নার্গিস নিয়ে কলকাতার যে-অবসেশন সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই দেখে আসছি তার একটাই জুড়ি কলকাতার সুচিত্রা-মুগ্ধতা।
তবে, আর এ একটা মস্ত ‘তবে’, তখনকার ফিল্ম-প্রাজ্ঞরা কিন্তু অভিনেত্রী হিসেবে সুচিত্রাকে নার্গিসের পাশে বসাতেন না।
তার পর ১৯৫৭-য় ‘মাদার ইন্ডিয়া’ হয়ে যাবার পর ওঁর সঙ্গে ভূ-ভারতে কারওর তুলনা করা বন্ধ করে দিয়েছিল কলকাতা।
সে সময় আমরা ছোটরা নার্গিস নিয়ে একটু ঘাবড়ে ঘাবড়ে থাকতাম। কারণ আমরা যা-ই পছন্দ করতাম বড়রা তাতে নাক সিটকোত।
অথচ ‘আওয়ারা’, ‘শ্রী৪২০’, ‘চোরি চোরি’ দেখে আমরা যখন নার্গিসে আত্মহারা তাতে ওদের তেমন বাঁকা কথা কিছু শুনতে হল না। কী ঢলাঢলি, রোম্যান্টিক চেকনাই নায়িকার এসবে, বড়রা তবু কাটিয়ে দিল এই বলে, “আরে নার্গিস দেখতে হলে ‘আগ’ দেখতে হয়, ‘বরসাত’ দেখতে হয়, ‘অন্দাজ’ দেখতে হয়, ‘যোগান’ দেখতে হয়।”
‘মাদার ইন্ডিয়া’ এসে শেষে বড়দের আর আমাদের বিলকুল আমে-দুধে মিশিয়ে দিল। তার পর একদিন আমার রাশভারী কাকাই দেখি সোসাইটি সিনেমার দুটে টিকিট কিনে এনে আমায় নার্গিস আর রুশ অভিনেতা ওলেগ-এর ছবি ‘পরদেশি’ দেখতে নিয়ে গেলেন।
বহু দিনের ছাড়াছাড়ির পর ফিরে এসে ওলেগ যখন জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছেন স্ত্রী (নার্গিস) কোলের বাচ্চাকে ঘুম পাড়াচ্ছেন, আমার দু’চোখ দিয়ে জল বইছে।
মায়ের অমন আকর্ষক ও পবিত্র মুখ তার আগে ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ছাড়া আর কোনও হিন্দি ছায়াছবিতে কখনও দেখিনি। বাংলায় শুধু চোখে ভাসত ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’র মা।
এই নার্গিসই যখন ১৯৬৭-তে ওঁর অভিনয়জীবন শেষ করলেন ‘রাত অউর দিন’ করে, কলকাতার ফিল্মবোদ্ধা বাঙালি আরেকবার দেদার হকচকালো। নার্গিস বলতে চিরকাল যে-দোলাচলে সে প্রবল আধুনিক নখরা এবং গভীর অন্তর্মুখিন অভিনয়, সেই দুই মেরুকেই যেন একই নায়িকার রোলে বাঁধলেন তিনি।
একই নারী, দিনে এক, রাতে আরেক। দিনে সাত্ত্বিক গৃহিণী, সন্ধে গড়ালে ধূমপান, মদ্যপান, বহির্জীবন নিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চরিত্র। ঢুলু ঢুলু চোখে ধোঁয়ার রিং ভাসানো সেই নার্গিসের প্লে-ব্যাকে যখন লতার গান ভাসে ‘রাত অউর দিন দিয়া জ্বলে মেরে মনমে’, কলকাতার বুঝতে বাকি থাকে না নায়িকার বিচিত্রধর্মী অভিনয়কলার বৃত্তটি পূর্ণ হল। এই অভিনয় ওঁকে সেরা নায়িকার জাতীয় পুরস্কারও এনে দেয়।
‘রাত অউর দিন’ কলকাতার প্রিয় ছবি হয়েছিল মনে আছে। নার্গিসের ‘যোগান’ ও ‘বরসাত’ ছবির ভক্তপ্রজন্মকে মিলিয়ে দিয়েছিল ‘আওয়ারা’, ‘শ্রী ৪২০’ ভক্তদের সঙ্গে। যার কিছু দিনের মধ্যেই এক বিকট প্রজন্মবিভাজন এসে পড়ে বাঙালি জীবনে নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষিতে।
আমরা সেই ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছি কলকাতার সঙ্গে নার্গিসের যোগাযোগের কথা। উচ্চাঙ্গ গানের রসিকরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন ওঁর মা জদ্দনবাইয়ের গানের।
বিশের দশকে বেশ কিছুকাল জদ্দনবাই থেকেছেন উত্তর কলকাতায়। সঙ্গ করেছেন উস্তাদ এনায়েৎ খানের মতো অমর সেতার শিল্পীর এবং এখানেই নার্গিসের জন্ম ১৯২৯-এর ১ জুন।
জন্মের পর নামকরণ হয়েছিল ফতিমা রশিদ। নার্গিস নাম হয় ১৯৩৫-এ যখন শিশুশিল্পী হিসেবে ‘তালাশে হক’ ছবিতে নামলেন। পাকাপাকি ভাবে ছবিতে এলেন ১৯৪২-এ। এবং নার্গিস নামটাই থেকে গেল চিরকালের মতো।
কলকাতা প্রেমে পড়েছিল নার্গিসের আরেকটি ভূমিকায়— ‘আদালত’ ছবির ওই বাইজি নায়িকার। ‘রাত অউর দিন’ ছবির মতো এ ছবিরও নায়ক অতীব সুপুরুষ বাঙালি। প্রদীপকুমার।
কলকাতার মন কেড়েছিল ছবির এক মুজরোর দৃশ্য, যেখানে লতার কণ্ঠে বেদনার্ত অভিনয়ে নার্গিস গাইছেন রাজিন্দর কৃষনের কথায়, মদনমোহনের সুরারোপে হিন্দি চলচ্চিত্রের এক সেরা গজল ‘উনকো ইয়ে শিকায়ত হ্যায় কি/হম কুছ নহি কহতে,/ আপনা তো ইয়ে আদত হ্যায় কি/ হম কুছ নহি কহতে।।’’ (উনি কেবলই বলেন যে/ আমি কিছু বলি না/ আমার স্বভাবই এই যে/ আমি কিছু বলি না।)
‘আদালত’ ছবির নায়িকার মতো নার্গিস নিজের দুঃখ, বেদনা, অভিমান ও আকাঙ্ক্ষার কথা আজকালকার তারকাদের মতো বলে বেড়াননি কখনও। নীরবতাই বলা যায় ওঁর চরিত্রের শক্তি ছিল। খুব অল্প কথায় অনেক কিছুই বুঝিয়ে দিতে পারতেন। এরকম এক ঘটনার সাক্ষী আমি নিজে।
রবিশঙ্কর তখন সবে গুলজারের ‘মীরা’ ছবির সুরারোপের কাজ করেছেন। নার্গিস প্রতিষ্ঠিত অজন্তা আর্টস-এর ছোট্ট বিলাসবহুল প্রেক্ষাগৃহে সেটির এক বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হয়েছিল। রবিশঙ্কর ওঁর তখনকার সঙ্গিনী কমলা ও আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। ছবি দেখতে এসেছিলেন ছবির নায়িকা হেমামালিনী এবং সেই সন্ধ্যার হোস্ট নার্গিস।
রাজকপূরের সঙ্গে
ছবিটা খুবই সাধারণ। আরও সাধারণ হেমার অভিনয়। ছবি শেষ হতে দেখি রবিশঙ্করের সঙ্গে ওঁর সুরারোপ নিয়েই কথা বলে যাচ্ছেন নার্গিস। আমাদের জন্য চমৎকার হাই টি-র ব্যবস্থা করেছিলেন। বললেন, ‘‘আপনারা একটু যত্ন করে খান, প্লিজ। তবে আমাকে একটু ছুটতে হবে একটা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। কপাল!’’
নার্গিস তখন প্রেক্ষাগৃহের দরজার কাছে। রবিশঙ্করকে নমস্কার করছেন। হঠাৎ হেমা বলে বসলেন, ‘‘আমার কাজটা নিয়ে কিছু বলবেন না?’’
অমনই ভাবুক মুখ হয়ে গেল নার্গিসের। তারপর সামান্য হেসে বললেন, ‘‘হেমা, তুমি আমার ‘যোগান’ ছবিটা পারলে দেখে নিয়ো।’’
বাড়িতে ফেরার পথে রবিশঙ্কর বললেন, ‘‘দেখলে তো কী গ্রেসফুলি হেমার রোলের সমালোচনা শুনিয়ে দিল নার্গিস। ‘যোগান’-এ তো ক্লাসিক অভিনয়, ওই মীরাবাঈ টাইপেরই এক যোগিনী রোল। আর কী বলবে?’’
এই সদা সংবৃত নার্গিসই ১৯৮০-তে রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য হয়ে সোচ্চারে সমালোচনা করে বসলেন সত্যজিৎ রায়ের। বললেন, ‘‘ওঁর ছবিতে ভারতের দারিদ্র দেখিয়ে সত্যজিৎ বিদেশের পুরস্কার তুলে নিচ্ছেন।’’
তার জবাবে সত্যজিৎ বেশ বিনম্রভাবেই জানিয়েছিলেন, ‘‘কই আমার তো গোটা তিন-চার ছবিতে দারিদ্র আছে। বাকি কাজে তো নেই।’’
এতে সত্যজিৎ-ভক্ত বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা বেশ দুঃখ পেয়েছিলেন। বলা শুরু করলেন, ‘‘মানিকবাবু আবার এত নরম হতে গেলেন কেন? ওঁর বলা উচিত ছিল, বেশ করেছি। তিনটে কেন, তিরিশটা ছবি করব দারিদ্র নিয়ে। ছবি ভাল হল কি না সেটাই দেখুন।’’
যা হোক, এ তরজা বেশি দূর গড়ায়নি। এর অল্প ক’দিন পর ক্যানসারে অসুস্থ হয়ে পড়লেন নার্গিস। এবং ১৯৮১-র ৩ মে চলে গেলেন। সত্যজিতের জন্মদিনের পরের দিন।
মাত্র ৫১ বছর বয়েসে, ৫১টি ছবি (৫০টি হিন্দি, ১টি গ্রিক ভাষায়) করে ভারতের সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ট ফিল্ম-অভিনেত্রীর স্বীকৃতি দখলে। ওঁর মৃত্যুতে ওঁর প্রতি অতি উচ্চ সমাদর জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।
নার্গিসের ছ’বছর বয়েসে সিনেমায় প্রথম অভিনয়ের বয়স এ’বছর আশিতে পড়ল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy