Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

নাই বা আমায় ডাকলে...

কেমন ছিলেন মানুষটি? লিখছেন সহোদরা-কন্যা মহাশ্বেতা ভট্টাচার্যলাল মলাটের মোটা একটা খাতা। সেটা বাগিয়ে ধরে ক্লাস সিক্সের মেয়ে অনুনয় বিনয় করছে ভাইবোনেদের— এই একটু শোন না...। কথা শেষ হওয়ার আগেই সবাই বেমালুম হাওয়া।— ‘‘এই রে, দিদি আবার গল্প শোনাবে!’’ কিন্তু খুদে গল্পকারও নাছোড়। শেষে লজেন্স, মিষ্টি, এমনকী পাঁচ-দশ পয়সার মরিয়া ঘুষ। গল্প সে শোনাবেই। তবু শ্রোতা পালায়, দিদি যে বড্ড দুঃখের গল্প লেখে। শুনলেই কান্না পায়।

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

লাল মলাটের মোটা একটা খাতা। সেটা বাগিয়ে ধরে ক্লাস সিক্সের মেয়ে অনুনয় বিনয় করছে ভাইবোনেদের— এই একটু শোন না...।

কথা শেষ হওয়ার আগেই সবাই বেমালুম হাওয়া।— ‘‘এই রে, দিদি আবার গল্প শোনাবে!’’ কিন্তু খুদে গল্পকারও নাছোড়। শেষে লজেন্স, মিষ্টি, এমনকী পাঁচ-দশ পয়সার মরিয়া ঘুষ। গল্প সে শোনাবেই। তবু শ্রোতা পালায়, দিদি যে বড্ড দুঃখের গল্প লেখে। শুনলেই কান্না পায়।

আমার মাসির মনের কল্পনাগুলো কলম বেয়ে পাতা ভরিয়ে তোলা শুরু সেই ছোট্ট বয়স থেকেই।

ইউনাইটেড মিশনারি গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রীর প্রথম লেখা বেরোয় স্কুল ম্যাগাজিনে। ছড়া, ‘চড়ুই’। তার দু’টো লাইন...‘‘কিচিরমিচির তোমার ডাকে মুগ্ধ হয়ে থাকি,/বড় ভাল লাগে আমার তোমাদের এই দল।’’

তারও আগের কথা। মাসির বয়স তখন বছর ছয়। শিশুতীর্থে দুই মেয়েকে নাচ-গানের নানা অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিয়েছিলেন দাদামশাই। সেখান থেকেই ‘কাবুলিওয়ালা’ সিনেমায় মিনির বন্ধুর চরিত্রে প্রথম পর্দায় এসেছিল মাসি। তার পর ‘হারানো সুর’-এ, সীতাহরণ পালা।

মাসির কাছেই শোনা, শুটিংয়ের ফাঁকে ওরা খেলছে। হঠাৎ সামনের একটা বড় গাড়ি থেকে ‘উফ্ কী গরম’ বলতে বলতে বেরিয়ে এলেন দুই অভিনেত্রী। সুচিত্রা সেন আর চন্দ্রাবতী দেবী। নেমেই ওদের দেখে আলাপ করতে গিয়ে বললেন, ‘‘নাম কী তোমাদের?’’ মাসি বলত, “যেই বলেছি আমার নাম সুচিত্রা, ওনার সে কী হাসি!”

খুব ভাল নাচত। দক্ষিণীর ছাত্রী। পাড়ার বিজয়া সম্মেলনী হোক বা ভাইবোনেদের ঘরোয়া অনুষ্ঠান, বাকিদের নাচ শেখানো ছিল ‘বুড়ি’র দায়িত্ব। মাসির ডাকনাম। তবে সবটাই একটা লক্ষ্মণরেখার মধ্যে। একবার পুজোয় সালোয়ার কামিজ পরতে দেখে জ্যাঠামশাই করুণাশঙ্কর ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘এ সব কী? বাড়ির মেয়েরা এ বার সিনেমায় নামবে নাকি?’’ বাড়ি ছিল এতটাই রক্ষণশীল।

অথচ সেই বাড়ি থেকেই কি না বুড়ি প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করল!

বয়সটা তখন সতেরো। ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। খুব ঘনিষ্ঠ ক’জন বন্ধু, জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো পাঁচ বোনের জোট ছাড়া কাকপক্ষীতে টের পায়নি সে কথা। অথচ পাত্র পাড়ারই ছেলে। কনের বাড়ি থেকে তাকালেই দেখা যায় তাদের বাড়ি।

মাসি ক্লাস এইট থেকেই শাড়ি পরে। তাই একটু ঝকঝকে শাড়ি পরে বেরনোটা বাড়ির কারও তেমন নজর কাড়েনি। বরং মেসোকেই বন্ধুর পাঞ্জাবি ধার করে পরতে হয়েছিল। রেজিস্ট্রির পর দু’জনে বাড়ি ফিরে এল। কিন্তু মেয়ের এমন দুঃসাহস বাবা মেনে নেননি। পালিয়ে বিয়ে করলে যা হয়, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল।

বিয়ের পর নিদারুণ দারিদ্রের সঙ্গে লড়তে লড়তে একটা সময় গিয়ে উঠল নাজিরবাগানে। এক কামরার চিলতে ঘর। দরমার পার্টিশন করা বারান্দায় রান্না। আর বাথরুম কিছুটা দূরে। ইট পাতা উঠোন পেরিয়ে টিনের চালের তলায়।

সেই যে লেক প্লেস ছেড়ে ঢাকুরিয়ায় ঢোকা, এলাকাটা আর ছাড়া হল না। এর পর একটা সময় মুকুল আর কল্পা নামে দুই বন্ধুর সঙ্গে প্রত্যেক দিন শ্মশানে গিয়ে বসে থাকাটা নেশার মতো হয়েছিল। কেন? জানতে চাইলে বলত, ‘‘আমার ভাল লাগে।’’ জীবনকে আরও কাছ থেকে জানার চেষ্টা ছিল হয়তো।

কেমিস্ট্রি নিয়ে লেডি ব্রেবোর্ন ভর্তি হলেও খুব অল্প বয়সে মাতৃত্ব সামলাতে গিয়ে কলেজ ছাড়তে হল। তবে নির্বাসন ঘুচে তৈরি হল বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ। পরে যোগমায়ায় বাংলা নিয়ে পড়তে ঢোকে। কিন্তু কলেজে ব্যাগ থেকে খাতার বদলে মাঝে মধ্যেই বেরিয়ে পড়ত মেয়ের মোজা বা ফিডিং বোতল। এক দিন ক্লাসে ঢুকতে ফের দেরি হওয়ায় অধ্যাপিকা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘সুচিত্রা, তোমার কন্যা কি আজও মলত্যাগ করেছে?’’

মাসির কাণ্ডকারখানা বলে শেষ করার নয়। বছর কয়েক আগে হঠাৎ একটা ব্লাড সার্কুলেটরি ম্যাসাজার কিনে ফেলল। মেশিনটায় উঠে দাঁড়ালে থরহরি কাঁপে। তাতে শরীরের রক্ত চলাচল নাকি ভাল হবে। হার্টের ইজেকশ ফ্যাক্টর বাড়বে।

সে তো হল। এক তরুণ ডাক্তার বাড়িতে এসেছেন। তাঁকে সেই যন্ত্রে উঠিয়ে মেশিন চালিয়ে দিল। বেচারি তো আচমকা পায়ের তলার জমি কেঁপে ওঠায় ভয়ে শুকিয়ে কাঠ। খালি বলছেন, ‘‘সুচিত্রাদি বন্ধ করুন।’’ আর মাসি তত বলছে, ‘‘না না অন্তত তিরিশ সেকেন্ড না হলে কোনও উপকারই হবে না।’’

চাকরি জীবনে শুরু পরপর কয়েকটা ছোটখাট কাজ দিয়ে। তার পর ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে। সেই অফিসে এক বার ‘শাহজাহান’ নাটক হবে। পরিচালনা করবেন গীতা দে। তাতে পেয়ারি বাঈয়ের চরিত্র করেছিল মাসি। এর পর থেকে গীতা দে বলতেন, ‘‘সুচিত্রা আমার ছাত্রী।’’

ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ’৭৯-তে ‘ওজন ও পরিমাপ’ দফতরে চাকরি পেয়েছিল। ২০০৩-এ স্বেচ্ছা অবসর অ্যাসিস্ট্যান্ট কন্ট্রোলার হয়ে। প্রথম পোস্টিং ব্যারাকপুর। সে জীবনও ঘটনাবহুল। এক বারের কথা বলি।

মাসির দায়িত্বে ছিল সল্ট লেক থেকে কাঁচরাপাড়া। এক দিন সোদপুরের কাছে একটা তেলের ট্যাঙ্কার ‘সিজ’ করল মাসি। মাস দুই পরে ট্যাঙ্কারের পঞ্জাবি মালিক গাড়ি ছাড়ানোর সরকারি অর্ডার নিয়ে হাজির। মাসি সঙ্গে সঙ্গেই রিলিজ-সই করে দিল। কিন্তু সেই পঞ্জাবি ভদ্রলোক কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না, বিনা খরচায় কাজটা এত সহজে কী করে হয়ে গেল!

শেষে বলেই ফেলেন, ‘‘দু’মাসে আমার খরচ কম হয়নি ম্যাডাম। বাঙালিরা বলে হাঁস ডিম পাড়ে, খেয়ে যায় দারোগাবাবু। কিন্তু আপনি এমনি এমনি ছেড়ে দিলেন? দিদি এটা আপনার লাইনই নয়। আপনার স্কুলে পড়ানো উচিত!’’

জাল বাটখারা চক্র ধরায় গুন্ডারা শাসিয়েছিল। বেআইনি লাইসেন্স দিতে রাজি না হওয়ায় চূড়ান্ত অপমান করেছিলেন এক সিনিয়র। কিন্তু টলানো যায়নি। মানুষটা সেই তখন থেকে নির্ভীক, আপসহীন।

সাহিত্যিক বিমল কর এক বার ‘গল্পপত্র’ পত্রিকায় মাসির লেখা দেখে বলেছিলেন, ‘‘সুচিত্রা তোমার কলমের জোর আছে। নিজের চেনা জগৎটা নিয়ে লেখো। না হলে কিন্তু আমি হাত ভেঙে দেব।’’ মাসি বলত, ‘‘ওটাই জানিস, আমার টার্নিং পয়েন্ট।’’

মাসির সব লেখালেখির ভিতটা বাস্তব অভিজ্ঞতা। তারই পরত থেকে উঠে আসা বলে চরিত্ররা এত জীবন্ত। প্রতিটা লেখার নেপথ্যে আছে কোনও না কোনও সত্যি কাহিনি।

যেমন চাকরিজীবনের প্রথম দিকের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘আমি রাইকিশোরী’। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, চিনা, তিব্বতী, যে সব মেয়ের সঙ্গে কাজ করেছিল, তাদের জীবন যুদ্ধের গল্প। তার সঙ্গে নিজের কথাও।

লেখা শেষ করে পাণ্ডুলিপি জমা দিল এক পত্রিকা দফতরে। কিন্তু মনোনীত হয়নি। পাণ্ডুলিপিটা হাতে করে বাড়ি ফিরে বলেছিল, ‘‘মরা বাচ্চা কোলে করে ফিরলাম।’’ উপন্যাসটা পরে অবশ্য অন্য এক পত্রিকায় প্রকাশ পায়।

লেখালেখি, সাহিত্য, এ সবের বাইরে মাসির আরেকটা জগৎ ছিল। অসম্ভব ভালবাসত গীতা দত্তের গান। গন্ধরাজ, জুঁই ফুল। আর সমুদ্র।

সেই সঙ্গে ছিল রীতিমতো ভোজনরসিক। নিরামিষ নয়। মটন, চিংড়ি, বিরিয়ানি, রাবড়ি, চাইনিজ। একবার বলল, ‘‘চল, এক জায়গায় অক্টোপাসের সুশি করছে খবর পেয়েছি, খেয়ে আসি।’’

ভালবাসত রাঁধতে। একবার পাঁচতারা রেস্তোরাঁর শেফ-এর থেকে ইয়াখনি পোলাও শিখে এল। কিন্তু সেটা বাড়িতে রেঁধে সবাইকে না খাওয়ানো পর্যন্ত শান্তি আছে নাকি! অথচ অদ্ভুত, তার পরই টিভিতে একটা রান্নার শো-এ ডাক পড়ল। তখন ভেবে অস্থির, কী রাঁধবে!

সারপ্রাইজ দিতে খুব ভালবাসত। দুষ্টু হেসে ভুরু নাচিয়ে বলত, ‘‘কী রে, কেমন দিলাম, বল!’’

বারো তারিখও দফায় দফায় ফোনে আড্ডা হয়েছে। ভূমিকম্প নিয়ে, লেখা নিয়ে, বেড়ানো নিয়ে। রাত সাড়ে ন’টায় শেষ বারের মতো হোয়াটস অ্যাপে লিখল, ‘‘বেশি ইয়ার্কি মেরো না, মাটি যে দিন সত্যিই কাঁপবে, বুঝবে।’’ — এক ঘণ্টার মধ্যে সত্যিই এমন কম্পন, আমাদের চারপাশটা পাল্টে গেল পাকাপাকি!

তা-ও এখনও কেমন মনে হচ্ছে, মুনা-মা এই বুঝি দরজা ঠেলে বেরিয়ে বলবে, ‘‘কেমন দিলাম, বল!’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE