গড়পুর গ্রামে খেলায় ব্যস্ত শিশু। —নিজস্ব চিত্র।
গ্রাম গড়পুর, থানা ডুবুরি, জেলা জাজপুর।
জঙ্গল ঘেরা অখ্যাত এই গ্রামেই সকাল থেকে রাত লেখা হচ্ছে আদিবাসী দশটি পরিবারের নাছোড় লড়াইয়ের চিত্রনাট্য।
সরকারের খাতায় অবশ্য এ গ্রামের কোনও অস্তিত্ব নেই। তথ্য জানার অধিকার আইনে পেশ করা প্রশ্নের উত্তরে প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছে, এখানে কোনও জনবসতিই ছিল না। সরকারি কর্তাদের মতে, এটা আসলে বনভূমি। শিল্প স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণের কথা ঘোষণা হওয়ার পরে কেউ কেউ এসে ঘরবসতি ফেঁদেছেন।
“একটা সময় এক হাজার পরিবার বাস করত এই গ্রামে। সবাইকে ভয় দেখিয়ে, কাঁচা পয়সার লোভ দেখিয়ে উৎখাত করে দিয়েছে,” বললেন সুরেন্দ্র হাইব্রু। “এখন দশটা ঘরের ৫৫-৬০ জন আছি, ছোট-বড় মিলিয়ে। আমাদেরও রোজ হুমকি দিচ্ছে।” জমি তাঁদের, এমন কোনও কাগজপত্র যে হাতে নেই, সে কথা অবশ্য মানছেন সুরেন্দ্র। বলছেন, “বাপ-ঠাকুরদার কাল থেকে এখানেই আছি। কেউ পাট্টা দেয়নি। আমরা লেখাপড়া জানি না। কী করে সে সব জোগাড় করব!”
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
ভোটের খাতায় অবশ্য নাম আছে সুরেন্দ্রদের। প্রতি বছর ভোটও দেন। বিনিময়ে সরকারি সুবিধা বলতে এক টাকা কেজি চাল। টিউবওয়েল পুঁতেছেন নিজেদের খরচায়। রাজনীতিকেরা কেউ এ চত্বর মাড়ান না। বস্তুত, গড়পুরের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতেই রাজি নন তাঁরা। ও প্রসঙ্গ তুলতেই মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বিজেডি নেতা প্রসন্ন পতসানি বলে উঠলেন, ওখানে তো আর কোনও সমস্যা নেই। ছোটখাটো দু’একটা পকেটে থাকতে পারে হয়তো, কিন্তু মোটের উপর কলিঙ্গনগর, তার জমির লড়াইয়ের কথা মানুষ ভুলেই গিয়েছে।
উৎসাহ দেখলাম না বিজেপি-কংগ্রেসের অন্দরেও। অর্থাৎ, ভোটের বাজারে আর কানাকড়ি দাম নেই কলিঙ্গনগরের। তার জমির দাম অবশ্য চড়া। এই জমির উপরেই নির্ভর করছে টাটাদের ইস্পাত কারখানার দ্বিতীয় পর্যায়ের সম্প্রসারণ, জিন্দলদের কারখানা। সুরেন্দ্রর দাবি, তাঁদের জমি কারখানা তৈরির জন্য দেয়নি সরকার। কোম্পানি জোর করে জঙ্গল দখল করে নিচ্ছে। প্রশাসনের পাল্টা বক্তব্য, নিয়ম মেনেই জমি দেওয়া হয়েছে। শিল্পের জমি দরকার, আর সুরেন্দ্রদের দাবি অরণ্যের অধিকার। এই অসম টানাপড়েনের রণভূমির একটা নাম গড়পুর।
বছর দশেকের বুধনি অনেক ক্ষণ ঘুরছিল মায়ের আঁচল ধরে। অবশেষে যখন বুঝল, বাইরে থেকে এ বার যারা এসেছে, তারা ভয় দেখাতে আসেনি, তখন হাত ধরে ঘুরিয়ে আনল সারা গাঁ। এইখানে আমাদের গোয়াল ছিল, ওইখানে লম্বোদরের বাড়ি, ওই গাছের তলায় আমরা গুলি খেলতাম...।
গোলমালের জেরে চাষবাস শিকেয় উঠেছে। মাঠের মাঝখানে পাওয়ার টিলারটা পড়ে রয়েছে দ হয়ে। গ্রামের দশটা পরিবারের মূল ভরসা এখন হান্ডিয়া লসি। ভাত রেঁধে তার পর তিন দিন হাঁড়িতে রেখে দেওয়ার পর গেঁজে উঠলে যে পানীয়টা তৈরি হয় তার নাম হান্ডিয়া। বাংলায় যাকে হাঁড়িয়া বলে। ওড়িশার কাঠফাটা রোদ্দুরে এই হান্ডিয়াই নাকি শ্রমিকদের জীবনীশক্তি! পেটে পড়লে শরীর ঠান্ডা হয়। ভরদুপুরেও কাজ করা যায় অনায়াসে। আর কী আশ্চর্য, গড়পুরের হান্ডিয়ার খদ্দের কলিঙ্গনগর স্টিল প্লান্টের কর্মীরাই। গ্রাম থেকে ঢিল ছোড়া দূরে শ্রমিকদের কলোনি। হান্ডিয়ার সঙ্গে ছোলাসেদ্ধ, বাদাম, বড়জোর ডিমের ভুজিয়া। বিক্রিবাটা ভাল হলে দিনে দেড়-দু’শো টাকা হয়ে যায় নামসি গাগারাইয়ের। স্বামী মাঝেমধ্যে কোথাও মজুরের কাজ পেলে আরও ক’টা টাকা বাড়তি রোজগার। ঘরে তিন মেয়ে। ছোটটার বয়স এক বছর। বড়টার চার।
নামসির দোকানের উল্টো দিকের চালাঘরে খদ্দের সামলাচ্ছিল শম্ভারী হাইব্রু। বছর বারো বয়স। মা নেই। বছর দশেকের একটা ভাই আছে। দু’জনের কেউই কোনও দিন স্কুলের মুখ দেখেনি। “স্কুল একটা ছিল গ্রামে। ২০০৮-এ যখন জমি দখল শুরু হল, তখন এসে ভেঙে দিল। অঙ্গনবাড়ি কেন্দ্রটাও ভেঙে দিয়েছে। ঘরে ঘরে ঢুকে রাঁধা ভাত ছুড়ে ফেলে একাকার করে দিয়েছে কত বার।” অভিযোগ গ্রামবাসীদের। স্কুল এখন ১৫ কিলোমিটার দূরে। হাতুড়ে ডাক্তার পেতে হলেও সেই ৮ কিলোমিটার দূরের দানগদি। তা-ও নিয়ে যেতে হবে সাইকেল বা মোটরবাইক করে। তাতে বাঁচে বাঁচল, মরে মরল।
মরার জন্য এ ভাবে মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা কেন? পুনর্বাসনের জন্য কলোনি তো তৈরি হয়েছে। সেখানে পাকা রাস্তা, কলের জল, ডাক্তারবাবু আসেন নিয়ম করে। “কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি তো আছেই, পাশাপাশি আমাদের সরকার আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য অনেক কাজ করেছে,” বলছেন পতসানি। সুরেন্দ্রর অবশ্য দাবি, বেশির ভাগ আদিবাসীকেই নতুন জায়গায় নিজেদের চেষ্টায় ঘর তৈরি করতে হয়েছে। তাঁদের চাকরির আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পাকা চাকরি পেয়েছেন হাতে গোনা ক’জন। বাকিরা ঠিকাদারের কাছে দিনমজুর। তাঁর কথায়, “আমাদের গ্রামের যারা অন্যত্র চলে গিয়েছে, তারা এখন পস্তাচ্ছে। যে জমিতে নিয়ে গিয়ে তাদের বসানো হয়েছে, সেই জমিও জঙ্গলের। পাট্টা পায়নি কেউ।”
আবার হয়তো কোনও দিন আর এক শিল্পের দাবি এসে সেখান থেকেও বাস্তুছাড়া করবে তাঁদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy