রাজস্থানে ‘সোনার কেল্লা’
আর একটু হলেই ‘সোনার কেল্লা’ থেকে ছিটকে যাচ্ছিলেন জটায়ু সন্তোষ দত্ত!
আমি তখন সবে সন্তোষদা’র জুনিয়র হিসেবে কোর্টে যেতে শুরু করেছি। একটা হত্যাকাণ্ডের মামলা নিয়ে ওঁর তখন দিন রাত এক হয়ে গেছে।
তার মাঝেই একদিন ফোন এল বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়ি থেকে। ফোন রেখে গম্ভীর মুখে সন্তোষদা বললেন, “এ তো মহা মুশকিলে পড়লাম দেখছি। মানিকদা ফোন করেছিলেন। আমাকে জটায়ু করার জন্য বললেন। রাজস্থানে এক মাসের শ্যুটিং। যেদিন যাবার কথা সেদিনই মামলার শুনানি। কী করি বলো তো?”
তখনকার সময়ে আদালতে দিন পড়লে মুলতুবি নেওয়া অত সহজ ছিল না। সন্তোষদা সোজাসুজি ফোন করলেন মামলায় বিরোধী পক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটরকে। সব খুলে বললেন। চেয়ারের উল্টো দিকে বসে শুনতে পাচ্ছি, ওপার থেকে উত্তর ভেসে আসছে, “অত ঘাবড়াবার কী আছে? শুনানি যাতে না হয় তার সব বন্দোবস্ত আমি করব। তুমি শুধু একটা পিটিশান করে নিয়ে এসো।”
জজ সাহেব ছিলেন শচীন সান্যাল। পিটিশান নিয়ে ওঁর ঘরে আমরা তিনজনে হাজির হলাম। জজকে সত্যি কথাটাই বললেন সেই পাবলিক প্রসিকিউটর। সঙ্গে এও বললেন, “মামলাটা যদি এক মাস পিছিয়ে যায়, আমার কোনও আপত্তি নেই।” শচীন সান্যাল সব শুনে বললেন, “ঠিক আছে, আপনি ওঁর বিরোধী হয়েও যখন এ কথা বলছেন, আমি অ্যালাও করে দিচ্ছি।” এ ভাবেই ‘জটায়ু’র ছাড়পত্র পেয়েছিলেন সন্তোষদা। কী সব সময় ছিল!
টানা এক মাস ছিলেন রাজস্থানে। ফিরে এসে খুব উত্তেজিত হয়ে গল্প করতেন। তার অর্ধেকের বেশি থাকত ওঁর মানিকদাকে নিয়ে, “উফ্, অমন অঙ্ক কষে ছবি করা ভাই, আমি আর কাউকে করতে দেখিনি। একটুও সময় নষ্ট হবার জো নেই। শটগুলো ছবির মতো আঁকা। আর ডিসিপ্লিন! স্প্লেনডিড্।”
অসম্ভব আপ্লুত হয়েছিলেন ‘হীরক রাজার দেশে’ করেও। শ্যুটিং-এর শুরুতে নাকি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না, ওঁর অভিনীত বিজ্ঞানীর চরিত্রটির ডায়লেক্ট কেমন হবে। “মানিকদাকে বললাম। উনি বললেন, শোনো, যখন ধরাচুড়ো গায়ে উঠবে, দেখবে সংলাপ নিজের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। যেটা তখন বলবে, সেটাই হবে তোমার স্টাইল! কী অদ্ভুত শেখানোর কায়দা বলো তো!” ঘটনা হচ্ছে, তাই-ই হয়েছিল।
‘সোনার কেল্লা’-র শ্যুটিং সেরে এসে আরেক জনের কথা প্রায়ই বলতেন। কামু মুখার্জি। গোটা শ্যুটিঙে খুব মজা করতেন কামু। এর পিছনে লাগতেন, ওর জুতো লুকোতেন, তার জামা হারিয়ে দিতেন। আর খুব খেতে ভালবাসতেন। ওখানে ব্রেকফাস্টে থাকত কর্নফ্লেক্স, দুধ, কলা, ডিম...। অনেকেই পুরোটা খেতে পারতেন না। বাকিটা চলে যেত কামুর প্লেটে। ওঁর আগাম নির্দেশমতো। কামু নাকি অনায়াসে দু’লিটার দুধ, কী ছ’টা কলা বা চারটে ডিম খেয়ে ফেলতে পারতেন। এই কামু মুখার্জির সঙ্গে অভিনয় করতে গিয়ে একবার কিন্তু একটু হলেও ভয় পেয়েছিলেন সন্তোষদা।
জয় বাবা ফেলুনাথ। মগনলাল মেঘরাজের ডেরা। সেই বিখ্যাত শট। জটায়ুকে দাঁড় করানো হয়েছে গোল চাকতিতে পিঠ ঠেকিয়ে। উল্টো দিকে ছোরা হাতে দাঁড়িয়ে তার বৃদ্ধ শাগরেদ ‘অর্জুন’ কামু।
অর্জুনের হাতের ছোরা একে একে গিয়ে বিঁধবে জটায়ুর আশেপাশে। এ দৃশ্যর কথা আগের দিনই সত্যজিত্ রায় বলে দিয়েছিলেন সন্তোষদাকে। সকালে শ্যুটিং যাবার আগে বৌদিকে সন্তোষদা বলেছিলেন, “আজ কী যে হবে জানি না বাপু। মানিকদা যা সব ছোরাছুরির কথা বলছিলেন, একটু এদিক ওদিক হয়ে গায়ে না গেঁথে যায়!” পরে হাসতে হাসতে সে-গল্প বহুবার বলতেন।
সন্তোষদা এত গল্প করতেন, অথচ খেয়াল করে দেখেছি, ছবির নায়িকাদের নিয়ে কিন্তু কোনও দিন মুখ খুলতেন না। বরং অভিনেতাদের এক-আধজন সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত ছিলেন তিনি। সে শুধু অভিনয়ের জন্য নয়, তাঁদের স্ট্রাগলের কারণে। তার প্রথম নামটা যদি হয় উত্তমকুমার, তো দ্বিতীয় জন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সৌমিত্রবাবু প্রায়ই আসতেন সন্তোষদার আমহার্স্ট রো-এর বাড়িতে। তখনই জেনেছিলাম, সৌমিত্রবাবুদের নাকি কোনও ভাবে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে।
নায়িকাদের কথা তেমন বলতেন না বটে, তার মানে এই নয় যে, মনে মনে সন্তোষদা খুব গোঁড়া ছিলেন। জুনিয়রদের সঙ্গে নির্দ্বিধায় সিগারেট চালাচালি করে খেতেন। চেম্বারে সবার সামনে একটু আধটু ড্রিংকও।
তবে বিরাট কিছু শখআহ্লাদ করতে কোনও দিন দেখিনি। থাকতেন অতি সাধারণ একটা বাড়িতে। মানিকতলায় ছায়া সিনেমার পাশে ছোট পেট্রোল পাম্পের গা ঘেঁষে যে রাস্তাটা আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে চলে গেছে, তারই ভেতরে ঢুকে খানকতক বাড়ি ছাড়ালে ডান ধারে একটা গলি।
ওই গলিতেই সন্তোষদার দোতলা পৈতৃক বাড়ি। সুরধনী কুটীর। নীচের তলায় চেম্বার, রান্নাঘর, বাথরুম। ওপর তলায় দুটো ঘর।
সন্তোষদার বাবা-মা মারা যাওয়ার পর সে-বাড়িতে সন্তোষদা ছাড়া আর থাকতেন স্ত্রী, আমাদের প্রতিমা বৌদি আর মেয়ে লাবণ্য।
সাদামাঠা বাড়ির মতোই ওঁর সাজপোশাকেও কোনও দিন বাহুল্য দেখিনি। অনুষ্ঠান-টনুষ্ঠান থাকলে বড়জোর সাদা পাঞ্জাবিটা গিলে করে নিতেন। সঙ্গে বেশির ভাগ সময়ই সাদা পাজামা। কালেভদ্রে ধুতি। গায়ে একটু ‘সেন্ট’। ব্যস্।
এত সাদাসিধে থাকতেন যে, একটা গাড়ি কেনাতে জান বেরিয়ে গিয়েছিল। অথচ কী প্রচণ্ড যে জরুরি হয়ে পড়েছিল তখন গাড়িটা কেনার!
’৭৮ সাল। সন্তোষদাকে তখন এক ডাকে লোকে চেনে। অথচ তখনও কোর্ট যেতেন তেরো নম্বর ট্রামে করে। আমরা একসঙ্গে ফিরতাম জিপিও-র সামনে থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে মিনিবাসে উঠে। ট্রামে-বাসে উনি উঠলেই চাপা গুঞ্জন শুরু হত। কিছু কিছু মন্তব্যও ভেসে আসত। আমারই বেশ অস্বস্তি লাগত। পাশে বসে সন্তোষদা কিন্তু নির্বিকার।
একদিন বললাম, “অনেক হয়েছে। এ বার বাস-ট্রামে ওঠাটা ছাড়ুন তো।” বললেন, “তা হলে কি হেঁটে যাব?” বলে সত্যি সত্যিই ডালহৌসি থেকে মানিকতলা বেশ কয়েক দিন হেঁটে ফিরতে বাধ্য করলেন আমাকেও। এক-এক দিন এক-একটা রুটে। দেখতেন কোন রুটে হাঁটলে সময়টা কম লাগে। হাজার বার বললেও গাড়ি কেনাতে ভ্রুক্ষেপ করতেন না।
শেষে এক সিনিয়র ব্যারিস্টার জে কে দাস জোর দিয়ে বলাতে রাজি হন। দাসসাহেবই ওঁর জন্য গাড়ি আনিয়ে দেন। নেভি ব্লু রঙের অ্যামবাসাডর। ডব্লু বি এফ ৬৮৮। এক সময় যে চারচাকাকে গোটা কলকাতা চিনত জটায়ুর গাড়ি বলে। এমনকী সন্তোষদা গাড়ি কেনার পর সত্যজিত্ রায় তাঁর একটি কাহিনি শুরুই করেছিলেন ‘অবশেষে জটায়ু গাড়ি কিনলেন’ এরকম একটা লাইন দিয়ে।
গাড়ি তো কিনলেন, কিন্তু গাড়ির বিন্দু বিসর্গ জানতেন না। চালানো দূরঅস্ত, লক ঘুরিয়ে দরজাটা পর্যন্ত খুলতে পারতেন না। গাড়ির যাবতীয় ব্যাপারস্যাপার ছেড়ে দিয়েছিলেন আমার ওপর। ড্রাইভার থাকা সত্ত্বেও আমি পাশে থাকলে কাউকে স্টিয়ারিং-এ বসতে দিতেন না। লং ড্রাইভেও তাই। স্টুডিয়ো থেকে আনা তো বটেই, নাটকপাড়ায় নিয়ে যাওয়া, কোর্টে যাতায়াত, সবেতে আমিই সারথি হতাম।
যৌবনে সন্তোষদার একটা শখের গল্প অবশ্য শুনেছি। ফুটবল। মোহনবাগানের পাঁড় ভক্ত। রীতিমতো টিকিট কেটে গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতেন। আমি অবশ্য এই সময়টায় ওঁকে দেখিনি। তবে যখন ’৮২ সালে নেহরু কাপ হল, মনে আছে, কোর্ট থেকে সন্তোষদার নেতৃত্বে আমরা বেশ কয়েকজন একসঙ্গে খেলা দেখতে যেতাম।
আর একটা শখ প্রবল ছিল ওঁর। রান্না। ছুটির দিন হলেই বাজারে গিয়ে নিজের হাতে মাংস আনতেন। বাড়ির ‘হেল্পার’দের দিয়ে পেঁপে-পেঁয়াজ বাটিয়ে ম্যারিনেট করতেন। চেম্বার করতে করতেই রান্না বসাতেন। বিশাল কিছু খেতে যে ভালবাসতেন, তা নয়। অল্পাহারী ছিলেন। কিন্তু যতটুকু খেতেন, খুব গুছিয়ে দিতে হত বৌদিকে।
বৌদির সঙ্গে সন্তোষদার সম্পর্কটা ছিল দেখার মতো। সব সময় একটা খুনসুটি চলতেই থাকত। সেই প্রথম জীবন থেকেই।
ওঁদের বিয়ে হয়েছিল খুব অল্প বয়েসে। বৌদি তখন এগারো, সন্তোষদা উনিশ। বিদ্যাসাগর কলেজের থার্ড ইয়ারের ছাত্র।
সন্তোষদার শ্বশুরবাড়ি ছিল মানিকতলার কাছেই। কারবালা ট্যাঙ্ক লেনে। শ্বশুরমশাই প্রায় দিন মেয়ের হাতে অল্প কিছু টাকা দিয়ে যেতেন। খোঁজ পেলেই টাকা কেড়েকুড়ে বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা চলে যেতেন সন্তোষদা। বৌদিকে বলেছিলাম, “আপনি কিছু বলতেন না?” উত্তর পেয়েছিলাম, “বলব কী! ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতাম।”
সন্তোষদার বাবা বলতে গেলে ‘ভয় পেয়ে’ অত কম বয়েসে ছেলের বিয়ে দিয়ে দেন। আসলে ছোট থেকেই সন্তোষদার খুব নাটকের শখ। বর্ধমানের পলাশিতে কুরমুন গ্রামে ছিল ওঁর দেশের বাড়ি। সেখানে পালাপার্বণে নাটক হত। তাতেই শৈশবে ওঁর হাতে খড়ি। প্রথম নাটক করেন ‘সাজাহান’-এ। সাত বছর বয়েসে। ওঁর বাবারই ক্লাবে। সন্তোষদার বাবারও নাটকের খুব শখ ছিল। কিন্তু ছেলের বোধহয় বাড়তি উত্সাহ দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, ছেলে না একদিন ঘরছাড়া হয়ে যায়! ফলে দাও বিয়ে।
সিনেমার চেয়ে নাটকটাকে একটু বোধহয় বেশিই ভালবাসতেন সন্তোষদা। এক সময় সবিতাব্রত দত্ত, নির্মলকুমারদের নিয়ে নাট্যসংস্থাও করেন। ‘আনন্দম’। পরে যা পরিচয় পায় ‘রূপকার’ নামে। ‘রূপকার’-এরই একটা নাটক দেখে সত্যজিত্ রায় তাঁকে ‘পরশপাথর’-এর জন্য ডাক পাঠান।
’৫৭ সাল। মহারাষ্ট্র নিবাস হলে ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’। তাতে ভবদুলালের চরিত্রে সন্তোষদা। দেখতে এসেছিলেন সত্যজিত্ রায়। এর পরই সেই বিখ্যাত তলব।
তলবের পিছনে গল্পটা ভারী মিষ্টি। বাড়িতে এক বন্ধুর ফোন এল সন্তোষদার। সে বলল, “সত্যজিত্ রায় তোকে দেখা করতে বলছেন। শুনছি, কোনও একটা ছবির জন্য উনি তোকে নেবেন।” সেই প্রথম বার ছবি করার প্রস্তাব পেলেন, তা’ও কিনা সত্যজিত্ রায়ের কাছে! আনন্দে, উত্তেজনায় ফুটতে ফুটতে যখন ফোন রাখলেন, শুনলেন বাবার কড়া গলা, “কার ফোন?” থতমত খেয়ে সন্তোষদা বললেন, “সবিতার।” উত্তরে এক ধমক, “মানে? তুমি এখন মেয়ে-বন্ধুও পাতিয়েছ নাকি? এই সব হচ্ছে!”
সন্তোষদা প্রায় হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “না, না, সবিতা মেয়ে নয়। সবিতাব্রত দত্ত। ছেলে। আমার বন্ধু।” তাতেও ধমক থামে না। “অমন নামে ডাকার কী আছে! পুরো নাম বলতে পারো না?”
এর পরে বাবা যখন জানতে পারেন, ছেলে সিনেমায় নামতে চলেছে, প্রচণ্ড খেপে গিয়েছিলেন। নাটক তা’ও একরকম। সিনেমা! কিছুতেই না। বেঁকে বসেছিলেন। শেষে অনেক কষ্টে রাজি করানো হয়।
প্রথমবার পর্দায় নামার গল্পের মতোই চিত্তাকর্ষক তাঁর চাকরি পাওয়ার কাহিনিও।
ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক। পরে যার নাম হয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া। সেখানে ইন্টারভিউ দিতে যান হাফ প্যান্ট পরে। চাকরিও পান। লিস্টে তাঁর নামই প্রথমে। এর পর গিয়ে শোনেন, উনি যদি চাকরিটা না নেন, সদ্য পিতৃহারা একটি ছেলের চাকরি হবে। সঙ্গে সঙ্গে বলেন, “না, না, আমার চাকরির দরকার নেই।” চলে আসেন বাড়িতে। এ বার তুমুল বকাবকি। অশান্তি। অবশ্য পরের মাসেই আবার ওই ব্যাঙ্ক থেকেই ডাক আসে। তখন আর কোনও সমস্যা হয়নি। অসহায় মানুষের প্রতি এরকম মায়াময় মন ওঁর কিন্তু শেষ দিন অবধি দেখেছি। বিপাকে পড়ে কেউ কিছু চাইলে, কখনও ‘না’ বলতে শুনিনি।
টানা চোদ্দো বছর ব্যাঙ্কে চাকরি করার পর হঠাত্ শুনলেন ওড়িশার অঙ্গুলে ট্রান্সফার হয়ে যেতে হবে। ব্যস্, সঙ্গে সঙ্গে চাকরি ছেড়ে দিলেন। তখনও বাড়ির সকলে এক দিকে, তো সন্তোষদা অন্য দিকে। কিন্তু বৌদি যথারীতি তাঁর পাশে। চাকরি করার মাঝেই আইনি পড়াশোনা করতেন। ফলে ব্যাঙ্কের চাকরির ইতি ঘটিয়ে আইনি পেশায় চলে গেলেন। এই সময়টা কিন্তু বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল ওঁর কাছে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হত তো!
পরিশ্রম যে কতটা করতে পারতেন, আমি দেখেছি। ফিরেছেন হয়তো শ্যুটিং করে রাত সাড়ে ন’টায়। পরের দিনে মামলা আছে। চেম্বারে মামলার কাগজপত্র তৈরি করছি। বসে পড়লেন সেখানে। বৌদিকে বললেন, “পতু, আমাকে এইখানেই খেতে দিয়ো।” হঠাত্ ঘড়িতে রাত এগারোটা দেখে ছিটকে উঠে আমায় বললেন, “যাও, যাও তুমি যাও এ বারে। অনেক রাত হয়ে গেল।” পরদিন শুনলাম রাত্তির আড়াইটে-তিনটে অবধি কাজ করেছেন। পরদিন সাতসকালে আবার কোর্ট। এবং রোজের মতো পাক্কা সাড়ে দশটাতেই।
একবার দুর্গাপুরে নাট্টোত্সব হচ্ছে। সন্তোষদা গেলেন নাটক করতে। নাটক করে দুর্গাপুর থেকে ট্রেন ধরে কলকাতায় আসতেন। কোর্টে মামলা করতেন। আবার বিকেলে ফিরে গিয়ে দুর্গাপুরে অভিনয়। এমন ঘটত বারবার।
যেমন পরিশ্রম করতে দেখেছি, তেমন সাহসও। পর্দায় ভিরু-ভিরু একজন মানুষ ব্যক্তিজীবনে কী যে সাহস ধরতেন, না শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না। একবারের কথা বলি।
আদালতে বহু গুরুত্বপূর্ণ মামলা লড়েছেন সন্তোষদা। হেমন্ত বসু হত্যাকাণ্ড, দেবযানী বণিক ...।
তো, সে বার নেপাল রায় হত্যা মামলা চলছে। কংগ্রেসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা। জোড়াবাগান থেকে নির্বাচনে দাঁড়াতেন। নকশালদের হাতে খুন হন। অভিযুক্তদের হয়ে যাঁরা লড়ছিলেন তাঁদের একজন সন্তোষদা। হঠাত্ একদিন ফোনে মামলা থেকে সরে দাঁড়ানোর কড়া হুমকি।
সন্তোষদা উত্তর দিলেন, “শুনুন ভাই, টাকা যখন নিয়েছি, মামলা তো করবই। আর আমি দিন কয়েকের মধ্যে জোড়াবাগানে যাব, তখন না হয় দেখা করবেন, যা করার করে নেবেন।” মামলাটায় জিতে ফিরে ছিলাম আমরা।
সন্তোষদাকে দেখে প্রায়ই একটা কথা মনে হত, ওঁর দুটো সত্তা। একটা মঞ্চের বা পর্দার। যেখানে ওঁকে মনে হত, আলুথালু একজন মানুষ। সেই মানুষই আবার যখন বাস্তব জীবনে ঢুকতেন, ছবিটা পুরো বদলে যেত! বাড়ি বলতে অজ্ঞান। পরিবারের একমাত্র ছেলে ছিলেন। চার বোন ছিল ওঁর। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বালবিধবা। সবাই দেশের বাড়ি থাকতেন। তাঁদের যে কত রকমের দায়িত্ব বয়ে বেড়িয়েছেন সারাজীবন!
আর ওঁর মধ্যে মাতৃভক্তি যা দেখেছি, খুব কম জনের মধ্যেই অতটা পেয়েছি। মনে আছে, ‘কোয়েলের কাছে’ ছবির শ্যুটিং হচ্ছে। তখনকার মাদ্রাজে। খবর গেল সন্তোষদার মা আর নেই। তখনই ফিরে এলেন কলকাতায়। সে বারের মতো সন্তোষদাকে অত ভেঙে পড়তে খুব কম দেখেছি।
এত রকমের গুণ ছিল মানুষটার! অগাধ পাণ্ডিত্য। পড়তে পড়তেই দুর্দান্ত ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন হলিউডের বিখ্যাত কমেডিয়ান গ্রাউচো মাক্সের। আর হাতের লেখা? মুক্তাক্ষর বললেও কম বলা হয়। যেমন বাংলা, তেমন ইংরেজি। বিভিন্ন কায়দার হরফেও লিখতে পারতেন। ক্যালিগ্রাফিও।
এত গুণ, কিন্তু কখনও জমি থেকে পা-টা তুলতে দেখিনি। চেনা মহল ছাড়া নিজের কথা তেমন বলতেনও না কাউকে। একটা সময়ের পর ওঁর খুব কাছের জন হয়ে গিয়েছিলাম বলে জানি, আজীবন অদ্ভুত একটা অভিমান, কষ্ট, যন্ত্রণা বয়ে বেড়িয়েছেন সন্তোষদা। কমেডিয়ান হিসেবে যতটা স্বীকৃতি, সম্মান, অর্থ পাওয়ার কথা কোনও দিন পাননি তো, তাতে মনে মনে খুব খেদ ছিল।
এই খেদটা বুকে চেপেই এক দিন শেষের সে-দিনের দিকে হাঁটা দিলেন সন্তোষদা। হঠাত্ খুব কাশিতে ধরল। ডা. বারীন রায় দেখলেন। বুকের এক্স-রে হল। একটা ছোট্ট সাদা স্পট পেয়ে ডা. রায়ের সন্দেহ। এর পরই ধরা পড়ল রাজরোগ। লাং ক্যান্সার। টানা ছ’মাস চিকিত্সা চলল। রে দিতে নিয়ে যেতাম ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতাল।
তার মধ্যেও কাজ কিন্তু থামাননি। অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ একটা হত্যা মামলা লড়ছিলেন। ভাঙা শরীর নিয়েও। ট্রায়াল করার সময় গলা উঠত না। জজসাহেব বলতেন, “আপনি ডায়াসের ওপর চলে আসুন। এখানেই চেয়ারে বসে সওয়াল করুন।” ওঁর কষ্ট দেখে বিরোধী পক্ষের উকিল পর্যন্ত একদিন বললেন, “সন্তোষদা, আপনি শুধু বলুন কী চাই। আমি বম্বেতে নিয়ে গিয়ে আপনার চিকিত্সার ব্যবস্থা করব।” অশক্ত শরীর নিয়ে শুধু বললেন, “না গো, ও সব করতে যেয়ো না, লোকে অন্য কিছু ভাববে।”
যেদিন চিরকালের জন্য চলে গেলেন, তার দিন কয়েক আগে সেই মামলার রায় বেরোল। অভিযুক্তরা খালাস পেলেন। মামলার তদন্তকারী অফিসার ছিলেন সমীর গঙ্গোপাধ্যায়। বাড়ি বয়ে আনলেন সুসংবাদ। সন্তোষদা তখন শয্যাশায়ী। ওঁর মাথায় হাত রেখে বললেন, “এই খবরটা দিয়ে তুমি আমায় বাঁচালে হে। ওরা ছাড়া না পেলে লোকে ভাবত, এখন তো আমার অসুখ, টাকা পয়সার দরকার। তাই বোধহয় কোনও আন্ডারস্ট্যান্ডিং করে নিয়েছি। যাক্, এখন আর লোকে বলতে পারবে না, আমি অসত্ হয়ে গেছি।”
৫ ফেব্রুয়ারি। ১৯৮৮। শেষ রাতে ফোনটা বেজে উঠল। খবর পেলাম পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকেই ‘ছিটকে’ গিয়েছেন সন্তোষ দত্ত। কোনও জজসাহেব, কোনও পিটিশানই আর তাঁকে ফেরাতে পারবে না।
আমার সরিয়াতুল্লা লেনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুরধনী কুটীর-এর দিকে চললাম। শেষ বারের মতো ওঁকে প্রণাম করব বলে।
কলকাতায় তখনও ভোর নামেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy