শাহ বিখা গলি (চলতি টানে বললে বিখা শাহ গলি) বললে বারাণসীর এক প্রসিদ্ধ গলি বোঝায়। যেখান থেকে মিনিট দশেক পা চালালে কাশীর এক এবং অদ্বিতীয় বালাজি মন্দির। অন্য একটা দিকে দশ মিনিট হাঁটলে কবীর চৌরা— কণ্ঠে মহারাজ, কিষেণ মহারাজ প্রমুখ মহারাজদের পাখোয়াজ, তবলার ঘর।
শাহ বিখা গলির নামের আগে সি কে ৪৬/৬৩ জুড়লে একটা বিখ্যাত ঠিকানা দাঁড়ায়, যেটা কদাচিৎ কেউ উচ্চারণ করে। শুধু বললেই হয় বিসমিল্লা খান সাহেবের বাড়ি। পৃথিবীর এক শ্রেষ্ঠ গানের ঠিকানা। সালজবুর্গে মোৎজার্টের বাড়ি, বন শহরের বেটোফেনহাউস বা মাইহারে আলাউদ্দিন খান সাহেবের আশ্রমের মতো এক অমর সুরলোক।
এই বাড়িরই ছাদে দুটো ঘর নিয়ে থাকতেন সানাই উস্তাদ। বাড়ির বাকি অংশে পরিবারের অন্যেরা। স্ত্রীবিয়োগের পর কয়েক দশক যাবৎ খান সাহেব ওঁর যন্ত্রাদি নিয়ে বাড়ির উপরিতলেই মজুত ছিলেন। লোকজন এলে ছাদে চৌপাই বিছিয়েই আলাপ-আড্ডা-সুরভাঁজা। দীর্ঘ দিন ধরে ওঁর বাড়িটাই একটা মন্দির হয়ে গিয়েছিল।
ছ’বছর বয়সে কাকার সঙ্গে কাশীর এই মহল্লায় এসে ওঠেন শেহনাই নওয়াজ বিসমিল্লা খান সাহিব। সেই থেকেই মন্দিরে সানাই বাজানো, রেওয়াজ আর সেবা। আমেরিকায় ইস্কুল করে লম্বা সময় থেকে যাওয়ার প্রস্তাব এলে ওঁর একটা সরল শর্ত ছিল: কাশীর মন্দির আর গঙ্গা তুলে এনে এখানে বসিয়ে দাও, তাহলে আছি।
মহরমের সময় সানাই বাজিয়ে, খালি পায়ে জুলুসের সঙ্গে তাজিয়া নিয়ে মসজিদ যেতেন।
১৯৭৭-এর নভেম্বরের এক প্রত্যুষে বজরায় করে কাশীর গঙ্গায় নৌকাবিহারে বেরিয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। কাশী বললে কাকে বোঝায়, এমন একটা প্রশ্ন উঠেছিল। তাতে সবাই সহমত হলেন, কাশী মানে শিব। গঙ্গার উল্টো পারে আঙুল দেখিয়ে আয়ুর্বেদাচার্য আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ব্যাসকাশী কিন্তু মহর্ষি ব্যাসের সঙ্গে যুক্ত। কথা উঠল রাজা হরিশ্চন্দ্রকে নিয়ে। বজরা যখন মণিকর্ণিকা ঘাট সন্নিকটে।
ফিরে আসার সময় অনেকগুলো মন্দিরচুড়ো দেখিয়ে রবিশঙ্কর বললেন, বিসমিল্লা খান ওইখানে কোথাও থাকেন। বিসমিল্লারও শহর কাশী।
বেনারসের সেই বাড়ি
দিনে দিনে এত এত বাড়ি চড়েছিল বিখা শাহতে যে ছাদ থেকে গঙ্গাদর্শন হত না। কিন্তু এমন একটা দিন এখন আসতে চলেছে যে সি কে ৪৬/৬৩ বিখা-শাহ গলিতে মরহুম উস্তাদ বিসমিল্লা খানের বাড়িটিও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাব ছিল ভারতরত্ন সঙ্গীতকারের বাসভবন তাঁরই স্মৃতিসংরক্ষণে এক জাদুঘর ও সঙ্গীতকেন্দ্রে পরিণত করার। কিন্তু সে উদ্যোগ এখন বিশ বাঁও জলে। কারণ উস্তাদের প্রথম ও দ্বিতীয় পুত্র মেহতাব হুসেন ও কাজিম হুসেন বেশ ক’বছর ধরে উদ্যোগী হয়েছেন খান সাহেবের ভিটেকে প্রোমোটারদের হাতে তুলে দেবার জন্য। যাদের পরিকল্পনা একটা বড়সড় কাটরা গড়ার!
খান সাহেবের মৃত্যুর পরে পরেই যে এটা ঘটেনি তার কারণ, জানাচ্ছে কাশীর সাংবাদিক ভাস্কর নিয়োগী, ছোট ছেলে তবলাশিল্পী নাজিম হুসেন ওই ঠিকানায় আব্বার নামে জাদুঘর ছাড়া কিছু হতে দেবেন না। বিসমিল্লা খানের ঘরের ইনি বলতে গেলে শেষ সলতে, তিরিশ বছর পিতার সঙ্গে সঙ্গত করেছেন তবলায়। বড় ইচ্ছে ওঁর যে সানাইয়ের কেন্দ্র হোক সি কে ৪৬/৬৩ বিখা শাহতে।
অথচ গত কয়েক বছর তিনি নিজেই ঘরছাড়া। দুই বড় দাদা সঙ্গীতে আসেননি, সানাইয়ের পরম্পরায় উৎসাহী নন। তাঁদের পথের কাঁটা নাজিম হুসেনকে সুযোগমতো উপড়ে ফেলতেও কসুর করবেন না। নাজিম জানাচ্ছেন, তিনি আপাতত অন্য পাড়ায় থাকছেন মারধোর থেকে রেহাই পেতে, যা কয়েক বার ঘটে গেছে অ্যাদ্দিনে। মনের ব্যথায় এখন তাই গুন গুন করেন বাবার সুর করা বিখ্যাত ফিল্মি গীত ‘দিলকা খিলোনা হায় টুট গয়া/ কোই লুটেরা আ কে লুঠ লিয়া’। নাজিমের অন্য শরণ এখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, যিনি বারাণসীরও সাংসদ।
তবু সময় বড় কম। যে কোনও দিন প্রোমোটারের রাজমিস্ত্রিরা কাজে নামল বলে। তাহলে উস্তাদ বিসমিল্লা খানের স্মৃতিধন্য বাড়িটা শেষে কেবলই সিকে ৪৬/৬৩ শাহ বিখা গলি হয়ে দাঁড়াবে? তাঁর স্মৃতির পরশ পেতে ভক্তদের গন্তব্য হবে শুধুই বালাজি মন্দির?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy