Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

শক্তিনিকেতন

খোয়াই। লাল-কাঁকর মাটি। অমলতাস। এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়। পদ্যকারের গল্প খুঁজে বেড়ালেন আবীর মুখোপাধ্যায়সুবর্ণরেখা পেরিয়ে লোকটা হাঁটছে রবিঠাকুরের ঘর-বাড়ির দিকে। হাঁটছে... তিনপাহাড়। মন্দির। ছাতিমতলা। ওপাশে পুরনো মেলার মাঠ। কিঙ্করের ডেরা থেকে বেরিয়ে, রতনপল্লির একলা পথ। লোকটা উত্তরায়ণে। বিচিত্রা-সংগ্রহশালায় ঢোকার মুখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তার চোখ যে গিয়েছে, সংগ্রহশালার সিঁড়িতে। প্ল্যাকার্ডের লেখায়। সেখানে লেখা, ‘জুতা খুলিয়া প্রবেশ করুন’। কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা...

অলংকরণ: শেখর রায়

অলংকরণ: শেখর রায়

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

সুবর্ণরেখা পেরিয়ে লোকটা হাঁটছে রবিঠাকুরের ঘর-বাড়ির দিকে।
হাঁটছে...
তিনপাহাড়। মন্দির। ছাতিমতলা। ওপাশে পুরনো মেলার মাঠ। কিঙ্করের ডেরা থেকে বেরিয়ে, রতনপল্লির একলা পথ। লোকটা উত্তরায়ণে।
বিচিত্রা-সংগ্রহশালায় ঢোকার মুখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তার চোখ যে গিয়েছে, সংগ্রহশালার সিঁড়িতে। প্ল্যাকার্ডের লেখায়। সেখানে লেখা, ‘জুতা খুলিয়া প্রবেশ করুন’।
কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা...
সজোরে লাথি মেরে লোকটা দূরে সরিয়ে দিল প্ল্যাকার্ড!
হায়, হায় করে উঠল চারপাশ!
‘‘এটা কী করছেন শক্তিবাবু!’’
লোকটার স্পর্ধা দেখে ছুটে এসেছেন রবীন্দ্রভবনের অধ্যক্ষ ভবতোষ দত্ত। বিস্মিত তিনিও!
লোকটা যেন উন্মত্ত দরবেশ! জলদগম্ভীর স্বরে বলল, ‘‘এটা কি মন্দির? রবীন্দ্রনাথ কি দেবতা? আমি বিশ্বাস করি মানুষে। মন্দির হলেও মানুষের মন্দির!’’

কে এই ‘শক্তিবাবু’? গিন্সবার্গ, মলয় রায়চৌধুরীদের হাংরি আন্দোলনের ম্যানিফেস্টো লেখক, ‘ক্ষুৎকাতর, যৌনকাতর নয়’-এর কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়?

নাকি, একটু পরেই যিনি রবীন্দ্র-অনুকরণেই লিখলেন ‘দূর বাগানের কেতকী ফুল/ হয়তো এখন ফুটে আকুল/ শেষ শ্রাবণের মেঘে’…

সেই শক্তি?

ঠিক মেলানো যায় না, এই দুই কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে।

যে লোকটা দরাজ গলায় খোয়াইয়ের নিভৃতে বসে সুর বিস্তারে গেয়ে ওঠে কবির পিলু-টপ্পাঙ্গ, ‘আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা’। সে-ই আবার, লাথি মেরে উত্তরায়ণের সিঁড়িতে প্ল্যাকার্ডে লাথি মেরে নিজেই সে-খবর সকলকে জানিয়েও দেয়!

স্ববিরোধ?

শক্তির নিজের লেখা রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত কবিতা ‘স্ববিরোধী’-তে বোধহয় মিলে যায় এ প্রশ্নের উত্তরের ইঙ্গিত।— ‘তোমার বিষণ্ণ গান আমায় করেছে স্ববিরোধী.../ বৃষ্টি শুরু, হলুদ অমলতাসে বৃষ্টি ঝরে পড়ে/ উদাসীন মাঠে বৃষ্টি, রঙিন কাঁকরগুলি হাঁ করে/ ধুলোয় পড়ে আছে।’

শক্তির যখন তিরিশ, তার একটু আগে থেকেই বীরভূমে তাঁর আসা যাওয়া বেড়ে গেল। অনিবার্য গন্তব্য হয়ে উঠল ভুবনডাঙা-শান্তিনিকেতন। কখনও রামকিঙ্করের ডেরা। কখনও সিউড়ির অনতিদূরে কেঁদুয়া।

সুলতানপুর ইস্কুলের পিওনের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তত দিনে নবনী দাস বাউল আখড়া গেড়েছেন কেঁদুয়াতে। সেই আখড়ায় দিনের পর দিন পড়ে থেকেছেন শক্তি।

দাওয়ায় বসে নবনী গান ধরেছেন লালনের, ‘‘সময় গেলে সাধন হবে না/ দিন থাকতে দীনের সাধন কেন জানলে না…।’’

চুর হয়ে শুনছেন শক্তি কবিয়াল। গান শেষে আড় ভাঙে কবির। আশমান-উপুড় ভাল লাগায় জড়িয়ে ধরেন নবনীকে। তাঁকে নিয়ে ‘এলেজি’ও লেখেন।

জয়দেব-কেঁদুলির মেলায় বাউলরাও প্রায় সকলেই শক্তিকে চিনতেন। তাঁর স্বজন ছিলেন তাঁরা। শুধু মুখচেনা নয়, শক্তি তাঁদের ঘর গেরস্থালির খবরও রাখতেন।

কখনও’বা জানুয়ারির রাত্তিরে হাড় হিম করা ঠান্ডায়, অজয়ের নদীগর্ভে বসে গীতবিতান উজাড় করে শক্তি একের পর এক রবিঠাকুর গাইছেন।

কখনও মধ্যরাত কাঁপিয়ে তাঁর দরাজ গলায় খাম্বাজে ধরেছেন— ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়’— এখনও ভোলেনি কেঁদুলির গাঁ-ঘর, বাউল-বসতি!

১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫। এই তিন বছর, শক্তির দোস্ত আয়ান রশিদ খান ছিলেন বীরভূমের পুলিশ সুপার। এই সময়ের সিংহভাগ শান্তিনিকেতন, সিউড়ি, দুবরাজপুর, জয়দেব, রামপুরহাটে কেটেছে শক্তির। তাঁর সঙ্গে কখনও সঙ্গ দিয়েছেন সন্দীপন-ইন্দ্রনাথ, কখনও সুনীল। কখনও একা। রশিদের সঙ্গে গালিব-তর্জমায় মেতেছিলেন শক্তি। প্রকাশিত হয় ‘গালিবের কবিতা’।

বইয়ের ভূমিকায় শক্তি লিখছেন, ‘‘আজ বছর দেড়েক হলো। এখনো হালে পানি পাওয়া যায়নি। যাবে কী করে? দুরন্ত দিনপঞ্জী বশে এনে তবেই গালিব-তর্জমা!... বাসে অর্থ খেলো। আমোদে খেলো শতগুণ।’’

শেষে বোলপুর ট্যুরিস্ট লজ। শান্তিনিকেতনের নিভৃতিতে একদিন শেষ হল অনুবাদের কাজ। শক্তি তত দিনে গালিবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছেন।

রশিদ সেই সময়ের শক্তির কথা বলতে গিয়ে লিখছেন, ‘‘দেখেছিলাম গালিবের প্রতিটি পঙক্তি কীভাবে তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। শক্তি-গালিব বা গালিব-শক্তি একাকার হয়েছিল তার অনুবাদেই— ‘কাঁদতে কাঁদতে ফুরিয়ে যাওয়া এমন সহজ আমার কাছে/ যেমন সহজ মেঘ ঘনালে ছটফটিয়ে বৃষ্টি বাজে।’’’

‘‘কিঙ্করদা, ও কিঙ্করদা...’’

খোয়াইয়ে পলাশ ফুটলে শক্তি যেন আর নিজেকে সামলে রাখতে পারতেন না। কোপাইয়ের চরে উতলা চাঁদের নীচে ভিজতে ছুটতেন কবি ও কাঙাল।

কিঙ্কর শক্তিকে ‘কবি’ বলতেন। তাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপের দিন ছিলেন রশিদসাহেবও। পরে ‘কিঙ্করদা’র ডেরায় গেলেই বাইরে থেকে শক্তি বুক চিতিয়ে হাঁক দিতেন। রবীন্দ্রনাথের গান-পদ্য আর অফুরন্ত বাংলা মদে তাঁদের রাত যে কখন শেষ হত, হুঁশ থাকত না কারও।

অশোক-কিংশুকের বেড়ার ওপাশে লালমাটির দেশে, কিঙ্করের সঙ্গে বেসামাল হয়ে দিনযাপনের কথা শক্তি নিজেই লিখেছেন।

সেবার রিকশা রেখে শক্তি ঢুকতেই কিঙ্কর বললেন, ‘‘রিকশা ছাড়লে না? কোথাও যাবে নাকি?’’

‘‘না তো, আপনার কাছেই এসেছি।’’

‘‘তাহলে?’’

‘‘থাক, কিছুক্ষণ।’’

জমানো অভিমানে কিঙ্কর বলেন, ‘‘হ্যাঁ, সেটা ঠিক। ভালো না লাগলে কেটে পড়তে পারবে। বুড়োমানুষের কাছে আজকাল আর কেউ আসে না। বেশ আছি। একা-একা।’’

শান্তিনিকেতনে সেবার দিনভর রিকশা করে খুব উড়েছিলেন শক্তি আর কিঙ্কর। বোলপুর, ভুবনডাঙা, গোয়ালপাড়া। দাউ দাউ দ্বিপ্রহরে রিকশায় যেতে যেতে, নেশায় চুরমার দু’জন। ওঁদের জরুরি কথাবার্তায় কান পাতি আমরা। শুনি কিঙ্কর বলছেন, ‘‘...আচ্ছা, একবার বল্লভপুর ঘাটের দিকে যাওয়া যায়?’’

‘‘কেন যাবে না? চলুন। দুটো বোতল তুলে নিই?’’

‘‘অতটা নেবে? একটাই নাও বরং।’’

‘‘থাক না দুটোই। নষ্ট তো আর হবে না?’’

‘‘তা বটে। ওখানে তোমায় খুব ভালো হাঁড়িয়া খাওয়াব। শোরের মাংস খাও? যা রাঁধে না সাঁওতাল ছুঁড়িগুলো! ফার্স্টক্লাস। চলো, আজ দুজনে মিলে একটা পিকনিক সেরে আসি। আমরা অবশ্য বেশিক্ষণ থাকব না। খেয়ে-দেয়ে ক্যানালের ধারে গিয়ে বসব। আকাশমণির ছায়ায় বসে গুরুদেবের গান গাইব চেঁচিয়ে।...’’

ওঁদের রিকশা ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে লালমাটির পথ ধরে বনেরপুকুর ডাঙার বাঁকে। হাওয়ায় হাওয়ায় আর শোনা যাচ্ছে না দু’জনের কথা।

•••

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শক্তির প্রথম আলাপ কবির মৃত্যুদিনে!

তখন শক্তি ৮/৯ বছরের নিতান্তই বালক। দাদামশাই আর এক বিধবা মাসির সঙ্গে বহড়ু গ্রামে থাকতেন।

‘বাইশে শ্রাবণ’ শীর্ষক এক লেখায় শক্তি লিখছেন, ‘‘সে দিন দাদামশাই হন্তদন্ত হয়ে ইস্টিশান থেকে ফিরলেন বিকেলবেলা। ...ঘরে গ্যাসবাতি জ্বালালেন না। ...পড়াশুনোতে বসা হল না সেদিন। দাদামশাই এক সময় শুধোলেন, ‘তুমি রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছ? কবিতা পড়েছ তাঁর? খবর এসেছে, তিনি মারা গেছেন।’’’

আর কবিকে প্রথম দেখলেন, তার কিছু দিন পরেই জয়নগরে সিনেমা হলে বসে, নিউজ-রিলে। ছবি শুরু হওয়ার আগে, রবীন্দ্রনাথের মরদেহ নিয়ে যাওয়ার ছবি দেখে শক্তি কেঁদে ফেলেছিলেন। হল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন মাসির সঙ্গে।

শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের মধ্যে মোহরের গান শক্তিকে খুব টানত। ‘দিদি’ বলে প্রণাম করে মোহরকে বলতেন, ‘‘এখানে এসে তোমার সঙ্গে দেখা না করে গেলে আমার শান্তিনিকেতন আসা পূর্ণ‌ হয় না।’’

•••

পাখি-রং ভোর।

ঘুম ভেঙে শক্তি গিয়ে বসছেন ফলপট্টির চায়ের দোকানের কালো বেঞ্চে। তার চোখের তারায় শ্রাবণের ছন্নছাড়া স্মৃতি! একমুখ দাড়ি, চেক শার্ট। কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা। আড়মোড়া ভেঙে, ভরাট গলায় হাঁক দিচ্ছেন, ‘‘কে আছিস, চা দিবি।’’ একটু পরেই ধরাবেন সিগারেট।

যাঁরা শান্তিনিকেতনে শক্তিকে প্রথম দিকে দেখেছেন, তাঁদের কাছে এ সব খুব চেনা দৃশ্য। চেনা মন্তাজ। শক্তি হেঁটে যাচ্ছেন শালবীথি, সুবর্ণরেখা, আশ্রমমাঠ পেরিয়ে আদিগন্ত খোয়াইয়ের দিকে। কাঁধের ঝোলায় কি নতুন পদ্যর খাতা? শালবনের বিজনে একটু থেমে থেমেই হাঁটছেন যেন।—

‘আষাঢ়ের বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলো শালের জঙ্গলে/ তবুও নও ব্যথায় রাতুল/ আমার সর্বাংশে হলো ভুল/ একে একে/ শ্রান্তিতে পড়েছি নুয়ে। সকলে বিদ্রুপভাবে দ্যাখে...’।

কীসের যে এত দহন?

উজাড় মর্মশোক!

•••

শক্তি-সুনীল শান্তিনিকেতন গেলে, বরাবরই জুড়ে যেতেন জেলার কবি-গদ্যকাররা। তাঁদের স্মৃতিতে আজও ঘোরেফেরে শক্তির জাঁহাবাজ জীবনের নানা জলছবি।

জেলার কবিরা শক্তি-সুনীলের সঙ্গে মেঘমেদুর দোলের দিন সকালে গৌড়প্রাঙ্গণে বৃষ্টি ভিজে দাঁড়িয়ে আছেন। শক্তি সিগারেট ধরানোর জন্য দেশলাই জ্বালাচ্ছেন। হাওয়ায় বার বার নিভে যাচ্ছে আগুন। এক তরুণ শক্তির দিকে দেশলাই জ্বেলে এগিয়ে দিতেই, শক্তি থুতু ছিটিয়ে দিলেন তাঁর মুখে!

সবাই অপ্রস্তত। একটু পরেই সবাই দেখল, সেই কবির সিগারেটেই টান দিচ্ছেন শক্তি। আরও দেখল, তরুণ কবিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে শক্তি বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন!

‘১৪০০ পত্রিকা’র সম্পাদক প্রদীপ ভট্টাচার্যর মুখে সে দিনের কথায় কেবলই মনে পড়ে যাচ্ছিল, হেমন্তের হরকরা শক্তির কবিতার লাইন, ‘কোথায় তোমার দুঃখকষ্ট, কোথায় তোমার জ্বালা/ আমায় বলো, আমারই ডালপালা’।

•••

এক সময় দক্ষিণপল্লি, এন্ড্রুজপল্লিতে পরিচিতদের বাড়িতে গিয়ে রাত-বিরেতে শক্তির রিকশা থামত নিত্য।

দরজায় রাতের কড়া নেড়ে রিকশাওয়ালার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। পিকনিকে ঢুকে চিৎকার করে উঠতেন, ‘‘বাতি নিভিয়ে দাও, বাতি নিভিয়ে দাও। আজ জ্যোৎস্নায় পিকনিক হবে।’’

শেষ পর্যন্ত কোথায় যে থাকবেন, তা জানত শুধু তাঁর মর্জি! তাঁকে নিয়ে শান্তিনিকেতনী গৃহস্থের ‘অস্বস্তি’-ও কম ছিল না!

একবার যেমন ঘটেছিল বিশ্বভারতীর অধ্যাপক উজ্জ্বল মজুমদারের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে শক্তির আলাপ অনেক কালের। কফি হাউসে এক বাংলা-বিকেলে শক্তি তাঁকেই পড়ে শুনিয়েছিলেন প্রথম উপন্যাস ‘কুয়োতলা’। শান্তিনিকেতনে উজ্জ্বলবাবু থাকতেন এন্ড্রুজপল্লির কোয়ার্টারে।

এক সন্ধেয় রিকশার শব্দ শুনে তিনি দেখলেন, ‘‘একটা রিকশা আমার কোয়ার্টাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কে একজন পা তুলে দিয়েছে রিকশাওয়ালার ঘাড়ে। আর-একজন হেঁটে আসছে— শক্তি! ঠিক ‘প্রকৃতিস্থ প্রকৃতি’র মতো নয় মনে হল। ওকে দেখে নিজেকে ভিতু ভিতু গেরস্থ ভাবছি। একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু বারান্দায় উঠে এসে জড়িয়ে ধরল, একেবারে ধাত ছাড়েনি দেখে ভালো লাগল।’’

কে কী ভাবল, তাতে কোনও দিনই বোহেমিয়ান শক্তির কিছু এসে যায়নি। জীবদ্দশাতেই লিজেন্ড শক্তিকে কেঁদুলির মতো সত্তরের দশকে দেখা যেত শান্তিনিকেতনের পৌষমেলাতেও। কালোর দোকানে তাঁকে ঘিরে, তাঁর খপ্পরে পড়ে থাকত প্রচুর তরুণ-তরুণী। সেই শক্তি এখনও অনেকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। উজ্জ্বল তাঁর অস্থির, টগবগে অস্তিত্ব নিয়ে।

বিরাশি সালের একটি ঘটনার কথা বলছিলেন শান্তিনিকেতনের ‘চতুর্দশী’ পত্রিকার সম্পাদক মানস বন্দ্যোপাধ্যায়।

সেবার নাট্যঘরে সাহিত্যমেলার আসর বসেছে। সভাপতি শিবনারায়ণ রায়। দুই বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের ভিড় উপচে পড়ছে।

এপার বাংলা থেকে আমন্ত্রিত শক্তি-সুনীল-গৌরকিশোর ঘোষেরা। দুটি করে কবিতা পাঠ বরাদ্দ সকলের জন্য। কবিতা পড়তে উঠলেন মেদিনীপুরের এক কবি। দুটি কবিতা পাঠ করে, ভুল করে তৃতীয়টি যেই না পড়বেন, তাঁকে নামিয়ে দিলেন বিশ্বভারতীর কর্তা ব্যক্তি!

শক্তি এর পরই পড়তে উঠলেন। তবে দুটি নয়, পড়লেন একটিই কবিতা। —‘অবনী বাড়ি আছো?’। সভায় ছিলেন মানস। বাকিটা তাঁর জুঁই স্মৃতি থেকে শুনে নেব।—

‘‘শক্তিদা বললেন, ‘আমার দ্বিতীয় কবিতাটা ওই মেদিনীপুরের কবিকে উৎসর্গ করছি। আর উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করছি, এভাবে কোনও কবিকে থামাবেন না। থামানো উচিত নয়।’ শক্তিদা নেমে চলে গেলেন!’’

•••

ইচ্ছে ছিল শান্তিনিকেতনের কোনও বাড়ির ছাদে ঘর বানাবার!

শেষবার শান্তিনিকেতন গিয়ে বলেও ছিলেন, বন্ধু ‘‘সত্যর বাড়ির ছাদে বাড়ি করব। ছাদের উপর ঘর হবে, অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাবে।’’

সে ঘর আর হল কই!

শান্তিনিকেতনে থাকলে, শক্তি প্রায়ই সুনীলের ফুলডাঙার বাড়ির পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে যেতেন। এমনও হয়েছে, পূর্বপল্লি গেস্ট হাউস থেকে মজলিশ ভেঙে ছুটেছেন শ্যামবাটি ক্যানাল পেরিয়ে ফুলডাঙায় ‘একা এবং কয়েকজন’। ‘দেশ’ পত্রিকায় শক্তির স্মরণ সংখ্যায়, সে বাড়িতে শক্তির সঙ্গে শেষ স্মৃতি লিখেছিলেন সুনীল।—

‘‘সকাল সাড়ে দশটা আন্দাজ কেউ আমার নাম ধরে ডাকল। শান্তিনিকেতনের বাড়িতে আমি তখন কাগজ-কলম খুলে বসেছি, দোতলার ঘরে। কেউ দেখা করতে এলে একতলা থেকে ডাকে, কিংবা খবর পাঠায়, এই ডাক দ্বিতীয়বার শুনেই চিনতে পেরেছি শক্তির কণ্ঠস্বর, সে সরাসরি ওপরে উঠে আসছে। ঘরে ঢুকে শক্তি বলল, এ কী! আজই লেখাপড়া শুরু করে দিয়েছ?

কলম বন্ধ করতে করতে আমি বললাম, কী করি বলো, যাবজ্জীবন দণ্ডিত আসামির মতন অবস্থা যে।’’

শক্তি এসে পড়লে আর কি লেখালিখি হয়? সেদিনও শক্তি সুনীলকে লিখতে দেননি। নতুন করে কৃত্তিবাস করার পরিকল্পনা শুনিয়েছিলেন।

ফেরবার আগে, শক্তি যথারীতি মদ্যপানের জন্য আব্দার করেন। স্বাতী আপত্তি জানান। শক্তি নাছোড়।

সুনীল লিখছেন, ‘‘নিজের স্ত্রীর কাছে সাধু সাজবার জন্য আমি বললাম, শক্তি যখন এত করে বলছে, দাও একটু। কৃত্তিবাসের ব্যাপারটা তো সেলিব্রেট করা যেতেই পারে। শক্তির সঙ্গে এত নিরিবিলিতে অনেক দিন বসা হয়নি। স্বাতী বলল, তা হলে ঠিক দুটো। তার বেশি নয়। তারপর আমি বোতল সরিয়ে নিয়ে যাব। শক্তি বলল, আড়াই! আধখানা গ্রেস দিও!’’

জীবনের খরস্রোতে ভাসতে ভাসতে ঠিকানাবিহীন শক্তির শেষবেলার ঠাঁইও ছিল শান্তিনিকেতন। সে তুমুল শ্রাবণ হোক অথবা ভাদ্রের বিপুল দ্বিপ্রহর, বিশ্বভারতীর উৎসবে দেখা মিলত তাঁর। দোলের দুপুরে সুবর্ণরেখায় ইন্দ্রনাথ মজুমদারের আড্ডাতেও সেই ছিল যেন প্রতিবারের মধ্যমণি।

সুবর্ণরেখার আড্ডা নিয়ে একবার বন্ধু জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন করেন শক্তিকে।—

‘‘ছোট ছোট গেলাশে করে তোমরা কি শিঙাড়া আর জিলিপি খাচ্ছিলে?’’

হেসে ফেলেন শক্তি। বলেন, ‘‘সুনীলটা ঠিক বুঝতে পারে। তখনই ও ইন্দ্রনাথকে বলেছিল, খাওয়াচ্ছ লাল চা, লোকে তো দেখে ভাববে... শক্তি-সুনীল দোলের দুপুরে লেবু মিশিয়ে চা খাচ্ছে এ কথা কি মানবে কেউ? তা নামই যখন হল, রামই বের করো।’’

•••

ছাত্র জীবনে ক্লাসছুট, স্বেচ্ছাচারী শক্তি আনন্দবাজার থেকে অবসর নেওয়ার পর বিশ্বভারতীর অনুরোধে ৯৫ সালে পড়াতে রাজি হয়েছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ‘ভিজিটিং’ প্রফেসর হিসাবে যোগ দিয়ে, স্ত্রী মীনাক্ষীদেবীকে নিয়ে উঠেছিলেন রতনকুঠীতে।

সেখান থেকে পূর্বপল্লি গেস্ট হাউস। ১৯ নম্বর ঘর। শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন সে-ঘরেই। সেই ঘরে বসেই বৃষ্টির রাতে বাংলা বিভাগের পুনর্মিলন উৎসবের স্মারকপত্রের জন্য লিখলেন শেষ কবিতা।—

‘হঠাৎ অকাল বৃষ্টি শান্তিনিকেতনে/ রাতভোর বৃষ্টি হল শান্তিনিকেতনে/ আমের মঞ্জরী পেল বৃষ্টি ও কুয়াশা/ বসন্তের মুখোমুখি শিমুল পলাশ।’

বাংলা বিভাগে শক্তির প্রথম ক্লাস ২১ ফেব্রুয়ারি। ‘পদ্য লেখা শেখার ক্লাস’-এ যে দু’ই ছাত্রের কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে ক্লাস নিতে যেতেন শক্তি, তাঁরা হলেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী, কবি নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিল্পী বিক্রম সিংহ খাঙ্গুরা। শক্তির ক্লাসে ছন্দের পাঠ নেওয়ার দিনের স্মৃতি, কবি নীলাঞ্জনের স্মৃতিতে আজও অমলিন।—

লালমাটির কবিয়াল

‘‘বিক্রম ডান দিকে, আমি বাঁদিকে। দেখতাম, শক্তিদা উদাসভাবে তাকিয়ে থাকতেন পূর্বপল্লির গাছগুলোর দিকে। রোজ পথ থেকে কুড়িয়ে আমলকী খেতেন। আর ক্লাসেই কবিতা লিখে, আমাদের ছন্দের পর্ব বিভাজন করতে দিতেন। বলেছিলেন, ‘ভাবছি, একটা আত্মজীবনী লিখব। তোর মতো একটা খেরোর খাতা এনে দিস তো!’’’

শক্তির স্মরণে পদ্য লিখেছিলেন বিক্রম, ‘...বিপরীত মুখে চলে যাওয়া রাজপথ কতোটা সময় রেখে যায়— আয়ুহীন মাপকাঠি?/ ক্রমশ ডুবে যাওয়া লালচাঁদ আর/ বৃষ্টিতে ভিজে চুপ্পুড় শালবন...’।

•••

গদ্যে-কবিতায় তো কবেই শক্তি বলতে শুরু করেছিলেন ‘ফুলগুলো সব ঝরল, তা কি পাতার শোকেই?’

শান্তিনিকেতনে শেষবার এসেও প্রায়ই বলছিলেন, ‘‘এখনি যাব না... একাকী যাবো না অসময়ে, বাঁচতে হবে, অন্তত আশি পর্যন্ত।’’

সামনের মানুষকে হঠাৎ প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন, ‘‘কী বলো, হবে না?’’

হল না।

তার আগেই চলে গেলেন!

•••

শান্তিনিকেতনেই শক্তির শেষ পদ্য পাঠ। মার্চের উনিশ তারিখ, বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ছিল একটি কবিতা পাঠের আসর। ছিলেন সুনীল ও শরৎ-ও। শক্তি প্রথম পড়লেন।— ‘সেগুন মঞ্জরী হাতে ধাক্কা দাও, জাগাও আমাকে/ আমি আছি বিষ ঘুমে, জাগাও আমাকে’।

কী তীব্র আকুতি পাঠজুড়ে!

একটার পর একটা পড়ে যাচ্ছেন শক্তি। ভরাট গলায়। মন্ত্রমুগ্ধ সকলে। বেখেয়াল শক্তিকে একসময়, পাশ থেকে বন্ধু সত্য সাঁই সতর্ক করলেন—

‘‘শক্তি অন্যদের সুযোগ দাও।’’

ঘোর ভেঙে শক্তি বললেন, ‘‘আচ্ছা, শেষ করছি! শেষে আনন্দভৈরবীটা একটু পড়ি?’’

•••

নিশি ডাকা ভোরে, টেলিফোনে টেলিফোনে ঘুরল কবির শোক-সংবাদ!

চলে যাওয়ার খবরে মীনাক্ষীদেবী এলেন শান্তিনিকেতন। এলেন আরও অনেকে। তাঁদের স্মৃতি—

এসেছিলেন তাঁর প্রেসিডেন্সির শিক্ষক, ভূদেব চৌধুরী। মীনাক্ষীদেবী বললেন, ‘‘আপনার ছাত্র ফাঁকি দিয়ে চলে গেল!’’ ভূদেববাবু কবি-জায়ার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘‘ও যে চিরকালের ক্লাস পালানো মা, তুমি আর কত দিন ধরে রাখতে পারবে!’’

•••

শান্তিনিকেতনে শক্তির শেষযাত্রায় তাঁকে স্টেশনে পৌঁছবার জন্য অ্যাম্বুল্যান্সও জোটেনি!

ঘি রঙের ডোরাকাটা পাঞ্জাবি, পাজামায় বরফের বিছানায় ঘুমিয়ে শক্তি। জিপে করে দেহ পৌঁছল বোলপুর স্টেশনে।

রবিঠাকুরকে বিদায় জানানোর প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক পর, আর এক প্রিয় কবিকে চোখের জলে ভেসে শেষ প্রণাম জানাল বোলপুর-শান্তিনিকেতন!

পা দুটি হাঁটু অবধি, বেরিয়ে রইল জিপের বাইরে। সারাটা পথ!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE