বেগম আখতারের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক কত দিনের? স্রেফ এর-তাঁর নয়, স্বয়ং জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের স্মৃতিকথা কী বলছে?
ডিক্সন লেন, ক্রিক রো নয়, জ্ঞানবাবুদের পরিবার তখন ভাড়ায় থাকেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের এক বৃহৎ অট্টালিকায়। যার পশ্চিম দিকের বারান্দার উল্টোপারে দাঁড়িয়ে রয়্যাল হোটেল।
সে হোটেলের গেট থেকে জ্ঞানবাবু প্রায়ই দেখেন সুবেশা তন্বী তরুণী একটা মস্ত মোটরগাড়িতে বেরিয়ে যাচ্ছেন, আবার কখনও গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে যাচ্ছেন।
জ্ঞানবাবুর বাড়ির সকলেরই ধারণা হয়েছিল তরুণী নিশ্চয়ই কোনও বাঈজি। কোনও কারণ নেই, এমনিই একটি ধারণা।
এর বহু বছর পরে এক ভারতজোড়া খ্যাতির গায়িকাকে সামনে পেয়ে জ্ঞানবাবু জিজ্ঞেস না করে পারেননি, “আচ্ছা বেগম সাহেবা, কমবেশি উনত্রিশ বছর আগে কি আপনি আমহার্স্ট স্ট্রিটের রয়্যাল হোটেলে এসে উঠতেন?”
সেই গায়িকা তদ্দিনে মালেকা-এ-গজল বেগম আখতার, সামান্য চিন্তা করে বলেছিলেন, “হুঁ, বাবুজি। আপকো ক্যায়সে ইয়াদ হ্যায়?”
জ্ঞানবাবু ওঁর স্মৃতির দৃশ্যগুলো বর্ণনা করতে বেগম জানিয়েছিলেন, “সে-সময় জে.এন. বাবু আমাকে ফৈজাবাদ থেকে কলকাতায় আনিয়ে রেকর্ড করাতেন।”
সেই জে.এন. ঘোষের মেগাফোন কোম্পানিতে গান রেকর্ড করিয়ে সেদিনের আখতারি বাঈয়ের যে-গানের জীবন শুরু হল, ঠুংরি, দাদরা, কাজরি, লোকগান দিয়ে তারই যেন এক অপরূপ পরিণতি হল ষাটের দশকের শেষে ও সত্তর দশকের গোড়ায়— বেগমের জীবনের শেষ ক’বছরে— ওই জ্ঞানবাবুর সুরে ও কথায় প্রথমে রেডিয়োর জন্য ও পরে ডিস্কের জন্য কিছু পরমাশ্চর্য বাংলা রাগপ্রধান রেকর্ড করে।
আমজনতা তো ডিস্ক শুনেই মাত, গোটা বাঙালি তখন বেগম বলতে অজ্ঞান, কিন্ত জ্ঞানবাবু বলতেন, “বাঁধা লেংথ তো রেকর্ডের। রেডিয়ো-র রেকর্ডিং-এ যা দেওয়া গেছে তার সিকি ভাগ।”
কিন্তু ওই সিকিভাগেই তো বাঙালি মাতোয়ারা। যে বছর অকাল-প্রয়াতা হলেন বেগম আখতার সে বছর দুর্গাপুজো, কালীপুজোর প্যান্ডেলে কেবলই ঘুরে ফিরে আসছে হয় ওঁর ‘কোয়েলিয়া গান থামা এবার’ নয়তো ‘এ মোসুমে পরদেশে’, হয় ‘চুপি চুপি চলে না গিয়ে’ নয় ‘ফিরে কেন এলে না।’।
এ সব রাগপ্রাধান গান ঠিকই, কাব্যসঙ্গীতও ঠিকই, প্রেমের গান তো বটেই, কিন্তু এদের সবেরই এক আলাদা মাত্রা, এরা এলিজি বিষাদ গীতি।
এর বছর বারো-চোদ্দো পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় যেমন নাগাড়ে এলিজি কবিতা লেখা ধরেছিলেন এবং লিখতে লিখতে বছর দশকের মাথায় একদিন টুক করে চলেও গেলেন, তেমনি যেন একের পর এক রেকর্ড করে বেগম ওঁর অকালপ্রস্থানের চিত্রনাট্য ফাঁদছিলেন। আমরা ধরতে পারি বা না-পারি।
সে-সব গানের এফেক্ট কী দাঁড়িয়ে ছিল তার এক ছোট্ট প্রমাণ দিই। বেগমের মৃত্যুর সামান্য ক’মাস আগে মৃত্যু হয়েছে উস্তাদ আমির খানের। সে-খবরে শুনেছি শোকে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন বেগম সাহেবা। কিন্তু স্বল্পকাল পরে নিজের মৃত্যুর আগে হয়তো জেনে যাননি ওঁর বাংলা গানকে দিয়ে যাওয়া আমির খানের ট্রিবিউট। কী রকম?
না, খান সাহেবের মৃত্যুর পরে পরেই একদিন ওঁর শিষ্যা খেয়াল শিল্পী পূরবী মুখোপাধ্যায় ডাকলেন প্রথম হাফিজ খান মিউজিক কনফারেন্সে রেকর্ড করা খান সাহেবের ভাটিয়ার শোনাবেন বলে।
সেই অবিস্মরণীয় গান শোনাবার পর বললেন, “এ বার তোমায় একটু অবাক করে দিই।” আর চালিয়ে দিলেন সেই টেপ যেখানে খান সাহেব গেয়ে যাচ্ছেন বেগমের “এ মৌসুমে পরদেশে যেতে তোমায় দেব না।”
বেগমের সুর লাগানোর তারিফ করে করে সেই পদগুলোই অপরূপ আবেগ ও ঝোঁকে গেয়ে যাচ্ছেন কিরানা ঘরের স্তম্ভ উস্তাদ ওয়াহিদ খানের ‘ভাবশিষ্য’ উস্তাদ আমির খান (সাক্ষাৎ শেখেননি, তবে পাশের ঘরে বসে কখনও কখনও ওঁর মিরখণ্ডি বিস্তার ও তান-সরগমের রেওয়াজ শুনে শুনে)।
এই ওয়াহিদ খান সাহেবের এক শিষ্যা বেগম আখতার, যদিও আসরে কখনও খেয়াল গান করেননি। অথচ কত কত বার ওঁর আসরে ঠুংরি পদবিস্তার কী গজলের আলফজ নিয়ে খেলা শুনতে শুনতে শ্রোতা আঁচ পেয়েছেন ওই কারুকার্যের পিছনে ঝিম খেয়ালের অবদানের।
সত্যি বলতে কী, ষাট ও সত্তর দশকে বাঙালি যখন ঝেঁটিয়ে জলসায় গিয়ে গিয়ে বেগমকে শুনছে, তখন তিনি খ্যাতি ও মহিমার শীর্ষবিন্দুতে। গজল, ঠুংরি, দাদরা, কাজরি ইত্যাদি নিয়ে এক বিস্ময় প্যাকেজ। আর ওই গানেই যে কত বিচিত্র তালিম ভরে রেখেছেন তা বলতে গেলে পেল্লায় তালিকা গজিয়ে যায়। ওঁর শতবর্ষের পুণ্যক্ষণে দাঁড়িয়ে ওই জীবনভর ঈষৎ আকার জানা কাজের হবে।
কিরানার বেহেরে ওয়াহিদ খানের কথা বলা হয়েছে। বলতে হয় পাটিয়ালার আতা মহম্মদ খানের তালিমের কথা।
এক সময় সদ্য তরুণী কন্যাকে নিয়ে ওঁর মা এসেছিলেন কলকাতায় মেয়ের তালিমের বঢ়হতের জন্য। আখতারি পেলেন মহম্মদ খানকে। এরপর নাড়া বাঁধলেন উস্তাদ ঝন্ডে খানের কাছে।
এই প্রথাসিদ্ধ শিক্ষা দিয়ে বলা চলে বেগম আখতার ওঁর তালিমের শুধু ভিত গড়েছিলেন। পনেরো বছর বয়েসে প্রথমে আসরে গেয়ে ও কিঞ্চিৎ পরে মেগাফোনে ওঁর জনপ্রিয় সব গান রেকর্ড করে আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি বাকি জীবনটা শুধু সুর, গান আর তালিম খুঁজে গেলেন।
যখন গজল দাদরা গেয়ে বিপুল পসার তখনও উস্তাদদের দক্ষিণা দিয়ে, বাড়িতে রেখে খেয়াল, ঠুংরির তালিম নিয়ে গেছেন। সিনেমায় অভিনয় করছেন যখন তখনও সময় করে উস্তাদদের সঙ্গ করেছেন। জ্ঞানবাবুকে বলেছিলেন যে এভাবেই তিনি আতা মহম্মদ খান, বরকত আলি খান ও বড়ে গুলাম আলি খানের থেকে তালিম গুছিয়েছেন।
সেতারি বিলায়েৎ খান সাহাবের কাছেও খেয়াল বন্দিশ ও ঠুংরি সংগ্রহে ইরাদা হয়েছিল বেগমের। খান সাহেবের বম্বের বাড়িতে আসতেন, আর একটাই মিনতি, ‘আমাকে কিছু শেখাও।’
সেতারি বলেছিলেন আমাকে, ‘আরে ভাই, কী আর্টিস্ট আখতারি! আমি তো ওঁর ফ্যান। কোকিলকে কি গান শেখাতে হয়? কিম্তু আখতারি বলে ‘চিজে তো কুছ ডালো মেরে ঝোলিমে।ঁ’ তারপর বিলায়েৎ খান যা বলেছিলেন তা শুধু স্মৃতিকথায় নয়, গল্পে লেখার মতো। বললেন, “তিলক কামোদে একটা লাওনি আছে মধ্যলয়ে। দাগ দেহেল্ভি সাহেবের রচনা কবিতায়— উজ্র আনে মেঁ ভি হ্যায়/ অউর বুলাতে ভি নেহি। আখতারি যখন ও গান গায়, ওই মধুময় গলায় কেঁদে কেঁদে গায়, আর ঠিক এক জায়গায় এসে গলাটা ভেঙে দেয় তখন আমার মনে এসে যায় সেই রাত যখন ইংলন্ডে প্রোগ্রাম করে এসে দেখি আমার প্রেমিকা আমার ফোন নিতে চাইছে না, আমাকে অ্যাভয়েড করে যাচ্ছে। কী বলব, সারা রাত ধরে মদ খেয়েছি, আর গান শুনেছি, যেন সেদিনই শেষ রাত।”
বেগমের অমর করে রাখা সেই কবিতার দু’চারটি পঙ্ক্তির তর্জমা দিলে খান সাহেবের ভেতরের সেই কান্নার একটা আন্দাজ দেওয়া যায়।
“চলে যেতে ইচ্ছে হয় না/ আবার সে ডাকেও না/ দেখা না করার কারণও বলে না।/ এমন চিকের আড়ালে বসে যে দেখতেও পাই না।/ পুরোপুরি লুকোও না আবার স্পষ্ট ধরাও দাও না।/ সম্পর্ক যখন ছিন্ন হয়েছে, তখন আর এ জুলুম কেন? যার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তাকে আর জ্বালানোর কী আছে?/জীবন যখন দুর্বিষহ, ওহে দাগ (কবি), তবে বেঁচে আছ কেন?/ প্রাণের প্রতি কোনও মোহ নেই, আবার মরণও হয় না।”
শুধু বিলায়েৎ খান কেন, এ মরণ তো সারা দুনিয়ার যারা দাগ-এ এই শের রেকর্ড চালিয়ে শুনছেন বেগম আখতারের গলায়। শুধু সেই বিপুল ভক্তসমাজের সামান্য অংশেরই খোঁজ আছে যে এই প্রাণকাঁদানো গানের অনেকখানি জুড়ে গায়িকার নিজের জীবনের কান্না।
ওঁর মা মুশতারির প্রেমে পড়ে তাঁকে বিয়ে করেছিলেন, তরুণ উকিল আসগার হুসেন। মুশতরির দুই কন্যা জোহরা ও বিবি (বেগম আখতার) সমেত তাঁকে পরে পরিত্যাগ করেন উকিল সাহেব।
কাজেই আখতারিকে বালিকা বয়স থেকেই গানে ভিড়তে হয়েছে জীবিকার প্রয়োজনে। সুখের এই যে, গানকে সেই শুরুর থেকেই শুধু জীবিকা করে রাখেননি। সূক্ষ্ম, ধারালো ও মর্মবিদারী করে অশ্রুর অস্ত্র করেছেন। ওঁর গানকে করেছেন, ফরাসি কবির ভাষায় ‘লঁপির দ্য দুলর’, ব্যথার সাম্রাজ্য।
অথচ এই গানকেই এক সময় ছেড়ে বসতে হল বেগমের। প্রচুর নামযশের অধিকারিণী যখন তিনি, তখন লখনউয়ের নবাব বংশের এক সহৃদয় রইস ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। স্বামী ইস্তিয়াক সাহেব সহৃদয় তো ছিলেনই, সেই সঙ্গে চমৎকার হকি খেলোয়াড়।
লখনউয়ের হকি দলের হয়ে কলকাতায় বেটন কাপে খেলতে আসতেন। অথচ স্ত্রী কলকাতায় তো গাইতে আসতে পারবেনই না, এমনকী বাড়ির বাইরে কোনও আসরেই নয়। বিবাহবন্ধনের এমনই শর্ত যে গান তাঁকে ছেড়ে দিতেই হবে!
পাঁচ-পাঁচটা বছর বাড়ির ভিতরেও গান করা ছেড়ে দিয়েছিলেন বেগম আখতার। তখন দেশের সব শহর-নগরের ভক্তদের মনে একটাই জিজ্ঞাসা, যা বহু পরে ওঁর জন্য লেখা ও সুর করা জ্ঞানবাবুর রাগপ্রধানের কথায় ব্যক্ত করা যায়— ‘ফিরে কেন এলে না।’
শ্রোতৃসমাজের আবেগ— আরেক রাগপ্রধানে ব্যক্ত: ‘ফিরায়ে দিও না মোরে শূন্য হাতে’— একটা সময় বেগমকে ফের ফিরিয়ে এনেছিল গানের আসরে।
শর্ত থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন গায়িকা, এবং দেখা গেল— বলছেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ— “গান কিন্তু তাঁর মন থেকে মুক্তিলাভ করেনি।’ বরং এই দ্বিরাগমনে স্পষ্ট হল বেগমের কণ্ঠ আরও ভারী, অন্তর্মুখীন ও বকাফনা-য় ঋদ্ধ হয়েছে। বকাফনার অর্থ জীবন-মরণ। সুফিবাদে নারী ও পুরুষের মতো ভক্ত ও ভগবানের সম্পর্কের এক শেষ সোপান বকাফনা। বেগম ফের যখন আসরে এলেন, গানের এই জীবন মরণ দোলাচল ওঁর গায়কিতে ভর করেছে। যার সুফল বর্তেছে ওঁর পরবর্তী কালের গজলের পেশকারিতে। যখন ইচ্ছেমতো পুরুষ ও প্রকৃতির প্রেমে অবলীলায় ছোঁয়া এনে দিচ্ছেন অধ্যাত্মের। যেমন গালিবের রচনা ‘ইব্নে মরিয়ম হুয়া করে কোই/ মেরে দুখ কি দাওয়া করে কোই’। অর্থাৎ ‘যদি মরিয়মের মতো কন্যা হয়ে/ আমার দুঃখে প্রলেপ দেয় কেউ।’
তবু সব কিছুর পরেও, বেগম আখতার থেকে গেছেন রোম্যান্টিক গানের, বিচ্ছেদের বাণী ও সুরের, এলিজির ট্র্যাডিশনের এক সেরা নিবেদিতা।
পণ্ডিত রবিশঙ্কর একদিন এই ব্যাপারটাই সুন্দর বোঝাচ্ছিলেন। বললেন, “গজল বা ঠুংরির কথাগুলো এমন ভাবে ফেলতেন যে শ্রোতাদের প্রত্যেকেরই ধারণা হত যেন কথাগুলো শুধু তারই উদ্দেশে বলছেন আখতারি। এই ইন্টিমেসি, গানের এই কেমিস্ট্রিতে তারা দিওয়ানা হয়ে যেত।”
আপনি দিওয়ানা হয়েছিলেন?— জিজ্ঞেস করেছিলাম ওঁকে। রবিশঙ্কর বললেন, “ওঁর ব্যাপারে আমার হয়নি। তার কারণ ওকে যখন প্রথম দেখি তখন আমি বাবার সেই কড়া শাসনের মধ্যে ছিলাম, চট করে ওই গায়িকা শ্রেণির লোকের ধারে-কাছে যেতে ভয়-ডর ছিল। সে সময়ে বিয়েও হয়েছে আমার অন্নপূর্ণার সঙ্গে। কাজেই দিওয়ানা হওয়ার কোনও সুযোগ আমার ছিল না।
তবে এই বেগম আখতারের জন্য একটা ছেলে লখনউতে তো বিলকুল পাগল হয়ে গিয়েছিল। ছেলেটার বয়স তখন আঠাশ কী তিরিশ। কিন্তু বেচারি কিছুতেই বুঝবে না আখতারি ওকে চায় না। তাকে ধরে মারধরও করা হয়েছিল। কিন্তু কে কার কথা শোনে! শেষে রাস্তায় রঙিন রঙিন চক দিয়ে বড় বড় করে লিখত— ‘আখতারি, আখতারি...।’ না, এরকম অবস্থা আমার কখনও হয়নি এ জীবনে।”
হয়নি, তবে হতে পারত। এই হওয়া, না-হওয়ার টানাপড়েনেই কিন্তু বাঙালিকে রেখে গেলেন বেগম আখতার শেষ জীবনে উর্দু গজল, হিন্দি ঠুংরি দাদরা আর বাংলা রাগপ্রধানে। যদিও প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিল সুদূর অতীতে, জ্ঞানবাবুদের যৌবনকালে।
জ্ঞানবাবু ওঁর উস্তাদ, তবলাশিল্পী মসিত খান ও তাঁর পুত্র কেরামতুল্লাহ খানকে কত কত বার যে শুনেছেন সেকালে আখতারি বাইয়ের গান গুনগুনিয়ে গাইতে। উস্তাদ মহলে এ কোনও নতুন ব্যাপার ছিল না। কিন্তু একদিন চলচ্চিত্রাভিনেতা রাধামোহন ভট্টাচার্য (যাঁর তালিম ছিল বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গীতে) একদিন ওঁকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, “ওহে জ্ঞান, তুমি এই গানটি জানো?” বলে গুনগুনোলেন ‘ছা রহি কালি ঘটা।’ রাধামোহন বলেননি বা বলতে পারেননি গানটা কার গাওয়া বা কোথায় শুনেছেন। বেগম আখতারের গান তখন এভাবেই ছড়িয়ে রয়েছে বাঙালির মধ্যে।
আর ষাট-সত্তর দশকে যা ঘটল একটা আসরের কথা বলব।
১৯৭১-এর সম্ভবত জুনে, রবীন্দ্র সদনে আয়োজিত ক্যালকাটা মিউজিক সার্কেলের অনুষ্ঠান। দামি নীল শিফন বা জর্জেটের শাড়িতে আসরে এসে বিলকুল এক ডিভার মতো বসলেন বেগম। হল জুড়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।
গানের শুরুতে ওই যে ‘অ্যায়...’ বলে একটা লম্বা টান দিলেন তাতেই ‘অ্যায় মোহব্বত’-এর জান তৈরি হয়ে গেল। তারপর তো ওই অলটাইম ফেভারিট ‘ও যো হম মেঁ তুমমেঁ করার থা’ এল, দেখতে দেখতে এল ‘দিওয়ানা বনানা...’ এবং শেষের দিকে এক সময় ‘কোয়েলিয়া মৎ করে পুকার।’
বলা বাহুল্য, হল ‘ওয়াহ্! ওয়াহ্!’’, ‘বহুত খুউব’ আর ‘কেয়া বাত’-এ ভেঙে পড়ছিল গানে গানে। কিন্তু আরও বেশি যেটা নজর কাড়ছিল সেটা গান চলাকালীন, গোটা অডিয়েন্সকে বেগম যেন একটা সংলাপে বেঁধে ফেলছিলেন।
শ্রোতা উর্দু শেরের সব বুঝুক না বুঝুক, কথার চালে, সুর আর ছন্দের রকম ও ঝোঁক-ফাঁকে হেলছে এবং দুলছে। তাঁকে মনে করা হয় ওঁর গানের হিপনোটিজম।
এরপর ওঁর শেষ আসরের কথায় আসি। ফরাশ পেতে ত্যাগরাজ হলে। এবং বাস্তবিকই বর্ণনার অতীত। নিজের পছন্দ গাইছেন, শ্রোতার ফরমায়েস গাইছেন, কে বলবে এই হতে চলেছে কলকাতায় ওঁর শেষ আসর।
বাঙালি ভক্তদের তদ্দিনে ঠোঁটে উঠে গেছে ‘জোছনা করেছে আড়ি’, ‘পিয়া ভোলো অভিমান’ কিংবা ‘ফিরে যা, ফিরে যা বনে।’ ফিরেই গেলেন আমাদের সম্বৎসরের কোকিল, তবে বনে নয়, স্মৃতি ও ইতিহাসের ধূপছায়া ভূগোলে।
ক’দিন পরেই খবর এল ইলাহাবাদে অনুষ্ঠানে গান গাইতে গাইতেই ইন্তেকাল হয়েছে বেগমের। ওঁর গণনাতীত বাঙালি ভক্তদের মনে হয়তো বড্ড বেশি করে বাজছে তখন রবি গুহমজুমদারের কথা ও সুরে রেকর্ড করা বেগমের ‘চুপি চুপি চলে না গিয়ে সে কেন বিদায় নিল না হেসে।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy