এটা সত্যি যে বন্ধ্যাত্বের জন্য মেয়েরা অবসাদে ভোগেন। মাতৃত্বের মধ্যেই আছে জীবনের অনেকখানি সফলতা। প্রথম মাতৃত্ব তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার মতো ব্যাপার। কিন্তু ব্যাপারটা যদি উল্টো হয়? মাতৃত্ব নিয়ে মোটেই আনন্দে ভাসেন না এখনকার মেয়েরা। বরং ভেতরে ভেতরে প্রবল চাপ, কী হয় কী হয়। আর তা থেকেই জন্ম নেয় অবসাদ! অবাক হওয়ার মতো শোনালেও অনেক মেয়ের জীবনে এটা হয়। বাস্তবে মেয়েদের জীবনে সব থেকে বেশি মানসিক সমস্যা হয় প্রেগন্যান্সি ও তার পরের এক বছর সময়। বিশেষ করে যাঁরা এমনিতেই খানিকটা মানসিক অসুখে ভোগেন, প্রেগন্যান্সি এলে মানসিক সমস্যা আরও বেড়ে যায়। ব্যাপারটা নাকি এমনই। ডাক্তার খাস্তগীর জানালেন, প্রেগন্যান্সির সময়ই খানিকটা আভাস পাওয়া যায় পরবর্তীতে আপনি শারীরিক আর মানসিক দিক দিয়ে কেমন থাকবেন। কারও যদি প্রেগন্যান্সির সময় ডায়াবেটিস হয় তবে বয়সকালে তাঁর ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা থাকে। তেমনটা মানসিক অসুখের ক্ষেত্রেও। ওই সময়ে মানসিক সমস্যা হলে পরবর্তীতেও তার সম্ভাবনা বাড়ে।
• কেন হবে এমনটা
খাস্তগীর বলছেন, এই সময় শরীরে কিছু হরমোনের তারতম্য ঘটে। তার থেকে অবসাদ আসতেই পারে। তা ছাড়া প্রেগন্যান্সি মানেই স্বাভাবিক জীবন থেকে অনেকখানি সরে যাওয়া। ইচ্ছে মতো বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ, স্বাভাবিক কাজকর্ম আর শারীরিক সম্পর্কে ছেদ পড়ে। অ্যালকোহল, ধূমপান, নাইট ক্লাব, পার্টি, সব বন্ধ। একটা ঘেরাটোপে নিজেকে যেন আটকে ফেলা। সেটাই অনেকে মেনে নিতে পারেন না। তা থেকেই মনে প্রবল দ্বন্দ্ব। তা ছাড়া এত দিনের বদ্ধমূল ধারণা প্রেগন্যান্সি আনন্দের সময়। সে হিসেব মেলাতে অনেকেই মুখে হাসি ফুটিয়ে আনন্দের অভিনয় করে থাকেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাঁরা চূড়ান্ত উদ্বিগ্ন। সেটা গড়িয়ে যায় অবসাদ অবধি। যা কিনা প্রভাব ফেলে পরবর্তীতে বাচ্চার প্রতি মা’র ব্যবহারে। এমনকী বাচ্চারও ভবিষ্যতে কিছু সমস্যা হতে পারে।
• হঠাৎ প্রেগন্যান্সি
পরিকল্পনা না করে হঠাৎ প্রেগন্যান্সি এলে প্রথমেই যেন ঝটকা লাগে। এক ঝলকে ভেসে ওঠে সামনের দিনগুলো। এটা করতে পারব না, সেটা করতে পারব না। চাকরি থাকবে তো? বাকিরা এগিয়ে যাবে। আমি পিছিয়ে পড়ব...। আজকের অনেক মেয়ের কাছেই প্রেগন্যান্সির কখনও ভাল সময় নেই। আজ পড়াশুনো, কাল পরীক্ষা, পরশু প্রমোশন লেগেই আছে। কেরিয়ারের দৌড়ে প্রেগন্যান্সি সেকেন্ডারি ঘটনা। সব সময় চিন্তা কেরিয়ার গোল্লায় গেল। এর জের কেমন হতে পারে তা বলতে গিয়ে ডাক্তার খাস্তগীর একটা ঘটনা শোনালেন। কেরিয়ারের চাপে এক মহিলা বার বার পিছিয়েছিলেন প্রেগন্যান্সি। পরবর্তীতে তিনি যখন সন্তানের জন্ম দেন, তখন বয়স প্রায় চল্লিশের কোঠায়। মহিলার দুটি যমজ সন্তানের মধ্যে একটির জন্মের পরেই মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় সন্তানটি সুস্থ ভাবে বেড়ে উঠলেও মহিলা পড়ে যান অবসাদের কবলে। কিছুতেই আর অন্য সন্তানটিকে কাছে নিচ্ছিলেন না। তাঁর ধারণা প্রথম সন্তানের মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী। দীর্ঘ চিকিৎসার পর তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। এমনিতে হুট করে প্রেগন্যান্সি এলে অনেকের কাছেই সেটা সব কিছু ভেস্তে দেওয়ার সামিল। বাড়িতে মা-বাবা-শাশুড়ি-স্বামী সর্বদা লেগেই আছেন। এটা কোরো না, সেটা কোরো না। মুখে না রুচলেও দুধটুকু খেয়ে নাও। বাইরে গেলে ঘন ঘন ফোন। সব সময় শুয়ে থাকো। স্বাধীনতা গোল্লায়। মেয়েটি যেন একটা বাচ্চা তৈরির মেশিন। এই সময় মেয়েদের অনেক বেশি বিশ্রাম নিতে হয়, এমন ধারণা থেকেই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। খাস্তগীরের মতে, যার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। আর সেটা করতে গিয়েই মেয়েটিকে স্বাভাবিক জীবন থেকে সরে আসতে হয়। ফলে মনে মনে চাপ বাড়ে। তার ওপর দিন যত এগোচ্ছে, ভয়ও তত চড়ছে। কিছু খেলেই বমি। চেহারা ক্রমশ বেঢপ হয়ে যাচ্ছে, সৌন্দর্য চলে যাচ্ছে, মুখে কালো ছোপ, দেখতে বিচ্ছিরি লাগছে। পিরিয়ড বন্ধ হওয়া মানেই অনেকের কাছে মেয়েলি ব্যাপারটাই যেন আর রইল না। সঙ্গে সন্তান ধারণের কষ্ট তো আছেই। মাঝে মাঝে ইনজেকশনের খোঁচা। অনেকের ধারণা প্রেগন্যান্সি মানেই যৌনজীবনের দফারফা। তার থেকেও আসে অবসাদ। স্বামী কি তাঁকে আগের মতো ভালবাসবেন? আবার আগের জীবন ফিরে পাব? পেশায় মডেল এক মহিলা প্রেগন্যান্সির সময় শুধুই চিন্তায় থাকতেন, পেটে দাগ পড়বে না তো! তাই নিয়েই বিষন্ন থাকতেন। ডেলিভারির ছয় মাসের মধ্যে প্লাস্টিক সার্জারি করানোর পর তবে শান্তি! বাচ্চার থেকে জীবিকার চিন্তা বেশি। এত সব কারণ ঘিরে অবসাদ। অথচ কাউকে কিচ্ছুটি বলা যাচ্ছে না। কারণ ছোট থেকে বদ্ধমূল ধারণা মা হওয়া মানেই এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা। মন জুড়ে অপার আনন্দ। সক্কলের কী আহ্লাদ! কিন্তু আমার তো সে সব কিছুই লাগছে না। উল্টে মাঝে মাঝে কান্নাও পাচ্ছে। নয় মাস কী ভাবে টানব? কবে এই যাতনা থেকে মুক্ত হব? সবাই ভাবছে, আমি খুশি। এখন যদি বলি আমি অখুশি, সমাজ কী বলবে? তাই মন খারাপ লুকিয়ে রাখা। সব সময় মনের সঙ্গে লড়াই। নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া চলেছে।
• পরিকল্পনা থাকলেও
আর যাঁরা রীতিমত পরিকল্পনা করে প্রেগন্যান্ট হন, তাঁদের টেনশন আবার অন্য রকম। সন্তান সুস্থ হবে তো? সুন্দর আর ফর্সা হবে তো? আগে একটা বাচ্চা আছে। এবার যমজ হলে খরচ বিপুল। সামলাব কী করে? চিন্তায় রাতের ঘুম চলে গেল। তাই যতক্ষণ না ডেলিভারি হচ্ছে, ততক্ষণ চিন্তার শেষ নেই। আর সব কিছু ছাপিয়ে যে চিন্তা বড় হয়ে দাঁড়ায় তা হল, ডেলিভারি নর্মাল না সিজারিয়ান হবে? ডাক্তার খাস্তগীর জানালেন, ‘‘অনেক মহিলা লেবার রুমে আমাদের অনুরোধ করেন সিজারিয়ান ডেলিভারির জন্য। আর সেটা বাড়ির লোককে জানাতে বারণ করেন। বলেন যে শাশুড়ি বা স্বামীকে বলতে সিজারিয়ান না করলে সমস্যা হত।’’ এ থেকেই বোঝা যায়, তাঁরা পরিবারগত ভাবে কতখানি চাপে ছিলেন। অথচ মনের এত সব দ্বিধা কাউকে খুলে যে হালকা হবেন, এমনটাও অনেকের ক্ষেত্রে হয় না। কারণ আজকের নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। ডাক্তার অয়নাংশু নায়ক বললেন, ‘‘আগেকার দিনের একান্নবর্তী পরিবার এ সব ক্ষেত্রে খুব সহায়ক হত। পরিবারে অনেকেরই পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকত। এখন সে সুযোগ কম। তার ওপর নিজের চিকিৎসকের সঙ্গেও মন খুলে কথা বলতে অনেকেই পারেন না। চেম্বারের বাইরে অনেকে অপেক্ষা করছেন। সেখানে মনের যাবতীয় প্রশ্ন তুলে ধরতে অনেকেই দ্বিধা বোধ করেন। ডাক্তারের সময় নষ্ট হবে ভেবে। আবার অনেক চিকিৎসকও এসব প্রশ্নকে তেমন আমল দেন না। ফলে ভেতরে ভেতরে চোরা স্রোত বয়ে চলে।’’ ডাক্তার নায়কের পরামর্শ, চিকিৎসককে মনের কথা বলুন। অথবা কোনও বন্ধুকে। তেমন কাউকে না পেলে ডাক্তারের চেম্বারে অপেক্ষা করার সময় আরও যাঁরা আপনার মতো মা হতে চলেছেন, তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করুন। নিজের অভিজ্ঞতা তাঁদের সঙ্গে ভাগ করে নিন। মন হালকা হবে।
• চিকিৎসা কখন
ডাক্তার নায়ক জানালেন, প্রেগন্যান্সিতে অবসাদকে কোনও মতেই বাড়তে দেওয়া চলবে না। মন খারাপ লাগলেই নড়ে চড়ে বসতে হবে। নইলে সমস্যা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকবে। দরকারে ওষুধ খেতে হবে। বিশেষত যাঁরা আগে থেকেই কোনও রকম মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন, তাঁদের চিকিৎসা দরকার হতে পারে। তাই সতর্ক হতে হবে। যেমন স্ক্রিৎজোফেনিয়া (বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারণা বা সন্দেহ) এমনকী শুচিবাই, বাই-পোলার ডিসঅর্ডার (যাঁরা কখনও বিষণ্ণ, কখনও উৎফুল্ল), ইটিং ডিসঅর্ডার বা বুলিমিয়ার (নিজেকে আয়নায় সব সময় মোটা দেখা। প্রিন্সেস ডায়নার বুলিমিয়া ছিল। তিনি খেয়েই গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে ফেলতেন) মতো মানসিক সমস্যা থাকলেও খেয়াল রাখতে হবে। চিকিৎসা করালেই সমস্যা অনেকাংশে মিটে যায় বলে জানালেন ডা. নায়ক। কাউন্সেলিং করে বোঝানো হয়, আগে যে ধরনের কাজ করতেন, সেগুলো প্রেগন্যান্সির ছয়-সাত মাস পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারবেন। তার পর কিছু দিনের জন্য বন্ধ থাকলেও আবার আগের জীবনে ফিরতে পারবেন। দরকারে ওষুধও খেতে হবে। মনোচিকিৎসকের পরামর্শ মতো কোনও ওষুধ খেলে প্রেগন্যান্সিতে সেটা তাঁকে না জানিয়ে কখনও বন্ধ করবেন না।
ডা. গৌতম খাস্তগীর: যোগাযোগ: ৯৮৩০৬৬৬৬০৬
অয়নাংশু নায়ক: যোগাযোগ: ৯৮৩০০৫৭৩২৪
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy