলের গোলকিপার হেমন্ত ডোরা সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, “হেমন্ত? সে তো মরে গিয়েছে?” শুনেছি প্রশ্নকারী সাংবাদিক অবাক হয়ে অমলদাকে বলেছিলেন, “মানে? কী বলছেন?”
তাতেও না দমে অমলদা বলেছিলেন, “আমি তো একজন হেমন্তকেই চিনি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনি তো মারা গিয়েছেন!”
আসলে আগের দিন বড় ম্যাচে হেমন্ত ডোরার চার গোল খাওয়াই অমলদার তীব্র রাগের কারণ। কিন্তু একটা খুব খারাপ দিন তো পৃথিবীর যে কোনও খেলোয়াড়ের জীবনেই আসতে পারে!
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী
আমার সম্পর্কেও ডায়মন্ড-এর বছরে অমলদা একবার বলেছিলেন, “প্রদীপ? ও আবার বড় ফুটবলার ছিল কবে? কোনও দিন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলেই তো খেলেনি!” বোঝো ঠ্যালা! আরে, তখনকার দিনে পরিবারের কথা ভেবে রেলের অমন চাকরি ছাড়া সম্ভব ছিল না বলেই কোনও দিন ইস্টার্ন রেল ছেড়ে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলে সই করা হয়ে ওঠেনি আমার।
প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্লেয়ার, কোচ সম্পর্কে অমলদার এই অশ্রদ্ধা, উল্টোপাল্টা মন্তব্যের পিছনে দু’টো কারণ আছে বলে আমি মনে করি। ম্যাচের আগে প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর চাপ তৈরি করা, সেই সঙ্গেই নিজের দলের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো। কিন্তু আমি এই স্ট্র্যাটেজিকে বরাবর, কী ফুটবলার জীবনে আর কী কোচিং জীবনে, সব সময় ঘৃণা করে এসেছি। ঘৃণার চোখে দেখে এসেছি।
নিজেরই পেশার অন্য একজনকে, আরে, সে আমার যতই প্রতিদ্বন্দ্বী হোক, তার সম্পর্কে এত খারাপ কথা, তাকে এত অশ্রদ্ধা কখনই করা উচিত নয়। তাতে নিজেকেই, নিজের পেশাকেই ছোট করা হয়, অপমান করা হয়।
আধুনিক আন্তর্জাতিক ফুটবলে হোসে মোরিনহোর মধ্যে আমি যেন খানিকটা অমল দত্ত-সিনড্রোম দেখতে পাই। চেলসি, রিয়াল মাদ্রিদ, ইন্টার মিলান, পোর্তো— যখন যে বিখ্যাত ক্লাবেই কোচিং করাক, বিপক্ষ দলের কোচেদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। কখনও বিপক্ষ কোচের সঙ্গে কদর্য বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তো কখনও মাঠে বিপক্ষ কোচের সঙ্গে গোলমাল পাকিয়ে বসে। অথচ বিশ্বসেরা ফুটবল কোচেদের মধ্যে মোরিনহো নামটা সন্দেহাতীত ভাবে অগ্রগণ্য।
স্যর অ্যালেক্স ফার্গুসন আবার ঠিক উল্টো মানসিকতার কোচ। টানা দু’দশকেরও বেশি একটাই ক্লাব ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে কোচিং করিয়েও কখনও কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী কোচ বা ফুটবলারকে অসম্মান করেননি। নিজের দলের বেকহ্যামের দিকে হয়তো বুট ছুড়ে মারতে পারেন, কিন্তু কোনও দিন বিপক্ষের কাউকে অপমান করেছেন বলে শোনা যায়নি।
আসলে মোরিনহো, অমল দত্ত-রা হয়তো নিজেদের মনের কোনও গহন কোণে হীনমন্যতায় ভোগেন। মোরিনহো পর্তুগালে দ্বিতীয় ডিভিশনের বেশি ফুটবল খেলেনি বলে শুনেছি। অমলদাও ইস্টবেঙ্গলে খেললেও কোনও দিন দলের অপরিহার্য ফুটবলার হয়ে উঠতে পারেননি। একবার অমলদার আত্মঘাতী গোলেই ইস্টবেঙ্গল হেরে গিয়েছিল।
সেই সব আক্ষেপ এঁদের ভেতরে-ভেতরে রয়েই গিয়েছে। পরবর্তী কালে এঁরা যখন ফুটবল মহলের কাছ থেকে নামী কোচের স্বীকৃতি পেয়েছেন, সাফল্য পেয়েছেন, তখন নিজেদের মনের গহন কোণে এত দিনের জমে থাকা সেই হীনমন্যতাটাই একশো আশি ডিগ্রি উল্টে গিয়ে আত্মম্ভরিতা, মানে আমিই সর্বেসর্বা মনোভাবে দাঁড়িয়েছে।
অমলদার আরও একটা মানসিকতা হল, যত দিন কেউ তার সঙ্গে তুলনায় আন্ডারডগ, অমলদা তার বন্ধু। তার কষ্ট-যন্ত্রণার সমব্যথী হবেন। সম্ভব হলে তাকে সাহায্যও করবেন। কিন্তু সেই ‘আন্ডারডগ’ যেই অমলদাকে সাফল্যে টপকে গেল, তক্ষুনি অমলদা তাঁর শত্রু হয়ে গেলেন। তাকে তখন অপ্রয়োজনেও নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে দেবেন। তাকে উল্টোপাল্টা কথা বলে ছোট করবেন, অপমান করবেন। যত রকম ভাবে সম্ভব অশ্রদ্ধা করবেন।
আমার বেলাতেই যেমন। যত দিন এরিয়ানে তাঁর জুনিয়র ফুটবলার ছিলাম আমি, অমলদা আমাকে দয়ামায়া দেখাতেন। কিন্তু যখন থেকে আমি ভারতীয় ফুটবলে ‘পিকে’ হয়ে উঠলাম, পরে অমলদার কোচিং পেশারও প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলাম, সাফল্যেও ওঁকে ছাপিয়ে গেলাম, ব্যস, অমলদা আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। এটা আসলে এক ধরনের গোলমেলে মানসিকতার শিকার হওয়া। দুর্ভাগ্যবশত ফুটবলঅন্ত প্রাণ হয়েও অমল দত্ত ওই গোলমেলে মানসিকতার শিকার!
উনিশশো ছাপান্নয় ইস্টবেঙ্গলের যে দলটা রাশিয়া সফরে গিয়ে একটা ম্যাচে দশ গোল খেয়েছিল, অমলদা সেই টিমে ‘লোন’-এ গিয়েছিলেন। রাশিয়া ’৫৬ অলিম্পিকে ফুটবলে সোনা জিতেছিল। ওই দেশে তখন ফুটবলের দারুণ জোয়ার। অমলদা যার স্বাদ চেটেপুটে নিয়েছিলেন আর সেই ওঁর প্রথম ফুটবল কোচিংয়ের দিকে ঝোঁকা। তার জন্য নিজের টাকায় ইংল্যান্ড, ব্রাজিল পর্যন্ত গিয়েছেন। শোনা যায়, স্ত্রীর গয়না বেচে বিদেশ যাওয়ার খরচ জোগাড় করেছিলেন। এতটা দুঃসাহস কিন্তু কারও ভেতর নিখাদ ফুটবলপ্রেম না থাকলে দেখানো সম্ভব নয়। তার পর সেই ম্যাজিক লন্ঠন নিয়ে, ক্যামেরা ঘাড়ে করে বিদেশি ফুটবল ম্যাচের রেকর্ডিং দেখিয়ে গ্রামবাংলায় প্লেয়ার তোলার চেষ্টা করা— ফুটবলের প্রতি অতটা প্রেমই বা ক’জনের মধ্যে দেখা যায়!
বাড়িতে অমল দত্ত
কিন্তু এত সব গুণ সত্ত্বেও অমলদার কোচ হিসেবে কিছু কাল্পনিক ব্যাপারস্যাপার ছিল। আর ছিল গোয়ার্তুমি। যেমন সেখানকার ভাষার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা সত্ত্বেও উনি ব্রাজিল চলে গিয়েছিলেন কোচিং শিখতে।
এ রকম অবস্থায় একজনের পক্ষে ব্রাজিলে গিয়ে বড়জোর সে দেশের কয়েকটা খাবারের নাম, জায়গার নাম শেখা, আমাজনের জঙ্গল দেখা আর দু-একটা ফুটবল সেমিনারে ‘সেনর-সেনোরা-সেনোরিটা’, এ রকম একটা-দুটো পর্তুগিজ শব্দ বলাটলার বাইরে আর কিছু করা সম্ভব নয়। পুরোটাই হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়।
অথচ, অমলদা গোঁয়ার্তুমি করে ব্রাজিল পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন, গুচ্ছের টাকা খরচা করে। তার চেয়ে বরং এএফসি-র কোনও ‘এ’ লাইসেন্স কোচিং কোর্স করলে সেটা বেশি কাজে আসত ওঁর।
কোচ অমলদার কাল্পনিক ব্যাপারের বোধহয় সবচেয়ে বড় উদাহরণ সাতানব্বইয়ে সেই ডায়মন্ড সিস্টেম আর তাঁর কোচিংয়ে ফেডারেশন কাপে উড়তে থাকা মোহনবাগানের সঙ্গে আমার ইস্টবেঙ্গলের সেই সেমিফাইনাল ম্যাচ।
এক লাখ তিরিশ হাজার দর্শক এসেছিলেন ম্যাচটা দেখতে। সল্ট লেক স্টেডিয়ামে তো বটেই, এশিয়াতেও কোনও ফুটবল ম্যাচে ওটাই রেকর্ড দর্শক-সংখ্যা। ম্যাচটা নিয়ে যা প্রচণ্ড হাইপ উঠেছিল, একমাত্র তুলনা আসতে পারে ছিয়াত্তরের লিগে বড় ম্যাচ। দু’বারই আমি বনাম অমল দত্ত। শুধু ক্লাবের দায়িত্ব বদলাবদলি হয়ে গিয়েছিল।
অমলদার ডায়মন্ড মোহনবাগানকে চার গোল মেরেছিলাম স্রেফ ওঁর দলের চেয়ে আমার ইস্টবেঙ্গলকে একটা টাচ বেশি খেলিয়ে!
ডায়মন্ড সিস্টেম ফুটবলে সত্যিই একটা আছে। মাঝমাঠ থেকে বিপক্ষ বক্সে একটা চতুর্ভুজ পাস খেলতে-খেলতে উঠে আসবে আর তাদের সাহায্যে দু’টো উইংয়ে আরও দু’জন সতীর্থ ফুটবলার সারাক্ষণ ওঠা-নামা করবে। এই আক্রমণের অনেক বিকল্প আছে। চতুর্ভুজের ভেতর থেকে কেউ বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। বাইরে থেকে কেউ ভেতরে ঢুকতে পারে। কেউ সমান্তরাল ওঠা-নামা করতে পারে। কেউ কোনাকুনি ওঠা-নামা করতে পারে। আর অ্যাটাকিং থার্ডে গিয়ে পুরো ফর্মেশনটা উল্টে গিয়ে একটা ডায়মন্ডের আকার নেয়। সে জন্যই ডায়মন্ড সিস্টেম। কিন্তু তার জন্য ফুটবলারদের সব সময় ওয়ান টাচে খেলা দরকার। মানে বল নিজের কাছে এলে সেটাকে একই টাচে রিসিভ এবং সেই টাচেই পরের পাসটাও বাড়াতে হবে।
রিসিভ করে মাথা তুলে সতীর্থদের পজিশন দেখে পরের টাচে পাস দিতে গেলে চলবে না। তবে এ রকম ওয়ান টাচ ফুটবল খেলার জন্য দুর্দান্ত পেরিফেরিয়াল ভিশন থাকার পাশাপাশি নিখুঁত রিসিভিং, পাসিং, বল কন্ট্রোল থাকাও দরকার। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড গতি। কিন্তু এসবের কোনওটাই আমাদের ছেলেদের অতটা সাংঘাতিক নিখুঁত নয়। তবু যত দিন ভারতীয়রা খালি পায়ে খেলত এ সব ব্যাপারে অনেকটাই নিখুঁত ছিল, কিন্তু বুট এসে পড়ার পর আর ততটা নিখুঁত নই আমরা।
সে দিন অমলদার ডায়মন্ডের বিরুদ্ধে যেই আমার তুষার রক্ষিত, আব্দুল সাদিক, দুলাল বিশ্বাস, অমিতাভ চন্দ, শঙ্করলাল চক্রবর্তী নাজিমুল হক-রা একটা টাচ বেশি খেলা শুরু করে দিল, মানে বল পেলে সেটা হোল্ড করে পরের টাচে পাস বাড়াতে থাকল, অমলদার মোহনবাগানের স্পিড কমে গেল। আর ডায়মন্ড সিস্টেমে স্পিড কমে যাওয়া মানেই খেলা ঘেঁটে যাওয়া। মোহনবাগানেরও সেটাই হয়েছিল। কিন্তু অমলদা গোঁয়ার্তুমি করে পুরোপুরি সেই অ্যাটাকিং সিস্টেমই আঁকড়ে পড়ে থাকলেন ম্যাচে। আর সেই সুযোগে কাউন্টার অ্যাটাকে নাজিমুল আর ভাইচুং প্রথমার্ধেই ২-০ করে দিল।
ভাইচুংকে আমার বলা ছিল, সারাক্ষণ বল যে দিকে থাকবে ঠিক তার উল্টো দিক দিয়ে মোহনবাগান ডিফেন্সে অপারেট করতে হবে ওকে। একবারও নিজের দলের ডিফেন্সকে সাহায্য করতে নেমে আসার দরকার নেই। আর নাজিমুলকে বলে দিয়েছিলাম, বল যে দিকে থাকবে, শুধু সে দিকেই খেলতে।
তাতে মোহনবাগানের পিভট যারা খেলছিল, তারা নাজিমুলকে ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর ভাইচুং নিজের দলের পিভটকে নিয়ে ফাঁকায় মোহনবাগান বক্সে দাপিয়ে বেড়ালো। হ্যাটট্রিক পর্যন্ত করে বসল বড় ম্যাচে!
কোচ হিসেবে অমলদার যদি কাল্পনিক চিন্তায় ভেসে বেড়ানোর অভ্যেস না থাকত, কিংবা গোঁয়ার্তুমি না দেখাতেন, তা হলে তখন মোহনবাগান সৃষ্টিশীল ফুটবল খেলার চেষ্টা থেকে সরে ধ্বংসাত্মক ফুটবলে চলে গিয়ে আমার ইস্টবেঙ্গলকে পাল্টা লড়াই দিত। সেটাই বাস্তবোচিত ছিল।
তবে সৃষ্টিশীল ফুটবল খেলতে খেলতে পুরোপুরি ধ্বংসাত্মক খেলায় নিজেদের পরিবর্তন ঘটানোও ভীষণ কঠিন ব্যাপার।
চার বছর আগের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেনের বিরুদ্ধে এ বার বিশ্বকাপে যখন প্রথম ম্যাচেই নেদারল্যান্ডস পরের পর গোল করে চলেছে, কিংবা জার্মানি যখন সেমিফাইনালে ব্রাজিলকে সাত গোল মারছে, তখনও জাভি-ইনিয়েস্তা বা ফ্রেড-অস্কাররা পর্যন্ত রাতারাতি নিজেদের খেলাকে ধ্বংসাত্মক ফুটবলে পাল্টে ফেলতে পারেনি। তো সেখানে অমলদার মোহনবাগান কোন ছার!
অমলদার বিরুদ্ধে আমার কোচিং দ্বৈরথ তিন দশকেরও বেশি। সবই ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান লড়াই। কখনও আমি মোহনবাগানে, অমলদা ইস্টবেঙ্গলে। কখনও আবার তার উল্টো। কিন্তু যত দূর মনে হয়, আমিই নিরানব্বই ভাগ ম্যাচ জিতেছি।
আমার টিমের বিরুদ্ধে অমলদার দলের তেমন বড় জয় সাতাত্তরে লিগ ম্যাচ ছাড়া আর বিশেষ আছে বলে মনে পড়ছে না। সাতাত্তরের ম্যাচটাতেও যদি গোড়ার দিকে হাবিব অমন সিটার নষ্ট না করে বসত, তা হলে শেষমেশ কী স্কোরলাইন দাঁড়াত তা নিয়ে আমার এত বছর পরেও সন্দেহ আছে।
হাবিব ছিল সেই সময় আমার মোহনবাগানের হৃৎপিণ্ড। কিন্তু সেই জলের মতো সহজ সিটার নষ্ট করে ওর মনঃসংযোগ সে দিন একদম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যার ছাপ গোটা টিমের খেলার ওপর পড়েছিল। তা ছাড়া, তখন থেকেই রটে গিয়েছিল যে, হাবিবের পাস আটকাতে হলে আকবরকে ট্যাকল করো। হাবিব কা পাস রুখনে কে লিয়ে আকবর কো পাকড়াও। কারণ, হাবিব একশোটা বল পেলে পরের পাসটা একশোবারই আকবরকে বাড়াত।
সবার মতো অমলদার ইস্টবেঙ্গলও এই ব্যাপারটা জানত। এবং তখনও আমি হাবিবের ওই ভ্রাতৃপ্রেমের অ্যান্টিডোট বার করে উঠতে পারিনি। সেটা একবার বার করে ফেলার পর কিন্তু মোহনবাগান সে বছর ত্রিমুকুট জিতেছিল। অমলদার টিমের কাছে আমার দল একবারও আর হারেনি। উল্টে অনেক বার হারিয়েছিল।
কোচিং মোটামুটি ছেড়ে দেওয়ার পর হঠাৎ অমলদা একদিন রাজনীতি জগতে ঢুকে পড়লেন। এটাও আমার যেন কেমন লাগে! রাজনীতি করার জন্য কিছু কূটনীতির দরকার হয়। আমি নিজে যথেষ্ট রাজনীতি সচেতন মানুষ হলেও ওই কূটনীতির ব্যাপারটার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারি না কোনও দিনই। ফলে আমার ভাই প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোটের প্রচারেও প্রচুর অনুরোধের পর মাত্র একবারের বেশি যাইনি।
সহজ-সরল ঘটনা নিয়েও ‘কমপ্লেক্সে’ ভোগার অভ্যাস অমলদার। একবার কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে-র সঙ্গে একটা ঘরোয়া মজলিসে আমি আর অমলদা দুজনেই ছিলাম। সেদিন মান্না দে-র কাছে চড়-চাপ্টা খাওয়ার আশঙ্কা নিয়েও আমি ওঁর দু’-একটা গানের একটা-দুটো লাইন গেয়েছিলাম! আর তবলা বাজিয়েছিলেন অমলদা। মান্না দে-র সামনে গাইতে গিয়ে আমার তো হাত-পা ঠান্ডা হওয়ার জোগাড়। অথচ অমলদা আড্ডা থেকে বেরিয়ে আমায় বেশ সিরিয়াসলি বলেছিলেন, আমি বাথরুম-সং গাইলেও উনি নাকি অনেকটা রাধাকান্ত নন্দীর মতোই তবলা বাজিয়েছেন!
বোঝো ঠ্যালা!
(চলবে)
ভ্রম সংশোধন
গত শনিবার প্রকাশিত ‘সুনীল এখনও কত কথা বাকি’-শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে একটি বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে, ‘আমি কারও নাম করছি না। কোনও কোনও মহিলার লেখক-স্বামীরা আমায় বলেছেন, তাঁদের স্ত্রীরা নাকি বাড়িতে গিয়ে বলেছে, সুনীলের সঙ্গে ওদের সাঙ্ঘাতিক প্রেম...।’ স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, তিনি এ ক্ষেত্রে নাম না-করে অন্য একজন লেখকের কথা বলেছেন। তিনি তাঁর স্ত্রীর কাছে নিজের বিয়ে-বহির্ভূত প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে বড়াই করতেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কখনও গর্ব করে এ সব ব্যক্তিগত কথা বলেননি বলে স্বাতী জানিয়েছেন। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy