Advertisement
E-Paper

জীবনবোধ থেকেই গড়ে উঠেছে শিল্প, শিল্পীর মনের কথা উঠে এল সিমা পুরস্কারের মঞ্চে

কলকাতার বুকে বলে নয়, সারা ভারতে কোথাও এত বড় মাপের প্রতিযোগিতামূলক প্রদর্শনী এবং শিল্পকর্মের মানের বিচারে নবাগতদের পুরস্কার দেওয়ার এমন বিপুল ও চোখধাঁধানো আয়োজনের নজির নেই। একমাত্র ‘সিমা গ্যালারি’-ই এই উদ্দেশ্যে এবং পরিসরে গত ২০১৫ থেকে আয়োজন করে আসছে ‘সিমা অ্যাওয়ার্ডস শো’-এর।

The CIMA Awards 2025 recognized a dozen artists in the fields of painting, sculpture, new media, and video art

নবীন শিল্পীদের শিল্পকর্মকে স্বীকৃতি দিল সিমা। কলকাতার এক হোটেলের মঞ্চে। —নিজস্ব চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:০২
Share
Save

নবীন শিল্পীদের বহুমুখী প্রতিভাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই শুরু হয়েছিল পথ চলা। প্রথাভাঙা চিন্তাকে বাস্তবায়নের জন্য শিল্পীর নিরলস প্রয়াসকে বরাবরই স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে সিমা (দ্য সেন্টার অফ ইন্টারন্যাশনাল মডার্ন আর্ট)। কলকাতার বুকে বলে নয়, সারা ভারতে কোথাও এত বড় মাপের প্রতিযোগিতামূলক প্রদর্শনী এবং শিল্পকর্মের মানের বিচারে নবাগতদের পুরস্কার দেওয়ার এমন বিপুল ও চোখধাঁধানো আয়োজনের নজির নেই। একমাত্র ‘সিমা গ্যালারি’-ই এই উদ্দেশ্যে এবং পরিসরে গত ২০১৫ থেকে আয়োজন করে আসছে ‘সিমা অ্যাওয়ার্ডস শো’-এর। এই প্রদর্শনী এ বার পঞ্চম সংস্করণে। ধারা বজায় রেখেই এ বার ১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা ১২ জন নবীন শিল্পীর শিল্পকর্মকে সম্মান জানিয়ে পুরস্কৃত করা হল।

সারা দেশ থেকে পাঠানো প্রায় ১৩০০ আবেদনপত্রের মধ্যে থেকে বাছাই করে ২০০ জন শিল্পীর শিল্পকর্মকে বেছে নেওয়া হয়েছে ‘সিমা’-র পক্ষ থেকে। সেই সব শিল্পকর্মের প্রদর্শনী চলছে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস ও সিমা আর্ট গ্যালারিতে। যা চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি অবধি। তার মধ্যে থেকেও শিল্পকর্মের মানের বিচারে দেশের নানা প্রান্তের ১২ জন শিল্পীকে বেছে নিয়ে তাঁদের কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া হল। প্রথম পুরস্কার জিতে নিলেন সুপ্রিয় মান্না, 'প্রথম রানার আপ' চন্দন বেজ় বড়ুয়া, 'দ্বিতীয় রানার আপ' যৌথ ভাবে সুষমা যাদব ও সৌগত দাস।

সিমা গ্যালারির অধিকর্তা রাখী সরকারের হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন বিজয়ী সুপ্রিয় মান্না।

সিমা গ্যালারির অধিকর্তা রাখী সরকারের হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন বিজয়ী সুপ্রিয় মান্না। —নিজস্ব চিত্র।

শিল্পীর সৃজনশীলতাকে সকলের সামনে তুলে ধরাও সামাজিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। সিমা আর্ট গ্যালারি সুচারু ভাবে সেই দায়িত্ব পালন করে আসছে। তাই সারা দেশে একমাত্র সিমা অ্যাওয়ার্ডেই ভাস্কর্য, চিত্রকলা, আর্ট ইনস্টলেশন, ফোটোগ্রাফি থেকে শুরু করে শিল্পকর্মের নানা দিক ও ভাবধারাকে সম্মান জানানো হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের মেধা ও পরিশ্রমকে স্বীকৃতি দেয় ‘সিমা’, এমনটাই জানালেন সিমার অধিকর্তা রাখী সরকার। তিনি বলেন, “শিল্পেরও বার্তা থাকে। সেই বার্তাকে সমাজের সামনে নিয়ে আসাও এক মহান দায়িত্ব। এ দেশে একমাত্র সিমা-ই শিল্প ও শিল্পীর অন্তরের কথাকে সকলের সামনে নিয়ে আসে। সরকারি ভাবেও শিল্পের প্রচারের প্রচেষ্টা হয় বটে, তবে তা সীমিত পরিসরে। শিল্পীর শিল্পসত্তাকে স্বাধীন ভাবে প্রকাশ করার গুরুদায়িত্ব গত ১০ বছর ধরে পালন করে আসছে সিমা।”

এই রকম সুপরিকল্পিত নির্বাচনের মাধ্যমে পুরস্কার প্রদান শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করে, উৎসাহিত করে, সন্দেহ নেই। একই কথা বললেন সিমা গ্যালারির প্রধান প্রশাসনিক কর্তা প্রতীতী বসু সরকার। তাঁর কথায়, ‘‘শিল্পে গতিময়তা দরকার। শিল্পীকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তাঁর উন্মুক্ত চিন্তাভাবনা নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। সিমা গ্যালারি একসঙ্গেই নতুন ও পুরনোকে আগলে নিয়ে সেজে উঠেছে। শিল্পীদের চিন্তাভাবনায় ফিরে আসছে নতুন নতুন শিল্পকর্ম। আর পক্ষপাতহীন ভাবে শিল্পের সেই রূপ-রস-গন্ধকেই আহরণ করছে সিমা।"

অভীক সরকারের হাত থেকে ‘প্রথম রানার আপ’-এর পুরস্কার নিচ্ছেন চন্দন বেজ় বড়ুয়া।

অভীক সরকারের হাত থেকে ‘প্রথম রানার আপ’-এর পুরস্কার নিচ্ছেন চন্দন বেজ় বড়ুয়া। —নিজস্ব চিত্র।

‘স্পেশ্যাল অ্যাওয়ার্ড’, ‘স্পেশ্যাল মেনশন অ্যাওয়ার্ড’, ‘মেরিট অ্যাওয়ার্ড’, ‘পরেশ মাইতি অ্যাওয়ার্ড’-সহ একাধিক বিভাগে এ দিন ১২ জন শিল্পীকে পুরস্কৃত করা হয়। প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন সুপ্রিয় মান্না। তাঁর শিল্পকর্মের নাম ‘হার্ভেস্ট অফ ট্রাস্ট’। এক প্রকার আগাছা বুনে আশ্চর্য এক শিল্পকর্ম রচনা করেছেন তিনি। সুপ্রিয় বললেন, “কর্নাটকে একরকম ঘাস জন্মায়। সেই ঘাস বুনে বুনেই এক নতুন শিল্পের সৃষ্টি করেছি আমি। এর মধ্যে বিশ্বাস আছে, ভরসার জায়গা আছে।” প্রথম রানার আপ চন্দন বেজ় বড়ুয়ার চিত্রকলা মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই। ক্যানভাসে উত্তর-পূর্বের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে সাদা-কালো প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেছেন তিনি। দ্বিতীয় রানার আপ সুষমা যাদবের ছবিও অতুলনীয়। তাঁর শিল্পকর্ম ‘লেট মি ড্রেস ফর মাইন’। আয়নার সামনে বসে শৃঙ্গার করছেন এক তরুণী। সেই সাজ তাঁর নিজের জন্যই। নিজেকে ভালবাসো, সম্মান করো। শিল্পীর নিজস্ব ভাবনারই প্রকাশ ঘটেছে।

তা ছাড়াও ছিল ‘সর্বাণী কর লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট’ পুরস্কার, যা জিতে নিয়েছেন পঙ্কজ শাহ ও মীনাকুমারী রাস্তে। লোকশিল্পকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে গিয়েছেন তাঁরা। পঙ্কজের কথায়, “হাতে বোনা শিল্পের দিন হারিয়ে যাচ্ছে। মেশিন ও আধুনিক যন্ত্রপাতি আরও বেশি মুনাফা অর্জনের পথ খুলে দিচ্ছে। আমাদের মতো ক্রাফ্‌ট শিল্পীরা তাই চেষ্টা করছি লোকশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার। কেবল স্থানীয় স্তরে নয়, দেশের নানা জায়গায় এই শিল্পকে মেলে ধরার নিরলস প্রয়াস আমাদের আছে, থাকবে।”

‘সর্বাণী কর লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট’ পুরস্কার পেলেন পঙ্কজ শাহ ও মীনাকুমারী রাস্তে।

‘সর্বাণী কর লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট’ পুরস্কার পেলেন পঙ্কজ শাহ ও মীনাকুমারী রাস্তে। —নিজস্ব চিত্র।

শিল্পীর শিল্পকর্মেরও বিবর্তন হয়েছে। জটিল ও দুর্বোধ্য আর্টওয়ার্কের জায়গায় চারপাশের পরিসর, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা থেকেই মণিমুক্তো তুলে আনছেন শিল্পীরা। এই বিবর্তন শিল্পে আলোড়ন তুলেছে, সন্দেহ নেই। এমনটাই মনে করছেন শিল্পী পরেশ মাইতি। তাঁর কথায়, “শিল্পীকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দিতে হবে। দেশের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে রয়েছেন শিল্পীরা। তাঁরা কেবল তাঁদের ভাবনাটুকুকে প্রকাশ্যে আনতে ভয় পাচ্ছেন। চারপাশে যা দেখছি, যা শুনছি, ছোট ছোট বিষয় যা এড়িয়ে যাচ্ছি, তাকেই কত সুন্দর মোড়কে উপস্থাপন করা যায়, সেটাই দেখিয়ে দিচ্ছেন নবীন শিল্পীরা।” পরেশ মাইতির নামাঙ্কিত পুরস্কারও দেওয়া হয় সিমা-র পক্ষ থেকে। এ বছর ‘পরেশ মাইতি অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন দু’জন, কল্পনা বিশ্বাস ও অরুণাংশু রায়। কল্পনার কাজ ছিল ‘ন্যাচারাল ম্যাপ’, ক্যানভাসে মাটি, কাঠকুটো দিয়ে মানচিত্র এঁকেছিলেন তিনি। আর অরুণাংশু রোজের বাতিল জিনিস দিয়েই তাঁর শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বললেন, “বাড়িতে যে সব জিনিস বাতিলের খাতায় চলে যায়, যেমন ছেঁড়া কাগজ, জুতোর বাক্স, রোজের ব্যবহারের জিনিস— তা-ই দিয়েই স্পেশ্যাল আর্ট বানিয়েছি আমি।”

সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও নৃত্য়শিল্পী পারমিতা সাহার যুগলবন্দি মন কেড়ে নেওয়ার মতোই।

সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও নৃত্য়শিল্পী পারমিতা সাহার যুগলবন্দি মন কেড়ে নেওয়ার মতোই। —নিজস্ব চিত্র।

এখনকার শিল্পীদের শিল্পভাবনার মানদণ্ড খুবই উন্নত, এমনটাই মনে করেন শিল্পী শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়। ন’জন বিচারকের মধ্যে তিনিও এক জন। বললেন, “শিল্পীকে বলার সুযোগ দিতে হবে। বৃহত্তর পরিসরে তাঁদের স্বাধীন চিন্তাভাবনাকে প্রকাশ করার অবসরও দিতে হবে। সিমা গত কয়েক বছর ধরে তাই করছে। যেমন প্রথম রানার আপ যিনি হয়েছেন উত্তর-পূর্বের বাসিন্দা চন্দন বেজ় বড়ুয়া কিন্তু সেখানকার কোনও অস্থির পরিস্থিতিকে সামনে আনেননি। বরং শান্ত প্রকৃতির এমন এক রূপ তিনি সাদা-কালো চিত্রপটে এঁকেছেন যা সাম্যেরই বার্তা দেয়। তিনি নিজের চারপাশে প্রকৃতিকে যেমন দেখছেন, তেমন ভাবেই এঁকেছেন।” শিল্পীর কথায়, সব কিছুর মধ্যেই শিল্প লুকিয়ে রয়েছে। কেবল তাকে অন্বেষণ করতে হবে। শিল্পেরও ভাষা রয়েছে, তা সকলের সামনে আনতে হবে। নবীন শিল্পীদের সেই সুযোগই করে দিচ্ছে সিমা।

রোজের জীবনের অতি সাধারণ কিছু মুহূর্ত, নিজের বাড়ি, ব্যক্তিগত পরিসর ও চিন্তাভাবনাই ফুটে উঠেছে শিল্পীর রং-তুলি, শিল্পনির্মাণে। আর্ট ইনস্টলেশনের জন্য মেরিট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন অভিজিৎ দেবনাথ। বললেন, “কোনও ঠিকানাই চিরস্থায়ী নয়। পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা আমরা। বাবাদের থেকে শুনেছি, কী ভাবে সীমানা পেরিয়ে এসে লড়াই শুরু হয়। বেঁচে থাকার লড়াই। তাই ফুটে উঠেছে আমার শিল্পকর্মে।”

সিমা-র এ বারের আয়োজন ছিল মানুষের দৈনন্দিনকে ঘিরে। তার শিকড়ে লোকশিল্পই থাকুক বা মডার্ন আর্ট, প্রায় প্রত্যেক শিল্পীর কাজই কথা বলেছে প্রাত্যহিকের ভাষায়। এটাই বোধ হয় এ বারের প্রদর্শনী থেকে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

cima CIMA Awards CIMA Gallery CIMA Art Gallery cima art gallery exhibition 2025

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}