স্বভাবে শান্ত, নম্র। কিন্তু বল হাতে এতটাই নির্মম
আমার জীবনের প্রথম বড় ক্রিকেটীয় সফর ছিয়াত্তরে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
তার আগে জামাইকান ফাস্ট বোলার মাইকেল হোল্ডিংকে নিয়ে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব গল্প শুনেছিলাম।
ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়ায় দিলীপ সরদেশাই-এর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তখনকার বম্বের ট্রানজিটে। অ্যাথলেটিক, ছন্দোময় ফাস্ট বোলারের প্রশংসায় ও পঞ্চমুখ।
জামাইকা টেলিভিশনের সঙ্গে যে আমার ধারাভাষ্যের চুক্তি আছে, দিলীপ সেটা জানত। ভারতীয় সফরের আগে মাঠের টিকিটের দাম খুব চড়া হয়ে যাওয়ায় সাদা-কালো ওই টেলিকাস্টিং প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়েছিল। তা দিলীপ আমাকে বলল, কমেন্ট্রি বক্স থেকে একটু ঝুঁকলেই কিন্তু হোল্ডিংয়ের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারবে। ওর বোলিং রান আপ এতটাই লম্বা!
কোনও দিন যে কোনও রকম চ্যালেঞ্জকে ভয় পায়নি সেই দিলীপ, পর্যন্ত আধা-মশকরার সুরে বলছিল হোল্ডিং আর অ্যান্ডি রবার্টসের মোকাবিলা করার চেয়ে ও যে অবসর নিয়ে ফেলেছে, সেটা বেশ ভাল। বিশেষ করে তখনকার হেলমেট-পূর্ব যুগে।
ওই একই সন্ধেয় দেখা রাজ সিংহ দুঙ্গারপুরের সঙ্গে। উনিও দেখলাম মাইকেল হোল্ডিং নিয়ে উচ্ছ্বসিত।
মনে আছে, ভিসার জন্য দিল্লি গিয়েছি। ওখানে হ্যারি ল্যাচম্যান নামের এক কনসুলার অফিসারের সঙ্গে দেখা। মজা করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি শিওর সফরটায় যেতে চাইছ?” তারপর বললেন, আমাদের সবার না একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঘোরা উচিত। তাতে লেখা থাকবে হোল্ডিং স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। তামাকের বিরুদ্ধে সতর্কীকরণটা তখন একেবারে বাধ্যতামূলক হয়ে গিয়েছিল!
ঝুলিতে আট উইকেট, ইঙ্গিত হোল্ডিং-য়ের
বার্বেডোজে উঠলাম ক্যারিবি হোটেলে। সমুদ্র যেখানে একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাঁক নিয়েছে, হোটেলটা সেখানে। প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল সেই ‘টেরিটোরি ম্যাচ’। চার দিনের যে ম্যাচে ইন্টার আইল্যান্ড লিগ চ্যাম্পিয়ন টিমের বিরুদ্ধে খেলবে ভারত।
বার্বেডোজ তখন সব কিছুর কেন্দ্রে। সোবার্স, ওয়ালকট, উইক্স, ওরেল সবাই ওই মনোরম দ্বীপের থেকে উঠে আসা মানুষ। মাঠটাও খুব সুন্দর। অসম্ভব ইনফর্মাল, ধীর লয়ে চলা জীবন। ডিউটিতে সব মিলিয়ে ছ’জন পুলিশ।
টেরিটোরি ম্যাচের তৃতীয় দিন ‘বিগ বয়’-রা এসে উপস্থিত। লয়েড, গ্রিনিজ, রিচার্ডস, হোল্ডিং আর রবার্টস সবাই ক্যারিবি হোটেলেই উঠল। ততক্ষণে ম্যাচ শেষ। পার্টি চলছে। আমাদের জন্য হোটেলের লনে নানারকম বিনোদনের আয়োজন করা হল।
১৯৭৪-এর ভারত সফর থেকে ক্লাইভ লয়েডের সঙ্গে আমার সামান্য চেনা-পরিচয় হয়েছিল। ও-ই আমাকে হোল্ডিংয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। প্রথম বার ওকে দেখে তো আমার কেমন অবিশ্বাস্য লাগছিল। এ তো খুব শান্ত, নম্র, চুপচাপ এক জন মানুষ। এ কী করে অতটা বিষাক্ত হতে পারে? অথচ এমনটাই তো শুনে আসছি।
হোল্ডিংকে দিলীপ সরদেশাইয়ের হয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে বললাম, স্থানীয় দুই তারকা টনি কোজিয়ার আর অ্যাফ্রো চুলের হিউ ক্রসকিলের সঙ্গে একটা টিভি শো করছি। ওর লম্বা রান-আপ, সাবাইনা পার্কে ওকে ঠিক আমাদের নীচে নিয়ে আসবে শুনে হালকা একটু হাসল।
বার্বেডোজ ম্যাচটাও বেশি গড়াল না। তিন দিনের কমেই শেষ। এক ইনিংস আর ৯৭ রানে জিতে গেল ‘হোস্ট’-রা। দুই ইনিংসে দুটো করে উইকেট নিল হোল্ডিং। ম্যাচে রবার্টস নিয়েছিল পাঁচ উইকেট।
সে রাতে হলিডে ইনে একটা অনুষ্ঠানে প্রচুর রাম আর স্থানীয় ক্যারিব বিয়ার খাওয়া হল। ম্যাচটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়ায় সুন্দর দ্বীপটা ঘুরে দেখার একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। এই দ্বীপটাকেই যেমন ভালবেসেছিলেন হ্যারি বেলাফন্টে, তেমন ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রাও। এই দ্বীপেরই দূর প্রান্তের সমুদ্রসৈকতে ‘আইল্যান্ড ইন দ্য সান’ সিনেমার শু্যটিং হয়েছিল।
দ্বিতীয় টেস্টটা ছিল একদম অন্য রঙের। ত্রিনিদাদের আদরের সুনীল গাওস্করের ১৫৬ আর ব্রিজেশ পটেলের ১১৫-র পরেও যে ভারত জিততে পারল না, তার কারণ প্রচণ্ড বৃষ্টি। এক ইনিংসে হোল্ডিং আবার নিল দু’উইকেট। ভারতের সফরের কয়েক সপ্তাহ আগেই অস্ট্রেলিয়া গিয়ে ১-৫ হেরে এসেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই সিরিজে ক্লাইভ লয়েডের উপর তাই কড়া নজর ছিল সবার। অল্পের জন্য টেস্টটায় বেঁচে গিয়েছিল লয়েড।
হোল্ডিংয়ের ঘরের দ্বীপ জামাইকা যাওয়ার আগে সিরিজ ১-১। টিমের সঙ্গে মিডিয়া থেকে আমরা তিন জন ট্র্যাভেল করছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন অভিজ্ঞ ক্রিকেট-লিখিয়ে কে এন প্রভু আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ-বিশেষজ্ঞ ডিকি রত্নাগর।
ম্যাচের আগের দিন পাহাড়ের উপর নিজের বাড়িতে আমাদের ডিনারের নেমন্তন্ন করেছিল মাইকি। বিশ্বাস করবেন না, পেগ্যাসাস হোটেল থেকে আমাদের পিক-আপ করতে ও নিজে এসেছিল!
ডিকি আপত্তি করে বলেছিল, আমরা তো ট্যাক্সি নিয়ে নিতে পারতাম। উত্তরে হোল্ডিং বলল, জামাইকা খুব একটা নিরাপদ জায়গা নয়। রাত্তিরবেলা কাস্তে আর বন্দুক নিয়ে গ্যাংয়ের লোকজন ঘুরে বেড়ায়। স্থানীয় একটা ক্যালিপসোর কথাও বলছিল, যার কয়েকটা শব্দ এরকম ‘ন্যাটি ড্রেড কুম’। ‘ন্যাটি ড্রেড’ হচ্ছে অলিম্পিক পার্কের খুনেরা। ‘কুম’ অর্থাৎ, ইংরেজি ‘কাম’। মানে ওরা এসে লোকজনকে অপহরণ করে। বিশেষ করে বিদেশিদের।
মাইকির সঙ্গে ডিকির খুব ভাল আলাপ ছিল। আমারও ওকে ভীষণ ভাল লেগে গেল। ওর বাবা-মা ছিলেন একেবারে সাধারণ মানুষ। ওঁরা আমাদের ম্যানি মার্টিনডেল আর জর্জ হেডলির পুরনো দিনের সব গল্প শোনাচ্ছিলেন।
হেডলি নামটা শুনে বলে ফেলেছিলাম, “ও হ্যাঁ হ্যাঁ, উনিই তো কৃষ্ণাঙ্গ ব্র্যাডম্যান।” শুনে মাইকি বলে উঠল, “নো ম্যান, ব্র্যাডম্যানই হলেন সাদা চামড়ার হেডলি!” সত্যি, নিজেদের ঐতিহ্য নিয়ে ওদের আলাদা একটা গর্ব ছিল।
কেরিয়ার বাঁচাতে হলে যে টেস্টটা লয়েডকে জিততেই হত, সেই ম্যাচে তিন জন ভারতীয় ব্যাটসম্যান চোট পেল। বিশ্বনাথ, পটেল আর গায়কোয়াড়। ‘বডিলাইন’ বোলিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল ক্যাপ্টেন বেদী। কিন্তু দুই আম্পায়ার র্যাল্ফ গোসেইন আর ডগলাস স্যাং হিউ তা নিয়ে কিছু বলেনওনি বা করেনওনি। তিন জন হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ম্যাচটা হারল ভারত।
সেই রাতে রাজ্যপাল গ্ল্যাসপোল আয়োজিত একটা অনুষ্ঠানে দুটো টিম একে অন্যের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলছিল না। স্থানীয় টিভি-র বস্ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি মাইকি আর ওর মা-বাবার সাক্ষাৎকার নিতে পারব।
উফ, সে সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা সত্যি করে কোনও দিন ভোলার নয়! হোল্ডিং বলছিল, পিচে একটা উঁচু মতো জায়গা ছিল, যেখানে পড়ে বলটা ছিটকে যাচ্ছিল। হোল্ডিং সিনিয়র জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি ভেবেছি, ওঁর ছেলে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের শরীর তাক করে ওদের আহত করার জন্য বল করতে চাইছিল? বিড়বিড় করে বলেছিলাম, চাক বা না চাক, কাজটা কিন্তু বেশ ভাল ভাবেই করেছে হোল্ডিং।
অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৭৭-’৭৮ সফর। সেখানে হোল্ডিংয়ের সঙ্গে আবার দেখা। কেরি প্যাকারের ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ও তখন ওয়ার্ল্ড সিরিজে খেলছে।
কিংস ক্রসে ‘বুর্বোঁ অ্যান্ড বিফস্টেক’ নামের অদ্ভুত রকমের মনোরম একটা রেস্তোরাঁয় আমাকে আর আমার স্ত্রীকে ডিনারে ডেকেছিল ও। সারাক্ষণ পুরনো দিনের কথা বলতে বলতে সন্ধেটা কী বলে শেষ করল জানেন? বলল ‘চলো, সাবাইনা পার্কের কথা ভুলে যাই!’
তার পর অনেক বার, বিশ্বের বহু প্রান্তে হোল্ডিংয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ওর চেয়ে ভাল বন্ধু বা নম্র ভদ্র মানুষ সত্যিই হয় না। আর হ্যাঁ, ওর চেয়ে ভাল ধারাভাষ্যকারও।
নিজেকে নিয়ে বেশ ঠাট্টা করতে পারত হোল্ডিং। এক বার প্রিটোরিয়ায় কমেন্ট্রি দিতে গিয়েছে ও। ওর সদ্যবিবাহিত দ্বিতীয় স্ত্রী হোটেলে চেক-ইন করছে। গায়ের রং হালকা, বেশ কেতাদুরস্ত একজন মহিলা যখন কাউন্টারে চেক-ইনের কাজ সারছেন, হোল্ডিং তখন চুপচাপ একটু দূরে দাঁড়িয়ে। ওকে বেল-বয় ভেবে লবি ম্যানেজার বলেছিলেন, ‘ম্যাডামের ব্যাগগুলো ওঁর ঘরে রেখে এসো তো।’
ঘটনাটা শুনে হোল্ডিংকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কী করলে তখন? হোল্ডিং-এর সহাস্য উত্তর এল, “আরে, লোকটা যা বলল সেটাই করলাম!”
আমার কফি-টেবল বইয়ের জন্য সারা বিশ্ব ঘুরে সাক্ষাৎকার জোগাড় করার সময় হোল্ডিং যা সাহায্য করেছিল, চিরকাল মনে থাকবে।
কী রকম? একটা নমুনা দিই। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ইয়ান বোথাম আর ডেভিড গাওয়ার তখন কমেন্ট্রি বক্সে। ওদের সঙ্গে দেখা করাতে আমাকে আর আমার স্ত্রীকে পর্যন্ত সটান সেখানেও নিয়ে চলে গিয়েছিল হোল্ডিং।
অনুবাদ: প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy