Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

আমার মামা

লিখছেন দেবব্রত বিশ্বাসের সহোদরার কন্যা পারমিতা দাশগুপ্তরবিবার হলেই রাসবিহারী। মামার কাছে গান শিখতে যেতাম। দোতলা বাড়ি। মামা থাকত নীচের তলায়। প্রথম দিকে মা-বাবা নিয়ে যেতেন। পরে একাই যেতাম। গান করতে বসতাম যখন, মামা বলত, ‘‘আগে গানটা পড়েন।’’ সবাইকে আপনি-আজ্ঞে করত তো! বলত, ‘‘আপনারা এত খাওয়াদাওয়া করেন, গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না কেন?’’ নিজে গেয়ে, তার পর সবাইকে গাইতে বলত। গান করতে করতে বই দেখা পচ্ছন্দ করত না। বলত, ‘‘আগেই চক্ষু খুইলা দ্যাখেন কী লেখা আছে।’’

‘দিদিমণি’ ও অন্যদের সঙ্গে

‘দিদিমণি’ ও অন্যদের সঙ্গে

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

রবিবার হলেই রাসবিহারী।
মামার কাছে গান শিখতে যেতাম। দোতলা বাড়ি। মামা থাকত নীচের তলায়। প্রথম দিকে মা-বাবা নিয়ে যেতেন। পরে একাই যেতাম।
গান করতে বসতাম যখন, মামা বলত, ‘‘আগে গানটা পড়েন।’’ সবাইকে আপনি-আজ্ঞে করত তো! বলত, ‘‘আপনারা এত খাওয়াদাওয়া করেন, গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না কেন?’’
নিজে গেয়ে, তার পর সবাইকে গাইতে বলত। গান করতে করতে বই দেখা পচ্ছন্দ করত না। বলত, ‘‘আগেই চক্ষু খুইলা দ্যাখেন কী লেখা আছে।’’
খুব ভালবাসত রান্না করতে আর খাওয়াতে। পাবদা মাছ, তেল-কই, মাংস, তরকা…। দারুণ করত মুরগির রোস্ট। বাড়িতে কেউ এলেও মামাই রান্না করে খাওয়াত। মিষ্টি খেত খুব। চায়ে অনেক চিনি। আর রাতে যাদবের সন্দেশ মেখে ভাত।
কখনও আমাদের দুই বোনকে নিয়ে যেত ওর নিজের টিউশানিতে। বাইকে করে।
কালো অ্যাম্বাসাডার কিনল পরে। বাইক চালাত জোরে। বসে থাকা যেত না। কিন্তু চার চাকার গাড়ি ড্রাইভ করত খুব আস্তে।
মামা চাইত গান শিখি। কিন্তু কোনও দিন চায়নি আমি শান্তিনিকেতনের কোনও অনুষ্ঠানে গান করি। প্রথম দিন নিয়ে গিয়েছিল বিশ্বভারতীতে। আমার ইচ্ছে ছিল, অ্যাকাডেমিক লাইন ছাড়া কিছু করব না। ওর ইচ্ছে ছিল গানটাও যেন শিখি। শেষ পর্যন্ত বিশ্বভারতীতে জিওগ্রাফি অনার্স নিয়ে ভর্তি হওয়ার পর, গানের চর্চাও শুরু হল সঙ্গীতভবনে। তখন বিকেলে ক্লাস হত। আমাদের গান শেখাতেন নীলিমা সেন, বীরেনদা।
খুব মনে পড়ে আমার ভর্তির জন্য মোহরদিকে চিঠি লিখেছিল মামা। যখন ইন্টারভিউ দিই, মোহরদি ছিলেন। সিলেক্ট হয়ে যখন প্রণাম করলাম ওঁকে, বললেন, ‘‘খুব ভাল গেয়েছিস। জর্জদা চিঠিতে এত কথা লিখল, কিন্তু তুই যে এত ভাল গান করিস, সেটা লিখল না! ‘আমার ভাগ্নিটা গেল, দেখবেন যেন’। দাঁড়া, জর্জদাকে আমি লিখব।’’

যখন আমি শান্তিনিকেতনে, মামা অনেক চিঠি লিখত, তার উত্তরও দিতাম। মজার সব চিঠি। একটাতে যেমন চিঠি শুরুর জায়গায় আমার মুখের ছবি এঁকেছে। চিঠির শেষে নিজের মুখের স্কেচ!

এক বারের কথা মনে পড়ছে, তখন সবে খালেদবাবুর আঁকা ছবির প্রচ্ছদে ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত’ বেরিয়েছে। আমি বিশ্বভারতী থেকে পাশ করে ভর্তি হয়েছি বর্ধমানে।

মামা শান্তিনিকেতন থেকে ফিরতি পথে আমার সঙ্গে দেখা করতে গেল। সেটা ছিল ২৫ ডিসেম্বর। হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলল, ‘‘যা, বন্ধুদের নিয়ে খাওয়াদাওয়া কর।’’ আর গাড়ি থেকে একটা বই বের করে দিল। ততক্ষণে আমার বন্ধুরা অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য ভিড় করেছে। আমি বললাম, তুমি কী খাবে? বলল, ‘‘আমি আর কী খাব, শক্তিগড়ের ল্যাংচা।’’

সে বারই শেষ শান্তিনিকেতন আসা মামার।

শেষ দিকে রোগা হয়ে গিয়েছিল। কেবল চলে যাওয়ার কথা বলত। মাঝে মাঝে বুকে ব্যথা হত। এ সবের মাঝেও কিন্তু তাসের আড্ডাটা ঠিক বসত সন্ধেয়। অজিতবাবু, শান্তিবাবুর মতো জীবনবিমার কয়েক জন আসতেন। তাঁদের সঙ্গে খেলত। মা বলতেন, ‘‘তুই তো জুয়া খেলিস।’’ রেসের মাঠেও যেত। শনি-রবিবার প্রায়ই জিজ্ঞেস করত, ‘‘বল তো কোনটা লাগবে?’’

কিন্তু কখনও মদ্যপান পচ্ছন্দ করত না। একদিন সন্ধের একটু আগে এসেছেন ঋত্বিক ঘটক। দরজার কাছে দাঁড়ালেন। মামা বলল, ‘‘আসবা না, এখন আসবা না।’’

ঋত্বিক বললেন, ‘‘জর্জদা, টাকা দাও। মোড়ের বাংলার দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।’’ মামা বলল, ‘‘কত দেব, দশ টাকা?’’ এই বলে, মামা দশ টাকা ছুড়ে দিল।

ঋত্বিকের সে দিকে হুঁশ নেই। কে ছুড়ে দিল, তাতে কিছু যায়-আসে না ওঁর। এমন দৃশ্য দু’দিন দেখেছি। মামা বলত, ‘‘আমাকে বিরক্ত কোরো না। টাকা নিয়ে চলে যাও।’’

মামা ঋত্বিককে ভালবাসত খুব। বলত, ‘‘ঋত্বিক মানিকের থেকে অনেক ট্যালেন্টেড। মদ খেয়ে খেয়ে শেষ হল।’’

মনে পড়ে, রাসবিহারীর বাড়িতে গিয়েছিলেন সমরেশ বসুও একবার। মায়া সেন নিয়ে এসেছিলেন। মামা পা তুলে বসে ছিলেন। তো, ঘরে সমরেশ বসু ঢোকার পরও পা নামাচ্ছে না। মায়া সেন এ দিকে ইশারা করে যাচ্ছেন, পা নামাতে। মামা কিছুতেই আর পা নামায় না।

শেষে চলেই গেলেন সমরেশবাবু। মায়া সেন ওঁকে গাড়িতে চাপিয়ে ফিরে এসে বললেন, ‘‘জর্জদা, আপনি এটা কী করলেন?’’ মামা বললেন, ‘‘যে এত অশ্লীল গল্প লেখে, তাকে আমি পছন্দ করি না।’’

মামা ছিল এই রকম।

আরেক বারের কথা মনে পড়ে। উত্তমকুমার মারা গেলেন। তার কয়েক দিন বাদে মামার কাছে গিয়েছি। দুটো চিঠি দেখিয়ে বলল, ‘‘এই দ্যাখ, উত্তমের দুটো শ্রাদ্ধের চিঠি এসেছে। সুপ্রিয়া পাঠাইছে, গৌরীদেবীও পাঠাইছে। কোনটায় যাব?’’ আমি আর কী বলি!

উত্তমকুমার নিয়ে আরেকটা ঘটনা মনে পড়ছে। টিভিতে একবার ‘আলো আমার আলো’ সিনেমাটা হচ্ছে। মামা দেখে বলল, ‘‘বাবা, কী বিচ্ছিরি! উত্তম-সুচিত্রা কী করেছে এ সব! কেউ দেখে! জঘন্য!’’ আমি ভ্রু তুলে হাইমাই করে উঠতে বলল, ‘‘আমার তো দমবন্ধ লাগে।’’

একেবারে শেষ দিকে যখন শরীরটা খুব ভেঙে গেল, মনের দিক থেকেও ভেঙে পড়েছিল। হাত নাড়িয়ে কেবল বলত, ‘‘ভাল নাই। ভাল নাই।’’

হয়তো আমার সঙ্গে গল্প করল। কিন্তু বাইরের কেউ এলে, কথা বলতে চাইত না। শেষের দিকে কেবলই বলত, ‘‘তোকে এই রেকর্ড দিয়ে দিলাম। এই খাতা দিয়ে দিলাম।’’ বলত, কোথায় কী আছে। সব যেন বুঝিয়ে দিতে চাইত।

তখন আমি বর্ধমানে। তিন লাইনের একটা চিঠি পেলাম। লিখেছে, ‘‘মাই ডিয়ার ছোড় ভাগ্নী, হেমন্ত আমারে ২১ মার্চ সম্বর্ধনা দিবে কইছে। তুই সেদিন হস্টেল থেইক্যা আমার কাছে চইলা আসিছ, মায়েরে কইয়া আসিছ রাত্তিরে আমার কাছে থাকবি। পড়াশুনা মন দিয়া চালাইয়া যা— যাতে ফাস্ট ক্লাস পাইতে পারছ। স্নেহ জানিছ— মামা।’’

খুব অবাক হলাম। মামা তো এ সব ব্যাপারে রাজি হওয়ার মানুষ নন। পরে বুঝলাম, হেমন্তবাবু রাজি করিয়েছেন। সে দিন মামার বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। দাড়িও কাটেনি। এ দিকে বিকেলে অনুষ্ঠান। এক মুখ দাড়িতে খুব অসুস্থ দেখাচ্ছিল। মামার ও সব খেয়াল নেই।

হারমোনিয়ম নিয়ে গেয়ে চলল, ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে।’ বুঝলাম, এইটাই উনি সভায় শোনাবেন। আমাকে বলল, ‘‘কী রে, সিলেকশান ঠিক হয় নাই?’’

কাছেই পণ্ডিতিয়া রোডে থাকতেন কনক মামিমা। এসে বললেন, ‘‘জর্জ, তুমি দাড়ি কাটো। তবে তোমার সঙ্গে সংবর্ধনায় যাব। দাড়িতে পানের পিক লেগে থাকে। বাজে লাগে।’’ শুনলই না। বলত, এই তার শেষ সময়। রবীন্দ্রনাথের মতো তাই দাড়ি রেখেছে! দুপুরে মাংস রান্না করে খাওয়ালো।

শেষ দিকে সব শখ-আহ্লাদ থেকে নিজেকে তখন সরিয়ে নিয়েছিল। কেবল বলত, ‘‘খুব তাড়াতাড়ি মারা যাব।’’ কারও কোনও কথা শুনত না।

বিকেলে আমরা সবাই তৈরি হচ্ছি বেরোব বলে, মামা সেই ছাপা লুঙ্গি আর গেরুয়া ফতুয়া পরে হাতে লাঠি নিয়ে রেডি হয়ে গেল। বের হওয়ার আগে, আলমারি থেকে সেন্ট বের করে আমার গায়ে ছড়িয়ে দিল। গাড়িতে যেতে যেতে বলল, ‘‘আইজ আর কুনও গান গামু না। মাথা নিচু কইরা বইসা থাকুম।’’

তাই ছিল। বাড়ি ফিরে সব উপহার আমাকে দিয়ে দিল। বলল, ‘‘বাড়ি নিয়া যাস। আমার মরণের পর সাজাইয়া রাখিস। আজ একটা পর্ব মিটল।’’

মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে আমি গিয়েছি। বলল, ‘‘শোন, আমি আর এক সপ্তাহ আছি। সকালে উইঠ্যা শুনবি, কুখ্যাত গায়ক দেবব্রত বিশ্বাস মারা গেছে।’’

তখন একটু জ্বর আছে মামার। শ্রীকান্ত বলল, ‘‘বাবু কম খাচ্ছেন। শরীর ভাল নাই।’’ মামা বলল, ‘‘শোন, আমি মারা গেলে, অনেকে লুইটাপুইটা অনেক কিছু নেবে। তুই কিন্তু একদম কাঁদবি না।’’ এ সব কথা শুনে কার আর ভাল লাগে! খুব মন খারাপ হয়ে গেল।

রবিবার দেখে এলাম। ঠিক পরের সপ্তাহে সোমবার খবর এল। সব শেষ।

ছুটতে ছুটতে গেলাম। গলি দিয়ে ঢোকা যায় না এত লোক। কোনও রকমে দেহ বের করা হল।

মামার মুখে আগুন দিতে হল আমাকেই!

সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখা

পারমিতা দাশগুপ্তর ছবি ও জর্জের ছবির অনুচিত্রণ: উত্তম মাহালি

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE