তিরুচিরাপল্লির কাছে একটি প্রচারসভায় কোভানের সঙ্গীরা। নিজস্ব চিত্র।
মঞ্চ থেকে নেমে এসেই বেশ কুণ্ঠিত গলায় ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ক্ষমা চেয়ে নিলেন দেরি হওয়ার জন্য। পরনে সস্তার নীল জিনসের প্যান্ট আর কালো টি-শার্ট। খালি পা। মাথায় একটা লাল ফেট্টি বাঁধা। এতক্ষণ মঞ্চের উপর নেচে নেচে গান গাইছিলেন। বাইরে প্রায় ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা। দরদর করে ঘামছেন। এক জন একটা চেয়ার এগিয়ে দিতেই ধপ করে বসে পড়লেন।
ইনিই কোভান! বিশ্বাস হচ্ছিল না। এই নিরীহ মানুষটাই নাকি রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন তামিলনাড়ুর দোর্দন্ডপ্রতাপ মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার! বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেললাম। পাশেই বসে ছিলেন মানালি ডস। তিরুচিরাপল্লি শহরের অটো ইউনিয়নের সম্পাদক। কোভানের সঙ্গী, অন্যদিকে আমার দোভাষী। চলনসই ইংরেজিতে মানালির বক্তব্য তর্জমা করলে দাঁড়ায়,‘‘ আপনি তো গানের কথা বুঝতে পারছেন না। বুঝলে দেখতেন কোভানের গান মানে আগুন। ২০১৫ সালেও আম্মা (জয়ললিতা)-কে বিদ্রুপের আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন কোভান।” ২০১৫ সালের ৩০ অক্টোবর তিরুচিরাপল্লির ওরিউরে কোভানের বাড়ি থেকে গভীর রাতে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ।মানালির অভিযোগ, প্রথম কয়েকদিন কোনও হদিশই পাওয়া যায়নি কোভানের। শেষে তাঁর বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করে পুলিশ। ৩৭ দিন পরে মাদ্রাজ হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্ত হন তিনি।
হাইকোর্ট, পুলিশ, জয়ললিতা—শব্দগুলো শুনে আঁচ করতে পারছিলেন যে তাঁর গ্রেফতারি নিয়ে কথা হচ্ছে। হাসি হাসি মুখে ফের ভাঙা ইরেজিতে বলে উঠলেন,‘‘ অনলি সং, অ্যান্টি লিকর সং। নো সিডিসন।’’ তারপরেই তামিলে মানালিকে যা বললেন তার মানে দাঁড়ায়,‘‘ আমি জয়ললিতার মদ নিয়ে সরকারি নীতির বিরোধিতা করেছিলাম। আমি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু করিনি।”
২০০৩ সালে জয়ললিতার এডিএমকে সরকার গোটা রাজ্যে মদ বিক্রির সমস্ত সত্ব একটি সমবায় তৈরি করে সরকারের নিজের হাতে তুলে নেয়। যার গড় আয় প্রায় বছরে তিরিশ হাজার কোটি টাকা। ২০১৫ সালে যখন অর্ধেক রাজ্য বন্যার জলে ভাসছে তখনও খোলা ছিল সব মদের দোকান। কোভানের দাবি সরকার এ ভাবে গোটা রাজ্যের মানুষাকে মদ খাওয়াতে পারে না। তাঁর অভিযোগ, রাজ্যের সব ক’টা বড় বড় ডিস্টিলারি (মদের কারখানা) কোনও না কোনও বড় নেতাদের ঘনিষ্ঠদের মালিকানাধীন। তিনি মিডাস ডিস্টিলারির কথা বলেন। অভিযোগ, ওই মদের কারখানা বেনামে জয়ললিতার ঘনিষ্ঠ শশিকলার মালিকানাধীন। তাঁর অভিযোগটা খুব স্পষ্ট, মদ বিক্রির নামে রাজ্যের সমস্ত প্রথম সারির নেতারাই নিজেদের ফায়দা তুলছেন। সেই ব্যবস্থারই বিরোধিতা করে গান বেঁধেছিলেন তিনি। সেই গান সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে যাওয়া মাত্র টনক নড়ে সরকারের।
গ্রামে গ্রামে লোকসভা ভোটের আগে গান গেয়ে প্রচার কোভানের। নিজস্ব চিত্র।
তবে জেল-গ্রেফতারি বদলাতে পারেনি কোভানকে। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই ফের শুরু করে দিয়েছেন নিজের কাজ। লোকসভা ভোটের আগে প্রচারে ব্যস্ত কোভান। রীতিমত দলবল নিয়ে চলছে প্রচার। তিরুচিরাপল্লি শহর থেক প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামের কমিউনিটি হলে পাওয়া গেল কোভানকে। গানের সুরে, বক্তৃতায় বার্তা খুব স্পষ্ট। বামপন্থী গণনাট্য এবং লেখক শিল্পী সংগঠন মাক্কাল কলাই ইলাক্কিয়া কাজকর্মের সদস্য হলেও তাঁর গ্রেফতারির পরে তৈরি হয়েছিল মাক্কাল অধিকারম, অনেকটাই আমাদের এখানকার নাগরিক অধিকার মঞ্চের ধাঁচে। সেই সংগঠনের হয়েই কোভানের প্রচার—সমস্ত রাজনৈতিক দলই সাধারণ মানুষকে ঠকাচ্ছে। তারা কর্পোরেটদের হয়ে কাজ করছে। ভোট দেবার আগে ভাবুন। ভোট ঘোষণার কয়েক মাস আগেই ২৩ ফেব্রুয়ারি তিরুচিরাপল্লিতেই কর্পোরেট রাজের বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার আবেদন জানিয়ে নাগরিক কনভেনশনের আয়োজন করেছিল কোভানের সংগঠন। সেখানে প্রায় তিরিশ হাজার মানুষের জমায়েতে অন্যতম প্রধান বক্তা ছিলেন অরুন্ধতী রায়।
স্টারলিট আন্দোলনের সময়। ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: এইখানে আমাদের গোয়াল ছিল, দেখায় বুধনি
তুতিকোরিনে বেদান্ত গোষ্ঠীর স্টারলাইট কারখানার দূষণের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন গড়ে তোলা থেকে কোকা কোলার কারখানার বিরুদ্ধে আন্দোলন, সবেতেই মূল চালিকা শক্তির ভূমিকা পালন করেছে এই মাক্কাল অধিকারম। সংগঠনের তিরুচিরাপল্লি জেলার সম্পাদক জি রাজা বলেন, ‘‘ সমস্ত রাজনৈতিক দল কর্পোরেটদের হাতের পুতুল হয়ে মানুষ ঠকাচ্ছে।” সমস্ত রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করলেও, পথসভা, প্রচারে মূল নিশানা মোদী বিজেপি এবং জোটসঙ্গী এডিএমকে। তাঁদের প্রচারের বিষয় বিজেপির শাসন কালে কৃষক-মজদুরদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
তিরুচিরাপল্লির থিলাইনগরে মাক্কাল অধিকারমের কার্যালয়। নিজস্ব চিত্র।
বিজেপি বিরোধিতার প্রসঙ্গ থেকেই উঠে এল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। কোভানের সঙ্গীরা প্রশ্ন করলেন, ‘‘ বাংলার মানুষ কি চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে?” কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই কোভান জি রাজাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বললেন। কয়েকবার ‘মমতা’ কথাটা কানে এল। রাজার দিকে তাকাতেই তিনি বলেন,‘‘ কোভান বলছেন, জয়ললিতার বদলে মমতা মুখ্যমন্ত্রী থাকলে আমাকে গ্রেফতার হতে হত। আপনাদের বাংলাতেও তো সরকারের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু লিখলে তাঁকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে। প্রতিবাদ করলে মাওবাদী বলে পুলিশ।”
আরও পড়ুন: ‘জোশ’ দেখাচ্ছেন তেজস্বী, আতঙ্কে গৌরীর পরিবার
আরও কিছু উত্তেজিত স্বরে বলছিলেন কোভান। তর্জমা করলে দাঁড়ায়, কোভানের অভিযোগ, বাংলাতেও চিট ফান্ডের শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন সাধারণ মানুষ। সরকার কিছু করেনি। বাংলার কোনও সংগঠন ডাকলে তিনি যেতে রাজি। গান লিখে, গান গেয়ে প্রতিবাদ করতে চান এই প্রতারণার। মানুষকে সচেতন করতে চান।
অবাক হয়ে দেখছিলাম ৫৮ বছরের প্রৌঢ়ের অফুরন্ত প্রাণশক্তি। তাঞ্জাভুরের অখ্যাত কৃষক পরিবারে জন্মানো এস শিবদাস ওরফে কোভান ভারত হেভি ইলেক্ট্রিক্যাল লিমিটেডের কর্মী ছিলেন। লেখক শিল্পী সংগঠনের জন্য পুরো সময় দিতে সেই চাকরি ছেড়ে দেন প্রায় ২২ বছর আগে। জি রাজা শোনাচ্ছিলেন কোভানের প্রথম জীবনের কথা। তিনি বলেন,‘‘ নিজের সমস্ত সঞ্চয় তুলে দেন সংগঠনের জন্য।” কোভান বলেন, ‘‘ সংগঠনের সহকর্মীদের সাহায্যেই সরকারি স্কুল কলেজে পড়ে ছেলে এখন আইনজীবী, মেয়ে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক।”
বাইরে ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। এখান থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে অন্য একটি গ্রামে পরের প্রচার সভা। সঙ্গীদের নিয়ে বিদায় নিলেন শিবদাস কোভান। তামিলে কোভান শব্দের অর্থ রাজা বা সংগঠক।
তিরুচিরাপল্লি শহরের দিকে ফিরতে ফিরতে একটা মোড়ে গানটা কানে এল। ভাষা না বুঝতে পারলেও সুরটা চিনতে পারলাম। কোভানের গান। গাড়ির চালকও বললেন গানটা কোভানেরই। কিন্তু গানের উৎস একটা নির্বাচনী কার্যালয়। পতাকা দেখে চিনলাম ডিএমকে-র নির্বাচনী কার্যালয়। চালকের কাছেই জানলাম অনেক দলই প্রচারে কোভানের গান ব্যবহার করে। বুঝতে পারলাম ‘আম্মা’-র রাতের ঘুম কেন উড়ে গিয়েছিল কোভানের জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy