দিনে দিনে কত কিছুই যে ঝরে পড়ল বাঙালির জীবন থেকে!
দুরু দুরু বুকে খাম খুলে চিঠি পড়ার দিন গত। প্রেমের কথাকে হাইজ্যাক করেছে মোবাইল ফোন, স্মার্ট ফোন। এই সেদিন আনুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘোষণা হল টেলিগ্রামের।
নিজের সঙ্গে একলা হওয়া, কথা বলার জায়গা হারাচ্ছে বাঙালি। সেই ছাদ, চিলেকোঠার ঘর, পাড়ার সব রক কোথায়?
বয়ঃসন্ধিতে পা রাখলে নাকি এমনি এমনি কবিতা আসত বাঙালির। আর আসে? জানি না।
একলা হওয়া— দক্ষ মনোবিদরা জানেন— ঠিক হালকা হওয়া নয়, বরং ভারী হওয়া। মনের ভিতরেও ভিড় থাকে, অনেক সময়ই পছন্দের চেয়ে অপছন্দের লোকের বেশি আনাগোনা।
এই ভিড়াক্রান্ত মনকে নির্জন করার এক আবিষ্কার হল, বলা চলে, ডায়েরি লেখা। সারা দিন যা যা ঘটে গেল জীবন ও মনের উপর দিয়ে তাকে তাজা থাকতেই, নিখুঁত নিটোল ও সৎ ভাবে দিন শেষে লিখে ফেলা। অনেকটা শুতে যাওয়ার আগে আয়নায় নিজের স্বাভাবিক, অপ্রসাধিত মুখটা দেখা।
কবি সুনীল নাকি যৌবনে মার্কিন দেশের আইয়োয়ায় কবিতার কর্মশালায় থাকাকালীন এক রাতে উলঙ্গ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি কি এই করবে, না দেশে ফিরে কঠিন অবস্থায় পড়ে কবিতার পাতার সামনে বসবে?’
সুনীল ফিরে এসেছিলেন। ওপরের দৃশ্যটা তিনি পরে বলেছেন, ডায়েরিতে লেখেননি। সুনীল ডায়েরি লিখলে এটা তার সেরা এন্ট্রি হয়ে থাকত নিশ্চয়ই। কে জানে, উনি কবিতা লেখাকেই ডায়েরির বিকল্প করেছিলেন কিনা।
কবিতাকে কার্যত ডায়েরির কাজে লাগিয়েও বোদল্যার কিন্তু এক আশ্চর্য রোজনামচা রচনা করে গেছেন ‘জুনো অ্যাঁতিম’ (অন্তরঙ্গ দিনলিপি) নামে। তাতে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ার আগে এক ট্র্যাজিক এন্ট্রি রেখেছেন শেষ জীবনে।—
“আজ, ১৮৬২-র ২৩ জানুয়ারি, একটা ভয়ঙ্কর বার্তা পেলাম, হঠাৎ উন্মাদনার পাখনার ঝাপটার ঠান্ডা বাতাস এসে লাগল।”
সৎ ভাবে লিখলে ভাল দিনের কথা, মন্দ দিনের কথা মিলেমিশে ডায়েরিও জীবনের অনুকরণে একটা জীবন হয়। টলস্টয় তাঁর বহুখণ্ড ডায়েরিকে বলেছিলেন ‘আমার জীবন’। আর ইংরেজি এসেইস্ট (রচনাশিল্পী) ফ্রান্সিস বেকন তাঁর এক রচনায় সিদ্ধান্ত করেছেন, “তাহলে ডায়েরিকেই কাজে লাগানো হোক।” কারণ? ওই শৈলীতেই জীবন অনেকটা জীবনের মতো থেকে যায়? গুরুত্ব দিয়ে লিখলে আত্মজীবনীর প্রয়োজন থাকে না? কিন্তু এ সব অনেক বড় ব্যাপার। দিনের শিক্ষা, ভুলভ্রান্তি, বিবেক তাড়না নিয়েও যে এককালে বাঙালি রোজনামচা বাঁধেনি তা নয়। গানের মতো এও এক রোজকার রেওয়াজ ছিল। এখন ফেসবুক এসে এই স্বমুখ দর্শন এক অন্য জায়গায় পৌঁছেছে। নিজের থেকে পালানোর জন্য ফেসবুক, সেলফি, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটারের চেয়ে ভাল হাঁড়িকাঠ নেই। প্রতিদিন জন্মে প্রতিদিন মৃত্যু।
পরদিন এক অন্য মুখ, এক অন্য কহানি। ফলত ঝরনা কলম, হাতে লেখা পৃষ্ঠা, ল্যান্ডফোন, গানের এল পি, জ্ঞানের ছত্রিশ খণ্ড ব্রিটানিকা এনসাইক্লোপিডিয়া কিংবা অ্যানালগ ক্যামেরার মতো সামগ্রী খরচের খাতায়।
ব্যয় সংকোচের জন্য এ বছর দেখলাম বেশ আঁটা পড়েছে বড় বড় কোম্পানির ডায়েরি আর ক্যালেন্ডার বিতরণে। ডায়েরি নাকি পাওয়া হয় অন্য কাউকে দেবার জন্য। আর তারিখটারিখ তো মোবাইলেই আসে, দেওয়ালে রাখার জন্য যে সুন্দরী নগ্নিকাদের নিয়ে ক্যালেন্ডার হয় তা তো মানীগুণীধনীদের জন্য তৈরি, আম জনতার তাতে কী এল-গেল।
অতএব অবাক হইনি যখন তরুণ আইটি ইঞ্জিনিয়র সায়ন মুখোপাধ্যায় চোখ গোল করে বলল, ‘ডায়েরি! সেটা কী? খায় না মাথায় দেয়?’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘দিন শেষে নিজের কথা কিছু লিখিস না কোথাও?’
বলল, ‘আমাদের আবার দিন-রাত আছে নাকি? সাইবার ওয়র্ল্ডে দুটো টাইমব্লক— কাজ আর নো-কাজ। নো-কাজের সময়টা হল ফেসবুক, চ্যাট আর কনফারেন্সিং-এর। এখানে ডায়েরি ঢুকবে কোথায়?’
বললাম, ‘কোনও পার্সোনাল ফ্যাক্ট শিট রাখিস না? কী করলি, কী করবি, কী চাস বা না-চাস?’
উত্তর এল, ‘খেপেছ স্যার? এই সাইবার জগৎটা অন্যরা কী করে যাচ্ছে ফলো করার জন্য। নিজেকে দেখার জন্য নয়। বরং বলতে পারো নিজেকে প্রোজেক্ট করার জন্য, যেটা নিজেকে দেখা নয়। ও-কে?’
নবীন প্রজন্মের থেকে নিজেকে কখনও এতটা দূরবর্তী মনে করিনি যা এই ডায়েরির খোঁজে বেরিয়ে করতে হল। রাজারহাটের আরেক আই টি একজিকিউটিভ সদ্যবিবাহিত তরুণ রাহুল চট্টরাজ তো সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিল, ‘ডায়েরি ব্যাপারটা দেখেছি বটে, তবে সিনেমায়।’
বলে কী, ডায়েরি দেখেছে, কেবল সিনেমায়! কেন, বাবা-মা কেউ ডায়েরি লেখেননি? জিজ্ঞেস করাতে বলল, ‘বাবা চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন মার্চেন্ট নেভিতে। সেখানে সন্ধেবেলায় জাহাজের হালহকিকত ডিটেলে নোট করতে হত। কখনও সময় পেলে মাকে চিঠি লিখতেন। ওই!’
‘তাহলে নিজের কথা কিছু নোট করার হলে?’ জিজ্ঞেস করতেই হল। তাতে জবাব দিল, ‘জীবনে যা কিছু রাখার, বলার, শোনার সব পিসি আর আইফোনে। ওটাই ডায়েরি, ওটাই বায়োগ্রাফি। ওটাই বলে দেবে আমি কে, কী, কেন! কলমে তো কিছুই লিখি না এখন, চেক সই করা ছাড়া। আর কিছু?’
কী, আর কিছু? পেপারলেস ওয়র্ল্ডের মুখে পড়ে নিজেকে ওয়েটলেস লাগছিল, যেন হাওয়ায় ভাসছি। ভাসার আরেকটা কারণ আমার বিদেশের বাঙালি বন্ধু তৃপ্তি চক্রবর্তীর একটা টেলিফোন সেই সকালে। তৃপ্তি টরোন্টোর বিখ্যাত বেক্রেস্ট হসপিটালের কর্মী, দীর্ঘ দিন প্রবাসী, মধ্য পঞ্চাশের তরতাজা পুরুষ। তাকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম ডায়েরি রাখে কিনা।
বলল, ‘রাখি। তবে বাংলা গানের লিরিক লিখে রাখার জন্য।’ ওহ্, বলতে ভুলে গেছি, তৃপ্তি চমৎকার হেমন্ত, মান্না, শ্যামল, সুবীর আর পিন্টুর গান গায়। টরোন্টোর বাঙালি মহলে এই কারণে বেজায় কদর। বললাম, ‘সে তো দেখেইছি। ডায়েরির পাতা উল্টে উল্টে গাইছ। কিন্তু মনের কথা লেখার জন্য ডায়েরি খোলো না?’
বলতেই সচিনের মতো একবার ড্রাইভ ঝাড়ল যেন, ‘দরকার কী? আমার তো অ্যাপেলের আইক্লাউড অ্যাকাউন্ট আছে। আমার সব তোলা আছে ওই মেঘে। পৃথিবীর যেখানে খুশি, যে কোনও দক্ষ সেটে ওই সব তথ্য আমি ডেকে নামাতে পারি। কলম পেশার ব্যাপারই নেই।’
তৃপ্তি হেমন্তর গান বড় ভাল গায় বলেই হেমন্তবাবুর একটা স্মৃতি ফিরে এল। একদিন একটা মোটা লাল খাতা হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘একটু পড়ে দেখো। মা’র ডায়েরি।’
বাপ রে, কী জিনিস সেটা! বড় সংসার চালিয়েও দিব্যি নিয়মিত লিখে গেছেন জীবনের আশা, আকাঙ্ক্ষা, ঘটনা ও বোধের কথা সেখানে। ওঁর এক বিশ্বাসের কথা যা পড়েছিলাম সেখানে তা আজও জ্বলজ্বল করছে মনে। লিখেছিলেন: জানি একদিন সায়গল, পঙ্কজকুমার, শচীনদেবের পাশে আমার হেমন্তরও ছবি শোভা পাবে।
খাতা পড়ে ফেরত দিতে হেমন্তদা বললেন, ‘কী বুঝলে?’ তারপর আমি কিছু বলার আগেই বললেন, ‘জানো, এর পাতা ওল্টালে নিজের সম্পর্কেও কত কিছু জেনে যাই।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে নিজে ডায়েরি রাখেন না কেন?’ তাতে ভারি মধুর একটা জবাব দিয়েছিলেন, টিপিকাল হেমন্ত।
বললেন, ‘সমস্যা আছে। একে সন্ধেবেলায় আড্ডায় বসি। আর মনের কথা যা সব সে তো গানেই বলে দিই। গানের খাতাই ডায়েরি আমার।’
হেমন্তদার ছেলেবেলার বন্ধু সন্তোষকুমার ঘোষ জীবনের শেষ কিছু দিন একটা অপূর্ব ডায়েরি লিখেছিলেন ওঁর গলার ক্যান্সার ধরা পড়ার পর। শুরু করেছিলেন মুম্বইতে টাটার ক্যান্সার সেন্টারে, শেষ করলেন কলকাতার বেল ভিউ ক্লিনিকে।
দেখা করতে গেলাম যখন, ওঁর ওই সার্জারিতে স্তিমিত কণ্ঠেও কিছু কিছু পাতা পড়ে শোনালেন। মনে হল রোজনামচা নয়, বুঝি এক গভীর বিশ্বাসের ঘোষণাপত্র, টেস্টামেন্ট পড়ছেন।
অসুখের খবরে কারা কী বললেন, লিখলেন চিঠিতে, সে সব তো আছেই, পাশাপাশি তুলে ধরেছেন রোগের আবির্ভাব ও বিস্তার, জীবন ও মৃত্যু, সাহিত্যের রূপ ও অরূপ নিয়ে অন্তিম চিন্তাভাবনা।
এ সব ছেপে বেরোতে এক নতুন সন্তোষকুমারই দেখা দিলেন। প্রবল পাণ্ডিত্য ও ব্যক্তিত্বের আড়ালে সব সময় ঢাকা পড়ে থাকতেন যে তৃষ্ণার্ত, মাটির মানুষটি। যে মানুষটির মনের আলোছায়া কখনও কোনও অসতর্ক মুহূর্তে ধরা পড়েছে আমার চোখে।
যেমন একদিন বললেন, ‘যখনই দেশ ছেড়ে বিদেশে গেছি, ওই যাবার মুহূর্তে প্লেনের জানলায় বসে একটাই গান মনে এসেছে প্রতিবার। রবীন্দ্রনাথের ‘দাঁড়াও আমার আঁখির আগে।/ তোমার দৃষ্টি হৃদয়ে লাগে॥
সন্তোষকুমার অনর্গল আবৃত্তি করে গেলেন পঙ্ক্তিগুলো আর কয়েক মুহূর্তের জন্য সেই মানুষটিকে দেখলাম, যিনি মৃত্যুর লগ্নে পৃথিবীর ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়ার আগে মনের বেদনা লিখলেন ডায়েরিতে। পূর্ববঙ্গের সেই অপাপবিদ্ধ বালক সকাতরে হাসপাতালের জানলা দিয়ে শেষ দর্শন মাগছে দেশের মাটি, দশের মা, মনের মানুষের।
মৃত্যুর ক’দিন আগে ঘরদোর, পরিবার-পরিজন, জীবন ও কাজ ছেড়ে যাওয়ার এক অতুল্য ছবি রেখে গেছেন ৬৩ বছর ধরে লেখা ডায়েরিতে (সম্ভবত সর্বকালের এক শ্রেষ্ঠ ডায়েরি) লিও টলস্টয়। ‘ওয়র অ্যান্ড পিস’-এ প্রিন্স অন্ড্রের মৃত্যু বা ‘আনা কারেনিনা’য় নায়িকার মৃত্যুঝাঁপের চেয়ে কিছু কম কাঁদায় না ওঁর ১৯১০-এর ২৮ অক্টোবরের ডায়েরির পাতা। লিখছেন:
“১১টা ২০-তে বিছানায় গেলাম। দুটোর একটু পর অবধি ঘুমোলাম। জেগে বসলাম, আর ফের আগের রাতগুলোর মতো দরজা খোলার আর পায়ের শব্দ পেলাম। আগের রাতগুলোয় আমার দরজার দিকে তাকাইনি। কিন্তু এবার সেদিকে চেয়ে দেখলাম পড়ার ঘরে জোরালো আলো জ্বলছে আর কানে এল ফড়ফড় আওয়াজ। সোফিয়া আন্দ্রায়েভনা (টলস্টয়ের স্ত্রী) কিছু খুঁজছে এবং সম্ভবত পড়ছে।
আগের দিনই ও জোরাজুরি করছিল আমি যেন আমার দরজাগুলো বন্ধ না করি। ওর দুই দরজাই খোলা, কাজেই ও আমার সামান্য নড়াচড়ারও শব্দ পাবে। দিবারাত্র আমার সমস্ত গতিবিধি, কথাবার্তা ওর নজরে, নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে।...আমার রাগ এবং বিরক্তি সমানে বাড়ছিল। আমি শ্বাসকষ্ট বোধ করছিলাম, নাড়ি গুনে দেখলাম ৯৭। আমার পক্ষে আর শুয়ে থাকা সম্ভব ছিল না, হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিলাম গৃহত্যাগ করব। ওকে একটা চিঠি লিখলাম আর বিদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছাতে লাগলাম। ও আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এলে যে দৃশ্য ও হিস্টিরিয়ার মুখে পড়তে হবে ভেবে কাঁপুনি দিল।
ছ’টার মধ্যে সব গোছানো গেল। আস্তাবলে গিয়ে ঘোড়াদের তৈরি করতে বললাম।... তখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার। আউটহাউজে যেতে আমি রাস্তাই হারিয়ে ফেললাম। একটা কাঁটাঝোপে পড়ে গা কাটল, ক’টা গাছে বাড়ি খেলাম, টুপি হারালাম, খুঁজেই পাই না, ফের বাড়ি ফিরে অন্য একটা নিলাম, তারপর একটা লন্ঠন হাতে আস্তাবলে গিয়ে ঘোড়াকে লাগাম জিন পরাতে নির্দেশ দিলাম। শেষে স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনে চড়ে বসতে ট্রেন রওনা দিল আর আমার ভয় ছুটে গেল। ভেতরে তখন ওর (স্ত্রী) জন্য একটা করুণার উদ্রেক হল, কিন্তু যা করলাম তার জন্য কোনও দ্বন্দ্ব বা প্রশ্ন জাগল না। হয়তো এ কাজের যুক্তি খাড়া করে ভুলই করছি, কিন্তু আমি লিও নিকোলায়েভিচকে (টলস্টয়) মানে আমাকে বাঁচাচ্ছিলাম না, বাঁচাচ্ছিলাম এমন কিছুকে যা কখনও কখনও সামান্য ক্ষণের জন্য সামান্য ভাবে আমার মধ্যে স্থান করে নেয়।”
এর সামান্য ক’দিন পর ৪৮ বছরের বিবাহবন্ধন ছেড়ে, দীর্ঘসঙ্গী ডায়েরির শেষ ক’টা পাতা লিখে, ৮২ বছরের ঋষি ও লেখক টলস্টয় আস্তাপোভো নামের এক ছোট্ট, অচেনা রেলস্টেশনে দেহত্যাগ করলেন। তার আগে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া মহত্ত্বের প্রতিন্দ্বন্দ্বী দস্তৈয়েভস্কির সেরা উপন্যাস ‘দ্য ব্রাদাসর্র্ কারামজভ’ পড়লেন সমাদর ও সমালোচনার সঙ্গে। সে কথাও লিখে গেলেন ডায়েরিতে। যে ডায়েরিকে বলেছেন ‘এটাই আমি’ সেইখানেই মৃত্যু নিয়ে ওঁর স্ববিরোধ রেখে গেছেন। কখনও বলছেন, ‘বেঁচে থাকাটাই মরতে থাকা’, কখনও ‘ভাল ভাবে মরা চাই’।
টলস্টয়ের জীবনে ডায়েরি ছিল সব কাজের প্রস্তুতি ও কাজ সম্পন্ন হলে তার বিচার ও নথি। মান-অপমান, উত্থান-পতনের ছবি ছাড়াও আত্মসমীক্ষার নির্জন মঞ্চ। তাঁর মৃত্যুর বছরেই জন্মেছিলেন কলকাতা ও বাঙালির অতি নিজস্ব মা টেরেসা। যিনিও প্রায় ওঁরই ধারায় আত্মার আর্তি ও বেদনা লিপিবদ্ধ করেছেন দীর্ঘকাল ধরে লেখা অসংখ্য ‘ব্যক্তিগত’ স্বগত সংলাপে। তাঁর স্বর্গলাভের পর ‘কাম বি মাই লাইট: দ্য প্রাইভেট রাইটিংজ’ বলে প্রকাশিত সেই ডায়েরি খ্রিস্টীয় তত্ত্বাধারে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হয়েছে। ঈশ্বর বা নিজেকে নয়, তৎকালে কলকাতার আর্চবিশপ পেরিয়ারকে লেখা এক ব্যক্তিগত বার্তা তুলে দিচ্ছি। মঠ ছেড়ে রাস্তায় নেমে বুভুক্ষু, মরণাপন্ন ও কুষ্ঠরোগীদের জন্য কাজ করার অনুমতি চেয়ে পত্র সেটি। কারণ? এক ঘোর অমানিশা আক্রান্ত করছে ওঁর হৃদয় ও মন। লিখছেন:
“এখন ফাদার— ৪৯ বা ৫০-এর সেই ভয়ঙ্কর ক্ষতির পর এই বর্ণনাতীত অন্ধকার এই নিঃসঙ্গতা এবং ঈশ্বরের জন্য নিরন্তর আকুতি— আমার হৃদয়ের অন্তস্থলে গভীর দুঃখ বিস্তার করছে।
এমন আঁধার চারপাশ যে কিছু দেখতে পাই না— না মন দিয়ে, না যুক্তি দিয়ে— আমার হৃদয়ে ঈশ্বরের স্থানটি খালি পড়ে আছে— আমার মধ্যে কোনও ঈশ্বর নেই— যখন আকাঙ্ক্ষার বেদনা খুব গভীর হয় আমি তখন শুধু ঈশ্বরের জন্য আকাঙ্ক্ষা আর আকাঙ্ক্ষা করে যাই— আর তখনই যেন ভাবনা আসে যে তিনি আমায় চান না— তিনি আমার জন্য নেই কোথাও, ঈশ্বর আমায় চান না— একেক সময় নিজের হৃদয়কে কেঁদে উঠতে শুনি— ‘হে ঈশ্বর’ আর তারপর আর কোনও কথা জোগায় না— সে নির্যাতন ও যন্ত্রণা আমি বোঝাতে পারব না।”
একটা জিনিস বুঝে নেওয়া ভাল যে সন-তারিখ-স্থান-পাত্র দিয়েই ডায়েরি হতে হবে এমন নয়। ফাদার দ্যতিয়েনের ‘ডায়েরির ছেঁড়া পাতা’য় তো বিষয়, বিষয় আর বিষয়ের সমারোহ। কবি শঙ্খ ঘোষের যে জার্নাল পড়েছিলাম ‘কৃত্তিবাস’-এ সে তো রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রয়াত সেক্রেটারি জেনারেল ডাগ হ্যামারসিল্ড-এর ‘মার্কিংজ’ শীর্ষক ডায়েরিকে মনে পড়ায়। হঠাৎ হঠাৎ ভেসে ওঠা চিন্তা, পাঠের ফসলের বিচিত্র আয়োজন।
এই সরণির সেরা পথিক এবং হয়তো অনতিক্রম্যও হলেন ফরাসি দার্শনিক ব্লেজ পাস্কাল। তাঁর ভাবনার ডায়েরি ‘পঁজে’ (চিন্তা) এতই ব্যক্তিগত ছিল যে কোটের মধ্যে সেলাই করে নিয়ে কবরে যান। কবর খুঁড়ে উদ্ধার করা সেই ডায়েরি দর্শনচিন্তা ও ফরাসি গদ্যের শিরোমণি কীর্তি হল অনতিকালে। টলস্টয় ওঁর ভক্ত হয়েছিলেন। কারণ ‘পঁজে’-তে তিনি সূক্তি করেছেন: হৃদয়ের কিছু যুক্তি আছে যুক্তি যার কিছুই বোঝে না।
আঙ্কিক ও বিজ্ঞানীও ছিলেন পাস্কাল। তাই নিজের বিস্ময় নিয়ে এমন বিস্ময়কর সূক্তি রেখে গেলেন: এই অসীম বিশ্বের অন্তহীন নিস্তব্ধতা আমাকে সন্ত্রস্ত করে। (সূক্তি ২০৬)।
তারপরই ২০৭-এ লিখছেন: কতই তো সাম্রাজ্য আছে যারা আমাদের চেনেই না।
জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’কেও ডায়েরি অঙ্গে পড়ে ফেলা যায়। বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল, ধানী খেত, ঘাস, নীল বন, শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ, নক্ষত্র, ভাসানের পালা, মাথুরের গান, পাঁচালির নিবিড় ছন্দ, রামপ্রসাদের শ্যামা..... সব দৈনন্দিনের রূপরেখায় ভিড় করে এসেছে কবির পাণ্ডুলিপি ভরিয়ে তুলতে। যিনি রূপসী বাংলায় ফেরার ভূমিকা করে বলেছেন: ‘আমি এ বাংলার পাড়াগাঁয়ে বাঁধিয়াছি ঘর।’
রোজনামচা যখন, তাই রোজকার মানুষের মধ্যেই ফিরে আসতে হয়। মধ্য কলকাতায় আমার এক বন্ধু ছিল কৈশোর শেষে যে এক ডাকে পাড়া বা বেপাড়ার যে কারও মৃত্যুতে শ্মশানযাত্রী হত। শববহনে বা চিতা সাজানোয় তো ওর পেশাদারিত্ব এসে গিয়ে ছিলই, কিন্তু যে কারণে ওর ব্যাপারটা ভুলতে পারিনি তার কারণ হল ও মড়া পুড়িয়ে এসে একটা ছোট্ট ডায়েরিতে অভিজ্ঞতাটা তুলে রাখত। আমি সেটার নামকরণ করেছিলাম ‘শ্মশানযাত্রীর ডায়েরি’। কিন্তু ও সেটা ছাপতে দিতে রাজি হয়নি। বলেছিল, ‘মায়ের বারণ আছে। বলবে মড়া নিয়ে ইয়ার্কি হচ্ছে।’ হই হই করে নাচতে নাচতে মড়া নিয়ে দৌড়নোর অনেক আগের ব্যাপারস্যাপার এসব।
বাল্যে এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এরোপ্লেন মেকানিককে দেখতাম ফুরসত হলেই মোটা মোটা লাল খাতাতে কী সব লেখে। ভাবতাম রোজকার হিসেবপত্তর বা কাজের ফিরিস্তি লেখে। বহু পরে, আমি যখন আর ও পাড়াতে থাকিও না এবং এক ইংরেজি সংবাদপত্রে কাজ করি তখন ওর স্ত্রী আমাকে আমন্ত্রণ করে ও রকম পাঁচ খণ্ড ডায়েরি দেখায়।
পাতা উল্টিয়েই তো আমি হতভম্ভ। ভুলভাল গ্রামার ও স্পেলিং-এ হলেও খুবই দ্রুত গদ্যে এক অদ্ভুত জীবনকথা। এত সরল ও সৎ যে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। ওর নানা প্রেম ও যৌনতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তাতে।
বলা বাহুল্য, সে লেখার কোনও গতি করতে পারিনি। সংবাদপত্রে তো এ জিনিসের জায়গা করা যায় না। আরও পরে ডায়েরিগুলো নিয়ে ফিকশন গোছের কিছু করব বলে যখন ও পাড়াতে গেলাম, তখন ও আর ও পাড়াতেই নেই। অগত্যা পাঠস্মৃতি থেকে একটা নভেলেট লিখলাম ‘আঁতোয়ান সুকের ডায়েরি’।
বরের লাম্পট্যের বিবরণ কেন বৌটি ছাপতে দিতে চেয়েছিল তা আজ আমার কাছে ধোঁয়াশা। মেয়েরা নিজে লিখলেও কি নিজেদের ভাব-ভালবাসা উগরে দিতে পারবে ডায়েরিতে? কলকাতা দূরদর্শনের একজিকিউটিভ প্রডিউসার রিকু দত্ত জানাচ্ছেন তিনি পেরেছিলেন। কিন্তু ওর মা সেটা কেড়ে নিয়ে উনুনে দিলেন। জীবনের অনেক স্মৃতি ঘেঁটে গেল ওই করে।
তাহলে আর লেখা হল না? বললেন, ‘সময়ই হয় না। তবু নিজের জন্য কোনও কথা তুলে রাখার হলে কম্পিউটারে ভরে দিই।’
এই যে ডায়েরি ধ্বংস করার রেওয়াজ সে তো আজকের নয়। যবে থেকে লেখা হচ্ছে ডায়েরি, তবে থেকে ধ্বংসও হচ্ছে। কারণ একটা বড় ভয় লেখকের যে প্রকাশ পেলে বন্ধুহানি হবে। সৎ হলে শত্রুবৃদ্ধি হবে, অসৎ হলে বলবে ন্যাকা। দ্বিতীয় ভয়, জীবনের অনেকখানি বন্দি হয়ে পড়ে ডায়েরিতে।
একদিন লন্ডনের পথে গাড়িতে যেতে যেতে রবিশঙ্কর প্রথম ওঁর ডায়েরির কথা বলেন আমাকে। বলেছিলেন, ‘চলে যাবার আগে দিয়ে যাব তোমাকে। দেখেশুনে, ঠিকঠাক ছেপো। অনেক অদ্ভুত মেটিরিয়াল আছে।’ সে ডায়েরি তিনি দিয়ে যেতে পারেননি। সে সব আর হাতে আসবে বলে মনেও হয় না। কোথায়, কার হাতে আছে তাও জানি না। অনেকটা ইতিহাস, অনেকটা শাস্ত্রও যেন লুপ্ত হয়ে গেল।
ডায়েরি জীবনকে বন্দি করে বলে এত ভয়, অথচ জেলে বন্দি অবস্থায় ডায়েরি লিখেও মনকে খালাস করা যায়। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৫ অবধি জেলবন্দি অবস্থায় অসাধারণ স্বকীয় মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামশি তাঁর অপূর্ব সব ‘প্রিজন নোটবুকস’ লিখলেন।
জেলের ডায়েরিও যে অপরূপ উপন্যাস হয়ে উঠতে পারে তার এক বিরল নজির এই সময়ের জনপ্রিয়তমদের এক জন লেখক জেফ্রি আর্চারের তিন খণ্ডের ‘আ প্রিজন ডায়েরি’।
জেলের প্রথম দিনের প্রথম মুহূর্তগুলোর বর্ণনা পড়তে পড়তে শ্বাসরোধ হয়। যেমন হত কৈশোরে প্রথম সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ পড়তে গিয়ে। আর্চারের লেখা থেকে একটা বিরল মুহূর্ত তুলে দিচ্ছি :
“‘ক’দিন দিল জজ?’ হালকাভাবে জিজ্ঞেস করল পাহারাদার। বললাম, ‘চার বছর।’ ও উত্তর দিল, ‘ও কিছু না, দু’বছরেই খালাস হবেন।’ এমন একটা জবাব যেন আমি কোস্তা দেল সল সমুদ্রতটে পক্ষকাল বেড়াতে এসেছি।
অফিসার এসে এক মস্ত স্টিলের দরজা খুলে আমায় ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। ঘরটা দশ ফুট বাই পাঁচ ফুট। দেওয়ালগুলো এখনও ক্রিম রঙই আছে। দূরে একটা লম্বা কাঠের বেঞ্চি পাতা। কোনও ঘড়ি নেই। সময়ের কোনও স্পর্শ নেই। দেখা আর ভাবা ছাড়া করারও কিছু নেই। কিছু দেওয়াল লিখন ছাড়া পড়ারও কিছু নেই। যে সব দেওয়াল লিখনে এ হেন সব বার্তা—
‘হ্যারি এখানে ছিল।’ ‘মার শালা জজগুলোকে!’ ‘জিম ডেক্সটার কিন্তু নিরাপদ ছিল। ঠিক তো?”’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy