স্যান্ডউইচের দেশি স্বাদ। ছবি: সংগৃহীত।
“আরে মশাই, এ দোকানে কি আজ এলাম! এ দোকান যে দিন থেকে তৈরি হয়েছে, সে দিন থেকেই দুপুরবেলার খাওয়াটা আমি এখানেই সারি প্রতিদিন,’’ বলছিলেন অভিষেক।
অভিষেক কী? মানে আপনার পদবিটা? কুণ্ঠাভরা গলায় সবিনয়ে প্রশ্নটা রাখা গেল।
“এই বিনু, এই আমার পদবিটা কী যেন?” কালো টি-শার্ট আর জিন্স পরা ভদ্রলোকের অকুণ্ঠ প্রশ্ন দোকানওয়ালা বিনয়কে। “ওই তো! আরে মনে পড়ছে না। হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে পড়েছে। বসু ! আমার নাম অভিষেক বসু। এই আইএফএর গলির ভিতর একটা কুরিয়র কোম্পানি আছে। ওখানে কাজ করি,’’ বক্তব্য তাঁর। “এই দোকানে খাওয়াদাওয়া করছি সেই ’৮৮ সাল থেকে। ওঁর বাবার দোকান ছিল তখন। তার পর এক দিন ছেলে দেশ থেকে বাপের সঙ্গে এল। এক দিন বুড়ো হয়ে বাপ ফিরে গেলেন দেশে। তার পর থেকে এই ছেলেই দোকান সামলাচ্ছে। ভালই সমলাচ্ছে বলব। বাপের থেকে হাতটা ভাল। স্যান্ডউইচটা বাপের থেকে অনেক ভাল বানায়।”
চাঁদনি চক মেট্রোর দক্ষিণ প্রবেশদ্বার থেকে বেরিয়ে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের মুখেই বিনয়ের স্যান্ডউইচের দোকান, সর্বমঙ্গলা। পাশেই তার ‘দাদ্দু’র সিগারেট-লজেন্সের দোকান। সেটা আরও পুরনো। বছর ষাটেকের তো বটেই। জায়গাটা ওঁদেরই। পাড়াতুতো দাদ্দু-নাতি একসঙ্গেই দোকানের মধ্যে শাটার নামিয়ে রাত কাটান। শুধোই, জানলা নেই তো, রাতে ঘুমোতে কষ্ট হয় না, এই গরমে? বিনয়ের হাসিমুখ উত্তর, “এক্সস্ট ফ্যান আছে স্যার, ওটাই চালিয়ে রাখি। সঙ্গে এমনি ফ্যানটা চলে। সারাদিনের খাটাখাটনির পর ঘুম এসে যায়।’’
বিনয়ের পুরো নাম বিনয় সিংহ। বংশানুক্রমে উত্তরপ্রদেশের বাল্লিয়া শহরের বাসিন্দা। ভাগ্যের খোঁজে বড় শহরে এসেছিলেন বাবা কৃষ্ণ কনহাইয়া সিংহ। দিল্লি নয়, মুম্বই নয়, এই পোড়া কলকাতায়। কেন? ওই যে চেনাজানা। পাড়াতুতো দাদার দোকান আছে কলকাতার বড়সড় এক অফিসের পাশেই। ঘরও আছে। তাই চেনাজানাও আছে এলাকায়। ওইটুকুই যথেষ্ট! সামান্য কিছু পুঁজি জমিয়েছিলেন কৃষ্ণ কনহাইয়া, আগের ফ্যাক্টরির কুলির চাকরি থেকে। বাড়ি ছেড়ে, বড় শহরে আসা তো একটু কষ্ট করে বেশি রোজগারের জন্যই। শেষ বয়সে একটু সুখে থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে। তাই দুটো ডাল-ভাত খেয়ে, পাড়ার দাদার সঙ্গে এক বিছানায় শুয়ে, সামান্য পুঁজির লগ্নি করে কলকাতায় স্যান্ডউইচের দোকান দেন তিনি। তিনি কি কোনও দিনও ভাবতে পেরেছিলেন শহরের সেরা স্যান্ডউইচগুলি এক দিন বানাতে সক্ষম হবেন তাঁরই পুত্র বিনয়?
কেন বলছি সর্বমঙ্গলাতেই শহরের সেরা স্যান্ডউইচ তৈরি হয়? কারণ, একটি গণতান্ত্রিক দেশে সব নাগরিকেরই অধিকার আছে আপন অভিমত দেওয়ার। কারও হয়তো ফ্লুরিজের স্যান্ডউইচের স্বাদটাই সেরা লাগে, কারও বা ভাল লাগে তাজের ব্রেকফাস্ট টেবিলের তুলতুলে সাদা তেকোনা পাঁউরুটির মধ্যের আস্তরণে কামড় বসাতে। আরও কেউ থাকতেই পারেন, যাঁর ভাল লাগে গড়িয়াহাট বা গোলপার্ক বা সেক্টর ফাইভের, সল্টলেকের কোনও ঝাঁ-চকচকে ক্যাফে বা রেস্তরাঁর কনকনে অন্দরে বসে কফি সহযোগে বড় গ্রাসে ক্লাব স্যান্ডউইচ আস্বাদন করতে। এর সব ক’টাই আস্বাদন করা আছে এই প্রতিবেদকের, এবং এগুলি ছাড়াও দেশের এবং বিদেশের আরও নানা স্বাদের এবং পুরের স্যান্ডউইচ ও হটডগ। তুলতুলে এবং মাঝেমধ্যে একটু ‘চিউয়ি’ টুনা স্যান্ডউইচ, দুরন্ত স্বাদের সেঁকা শুয়োরের মাংসের উপর নানা রকম সব্জি টুকরো ছড়ানো, নুন-গোলমরিচ ছড়ানো ‘ডবল ডেকার’ স্যান্ডউইচ, গুচ্ছের মেয়োনিজ আর ঝাঁঝহীন আলুনি স্বাদের ‘মাস্টার্ড সস’ ছড়ানো প্রচণ্ড কচকচে গরুর মাংসের হটডগ, এমনকি ঝলসানো হরিণের মাংস, নুন সহযোগে দু’পিস পাঁউরুটির মধ্যে পুরে সকালের কফির সঙ্গেও খাওয়া আছে। কিন্তু তা-ও, কিছু যুক্তি আছে সর্বমঙ্গলার স্যান্ডউইচকে ‘সেরা’র অভিধা দেওয়ার পিছনে।
সর্বমঙ্গলায় যে স্যান্ডউইচ পাওয়া যায়, তা বিনয় তৈরি করেন ক্রেতার চোখের সামনে। অর্থাৎ, তাতে কী কী যাচ্ছে, তা ক্রেতা বিলক্ষণ দেখতে পাবেন। এবং প্রয়োজনে বলতেও পারবেন, কী কী খাদ্যবস্তু তাঁর অপছন্দের বা রোচে না। অবশ্যই আগে থেকে। বিনয় তাঁর স্যান্ডউইচে মেয়োনিজ নামক যে অস্বাস্থ্যকর বস্তুটি আজকাল স্বাদের দোহাই দিয়ে কথায় কথায় সব জায়গায় স্যান্ডউইচের মধ্যে ব্যবহার করা হয়, তার ছিটেফোঁটাও ব্যবহার করেন না। একেবারে টাটকা কেনা গোটা পেঁয়াজ-গাজর-শসা-ক্যাপসিকাম চোখের সামনে কেটে দেন তাঁর হাতের স্যান্ডউইচে; সঙ্গে দেশের সর্বপ্রিয় আমূলের মাখন মাখিয়ে দেন বেশ মোটা পরতে স্যান্ডউইচের দু’পিঠে। এই হল বিনয়ের কাঁচা ভেজিটবিল স্যান্ডউইচ। ক্রেতার পছন্দ মতো তিনি স্যান্ডউইচ সেঁকেও দেন, এবং সেই সেঁকা স্যান্ডউইচেই আসে আসল স্বাদের খেলটা। কারণ তিনি পাতি টোস্টারের ব্যবহার করেন না। তাঁর স্যান্ডউইচগুলি সব ক’টাই সেঁকা হয় বৈদ্যুতিক অভেনে। অর্থাৎ, পুরো স্যান্ডউইচটি হাতে তৈরি করে তার পর বিনয় সেটিকে অভেনে ঢোকান। তার পর যন্ত্রের ঢিমে আঁচে সম্পূর্ণ স্যান্ডউইচটি পাক হতে থাকে মিনিট তিন-চারেকের জন্য। তাতে যেটা হয়, তা হল মাখন গলে সব্জিগুলিতে মাখামাখি হয়ে যায়। সব্জিগুলিও নরম হয়ে যায়। নুন, মরিচ আগে থেকে দিয়ে রাখার কারণে সেগুলিও বেশ ভাল করে মিশে গিয়ে পুরো স্যান্ডউইচটিকে গরম, নরম এবং তুলতুলে করে তোলে। সঙ্গী হয় মাখনের আমোদ মাখানো নরম গন্ধ। মুখে দিলে মাখন-জিভের রসে মাখামাখি হয়ে একটা স্বর্গীয় অনুভূতিতে ভরে যায় স্বাদগ্রন্থিগুলি। একেবারে যাকে ইংরেজিতে বলে ‘ডেকাডেন্ট টেস্ট’। অনুভূতিটা অনেকটা সে রকম। এ দিকে সহজ, সরল, পুষ্টিগুণে ভরপুর পেটভরা খাবার, যাতে বিরিয়ানির রেওয়াজি কসরত বা সুশির উচ্চবংশীয় অথচ নমনীয় স্বাদোত্তরণের প্রচেষ্টা, কোনওটাই নেই। এ জিনিস একেবারেই মাটির গন্ধমাখা বিনয়-পূর্ণ ভারতীয় খাবার। এতে চিকিৎসকের মতানুযায়ী ফাইবার, কার্ব, ফ্যাট এ সবই কেবল পাথেয়।
এটা ঠিকই যে বিনয় স্যান্ডউইচ বানানোর সময়ে, বড় রেস্তরাঁর শেফেদের মতো নিজের হাতের দু’তালুতে পলিথিনের গ্লাভস পরেন না। তাঁর দোকানের বসার ব্যবস্থা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়। ফুটপাথের ধারের দেওয়াল-গর্ত দোকানের ক্রেতারা সেই দুরাশাও করে না। তবে বিনয়ের দোকানে সৌজন্য, স্বাদ আর আন্তরিকতার কোনও অভাব কোনও দিন ছিল না। সে কথাই বলছিলেন বেসরকারি ব্যাঙ্ককর্মী সুনন্দন বসাক। সেই বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট থেকে বাইক চালিয়ে সর্বমঙ্গলায় ‘লাঞ্চ’ করতে আসেন সুনন্দন প্রত্যহ। “বিনয়ের পরিচ্ছন্নতা আমাকে বেশ নিশ্চিন্ত রাখে। আমার অফিসের ওখানে খাবার দোকান প্রচুর। কিন্তু সব ক’টাই বড় অপরিষ্কার। বিনয়ের এখানে চোখ বুজিয়ে, পেট ভরে খাই। ওর আঙুলের নখ দেখুন, সব সমান ভাবে কাটা, এক ফোঁটা ময়লা নেই। তাই কোনও সমস্যাও নেই।’’
বিনয়ের দোকানে ১৮ রকমের স্যান্ডউইচ এখন পাওয়া যায়। এ ছাড়া আছে চিনি বা গোলমরিচ ছড়ানো টোস্ট (২০ টাকায় দু’টি)। স্যান্ডউইচের মধ্যে কয়েকটির নাম করা যাক। ভেজিটেবিল বাটার স্যান্ডউইচ (৩৫ টাকা প্রতি পিস), চিজ় স্যান্ডউইচ (৪৫ টাকা প্রতি পিস) কর্ন স্যান্ডউইচ (৫০ টাকা পিস)। তা ছাড়াও ডিম, সব্জি, মাখন বা চিজ়ের স্যান্ডউইচ (৫০ এবং ৬০ টাকা প্রতি পিস)। কেবল এই ১৮ রকমের স্যান্ডউইচ আর দু’ধরনের টোস্ট নিয়েই এই মুহূর্তে তিনি দিনে ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকা রোজগার করেন। লাভ থাকে দিনে ১০০০ টাকা মতো। সবচেয়ে বেশি বিক্রি করেন চিজ় স্যান্ডউইচ। তাঁর দেওয়ালে গর্তের মতো দোকানে হয়তো ক্রেতাদের লম্বা লাইন পড়ে না, কিন্তু আপিসপাড়ার মধ্যের এই এলাকার প্রায় সব কর্মস্থলের সব রকমের বেতনের ক্রেতাই সপ্তাহে কোনও না কোনও দিন সর্বমঙ্গলার স্যান্ডউইচের স্বাদগ্রহণ করেন। বিনয়ের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়, শারীরিক কষ্ট সত্ত্বেও সুখেই আছেন তিনি। ‘‘ভাবছি স্যর, এ বার চিকেন স্যান্ডউইচটাও শুরু করে দেব। আরও খদ্দের বাড়বে তা হলে,” সম্প্রতি এক দিন বলছিলেন তিনি। নিজের ছোট্ট পথের দোকানের ভবিষ্যৎ নিয়ে যিনি ভাবেন এই আকালেও, তাঁকে সুখী পুরুষ না বলে উপায় কী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy