Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

মুম্বইয়ে নেই শীতের খাওয়া

বাঙালির রান্নাঘরে এখন দেদার আয়োজন। ছোট ট্যাঙরা মাছ দিয়ে পেঁয়াজকলি, পালং শাকের ঘণ্ট, সরষে বাটা সহযোগে সিম ছেঁচকি, বেগুন পোড়া, গাজরের হালুয়া, শালগমের বাটি চচ্চড়ি, ছোট করে ডুমো ডুমো কাটা আলু বা বেগুন দিয়ে মেথি শাক ভাজা, ফুলকপি আলু কড়াইশুটি দিয়ে ডালনা, কড়াইশুটির কচুরি, কচি মুলোর ঘণ্ট, নতুন আলুর দম, পুর ভরা টম্যাটো বা কিসমিস-খেজুর দিয়ে চাটনি ও কড়াইডালের বড়ি রাঁধুনি বাটা দিয়ে শুক্তো, রাঙালুর পান্তুয়া, মোয়া আরও কত কী। লিস্ট লম্বা হতে থাকবে, কিন্তু বাঙালির রসনার ফিরিস্তি কখনওই কমবে না। কত রকমের পদ কত রকমের আয়োজন। শীতের খাওয়া নিয়ে লিখছেন মধুছন্দা মিত্র ঘোষ।বাঙালির রান্নাঘরে এখন দেদার আয়োজন। ছোট ট্যাঙরা মাছ দিয়ে পেঁয়াজকলি, পালং শাকের ঘণ্ট, সরষে বাটা সহযোগে সিম ছেঁচকি, বেগুন পোড়া, গাজরের হালুয়া, শালগমের বাটি চচ্চড়ি, ছোট করে ডুমো ডুমো কাটা আলু বা বেগুন দিয়ে মেথি শাক ভাজা, ফুলকপি আলু কড়াইশুটি দিয়ে ডালনা, কড়াইশুটির কচুরি, কচি মুলোর ঘণ্ট, নতুন আলুর দম, পুর ভরা টম্যাটো বা কিসমিস-খেজুর দিয়ে চাটনি ও কড়াইডালের বড়ি রাঁধুনি বাটা দিয়ে শুক্তো, রাঙালুর পান্তুয়া, মোয়া আরও কত কী। লিস্ট লম্বা হতে থাকবে, কিন্তু বাঙালির রসনার ফিরিস্তি কখনওই কমবে না। কত রকমের পদ কত রকমের আয়োজন। শীতের খাওয়া নিয়ে লিখছেন মধুছন্দা মিত্র ঘোষ।

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০০
Share: Save:

“শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা”—প্রয়াত কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর সেই কোনও দিন না-পুরনো হওয়া কবিতার শব্দকথন। আজও আমাদের কাছে আগাম শীতের বার্তাবহ কবিতার ওই স্মৃতিমেদুর শব্দ কয়টি। বাতাসে হিমেল আমেজ সামান্য বইল তো জীবনটাই অবধারিত দিলখুশ হয়ে গেল। শীতের মিঠে রোদ্দুর গায়ে মেখে আয়াস করার এমন মওকাগুলোতেই তো ভাল লাগা জমা হয় শীত আনুগত্য মনে।

সকালে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে ঠোঁট ডুবিয়ে আস্বাদন করা শীতার্ত মাদকতা। ওই এক কাপ কফিই এনে দিতে পারে চূড়ান্ত রকমফের। শীতসকালের ওম অবকাশকে সমৃদ্ধ করতে সেই গরম কফিটুকুই তো বাড়তি পাওনা। শীত কাছে এল মানেই অন্য কোনও কিছু তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতোন নানান মুখরোচক খাবারের আনন্দ প্রবণতায়।

বাঙালির বাজারের থলি ভাবছে তাজা সবুজ না লাল টুকটুকে টম্যাটো। শীত মাখা সব্জির ঝুড়ি উপচে পড়ছে। শীতের মরসুম মানেই যা খুশি তাই। শীতের রান্নাঘর মানেই স্পেশাল মেনু। সে তখন বাহারি রান্নার মজলিসে। শীতের সব্জি বাজার হাতছানি দেয়।

সব্জি বিক্রেতার সামনের স্তূপাকৃতি কড়াইশুঁটি, গাজর, শালগম, বিট, ফুলকপি, পেঁয়াজকলি, সবুজ ও সাদা সিম, নধর বেগুন, সাদা অথবা গোলাপি মুলো, পালং, মেথি শাক, সর্ষে শাক, রাঙা আলু, ছাল ওঠা নতুন আলু—হরেক সম্ভার। পাড়ায় পাড়ায় হেঁকে যাওয়া সব্জি ফেরিওয়ালা পর্যন্ত তার ঠেলাগাড়ির কাঁচা সব্জির পসরা দেখিয়ে প্যাঁচে ফেলে। গেরস্থ বাড়ির ফ্রিজ সমস্ত শীতকাল জুড়ে ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই’ অবস্থায়।

বাঙালির রান্নাঘরে তখন দেদার আয়োজন। ছোট ট্যাঙরা মাছ দিয়ে পেঁয়াজকলি, পালং শাকের ঘণ্ট, সরষে বাটা সহযোগে সিম ছেঁচকি, বেগুন পোড়া, গাজরের হালুয়া, শালগমের বাটি চচ্চড়ি, ছোট করে ডুমো ডুমো কাটা আলু বা বেগুন দিয়ে মেথি শাক ভাজা, ফুলকপি আলু কড়াইশুঁটি দিয়ে ডালনা, কড়াইশুঁটির কচুরি, কচি মুলোর ঘণ্ট, নতুন আলুর দম, পুর ভরা টম্যাটো বা কিসমিস-খেজুর দিয়ে চাটনি ও কড়াইডালের বড়ি রাঁধুনি বাটা দিয়ে শুক্তো, রাঙা আলুর পান্তুয়া আরও কত কী। লিস্ট লম্বা হতে থাকবে, কিন্তু বাঙালির রসনার ফিরিস্তি কখনওই কমবে না। কত রকমের পদ কত রকমের আয়োজন।

ইদানীং চাষাবাদে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। হামলে পড়া শীতের বাজার বা ব্যাগ উপচে শীতের আনাজপাতি কেনার আয়েসি আভিজাত্যেও হয়তো সামান্য ফারাক হয়েছে। বাজারে ইদানীং বছরভর ফুলকপি, বাঁধাকপি, টম্যাটো, মটরশুঁটি, মুলো, পালং, ধনে পাতা ইত্যাদি সবই পাওয়া যায়। ‘শীতের আনাজ’ বলে যেগুলো এক সময় শুধুমাত্র শীত মরসুমেই পাওয়া যেত—এখন বাজারে সম্বত্‌সর সেগুলো বিকোয়। তবে শীত মরসুমের সেই সতেজতা সে আনাজে কোথায়? স্বাদেও একেবারে পোক্ত নয়। কালকে কেনা ফুলকপির গায়ে আজই ধরে যায় কালো ছোপ। বাঁধাকপিতেও ভ্যাপসা বুনো গন্ধ। হাইব্রিড টম্যাটো। অতিরিক্ত সার দেওয়া পালং, মেথি। শুকনো কড়াইশুঁটি। বিচি প্যাটপ্যাটে বেগুন।

কিশোরীবেলার এক নিত্য সান্ধ্য-আহারের কথা মনে পড়ল। শীতকালভর মা ডুমো ডুমো করে কাটা বিট ও গাজরের টুকরো, বাঁধাকপির একদম ভেতরের কচি পাতা কয়েক কুচি, কয়েক টুকরো ফুলকপি, দু-এক টুকরো দারচিনি ফেলে, প্রচুর কড়াইশুঁটি, স্বাদ মত নুন-মিষ্টি দিয়ে প্রেসার কুকারে স্রেফ সেদ্ধ করত। ওপরে একটু মাখন ও মরিচগুঁড়ো ছড়িয়ে সন্ধেবেলা বাটিতে ধোঁয়া ওঠা ওই লাল রঙা স্যুপ খেতে হতো। তখন তো আর নামীদামি কোম্পানির বাজারি, প্যাকেটজাত, গুচ্ছের কর্নফ্লাওয়ার দেওয়া স্যুপ পাওয়া যেত না।

এখন তো কত রকমারি স্যুপের প্যাকেট বাজারে। চিকেন গার্লিক স্যুপ, মাসরুম স্যুপ, সুইট কর্ন স্যুপ, হট অ্যান্ড সুইট ভেজিটেবিল স্যুপ, টম্যাটো স্যুপ বিকোয়। তখন কিন্তু শীতের টাটকা আনাজ দিয়ে বাড়িতে প্রেসারে সেদ্ধ ওই জোলো স্যুপের একটা আলদা স্বাদ, একটা নস্টালজিয়া।

প্রসঙ্গক্রমে শীত সব্জির আরও একটা সনাতনী রান্না সম্বত্‌সর সরস্বতী পুজোর পরের দিন বাড়িতে হত। আমাদের এদেশীয় বাড়িতে এটা বাধ্যবাধকতার সঙ্গে রান্না করতে হতই। একটা বড় ডেকচিতে শীতের প্রায় প্রতিটি আনাজ ছয়-টা বা তার অধিক একদম আস্ত ফেলে তাতে কিছু মাস-কড়াই, কাঁচা তেল ছড়িয়ে পরিমাণ মতো নুন-মিষ্টি দিয়ে বিনা হলুদে সেদ্ধ করতে হয়। এই রান্নাটার নাম ‘গোটা সেদ্ধ’। যেহেতু সব আনাজ একদম না কেটে গোটা অবস্থায় রান্না করতে হয়, তাই ‘গোটা সেদ্ধ’। শ্রীপঞ্চমীর পর দিন ‘শীতলা ষষ্ঠী’ ব্রত ও ‘অরন্ধন’। ওই দিন ঠান্ডা ও বাসি রান্না খাওয়ার চল এদেশীয় বাঙালি বাড়িতে। সেই ‘গোটা সেদ্ধ’-এর একটা অবর্ণনীয় সুন্দর স্বাদ। মুম্বইয়ে পরবাস যাপনে ওই ‘গোটা সেদ্ধ’ বানানোর হ্যাপা, তাই অনেক আগেই বাদ দিয়েছি। এখানকার প্রজন্ম ওই ‘গোটা সেদ্ধ’র অনন্য স্বাদটাই জানল না।

পৃথিবীতে দু’ধরনের মানুষ আছেন। এক, যাঁরা খাওয়ার জন্যই বাঁচেন। আর দুই, যারা শুধুমাত্র বাঁচার জন্য খান। যদিও এটি রসিকতা করেই বলা হয়। সব্বাইকে যে ভোজনরসিক হতেই হবে তার কোনও মানে নেই। আবার অনেকে থাকেন যারা নিজেকে শুধু স্লিম অ্যান্ড ট্রিম রাখার জন্য এবং নিজেকে সচল রাখতে যেটুকু প্রয়োজন কেবল ততটুকুই খান। ডায়াট চার্টে চোখ রেখে ক্যালোরি মেপে খেতে খেতে এদের খাবারের প্রতিই একটা অনীহা এসে যায়।

সেলিব্রিটিরা অনেকেই তাঁদের পেশার তাগিদে টক দই, এক বাটি চিকেন স্যুপ, শসা কুচি, মুড়ি, মাখন ছাড়া দুই পিস শুকনো টোস্ট, ডাবের জল, ফলের জ্যুস খেয়েই দিব্যি কাটিয়ে দেন। তবে ‘পেটরোগা বাঙালি’ এখন আর মোটেই পেটরোগা পদবাচ্যতে নেই। ফুডিদের জন্য তো রেস্তোরাঁ, নানান ঘরানার ক্যুইজিন খাওয়ার অভ্যাস তো আছেই। এখনকার রেস্তোরাঁয় ইতালিয়ান, চাইনিজ, ওরিয়েন্টাল, মোগলাই, তন্দুর, মেডিটেরিয়ান ও ভারতীয় রান্নাঘর থেকে বাছাই করা এক্কেবারে ‘সিগনেচার ডিশ’গুলি হাজির করা হয়। নিত্যনতুন রেস্তোরাঁয় নতুন কনসেপ্ট, কোথাও আবার লাইফ কিচেন, ফাইন ডাইনিং, সাজানো দেওয়াল, অত্যাধুনিক সাজ। গ্লোবাল কিচেনের হাত ধরে অতিথিরা কখনও নিজেরাই লাইভ কিচেনে তার পছন্দসই খাবার কী ভাবে প্রস্তুত হচ্ছে চাক্ষুস করতে পারেন। এখন তো অনেক বাঙালি বিয়ের নিমন্ত্রণ বাড়ি ঢোকার আগেই সৌখিন দেহাতি পোশাক পরিহিত বিহারী ফুচকাওলার সুসজ্জিত ফুচকার পসরা। যত ইচ্ছে বিনে পয়সায় খাওয়া। হাজির চাটওয়ালাও।

পাপড়ি চাট, সেঁও পুরি, দই বড়া, রাজ পুরি, বাটাটা পুরি, শিঙাড়া চাট, মিক্স চাটের এলাহি সম্ভার। নেমন্তন্ন বাড়িতে খাবার পর চিরাচরিত বাঙালিয়ানায় শেষ পাতে পান দেওয়াই হল না। সামান্য দূরেই রংবেরঙের মশালা, হরেক উপকরণ সহযোগে মিষ্টি পানের বৈভব নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে আছেন সৌখিন পোশাক ও সেজেগুজে ‘বারাণসী পানওলা’। এক্কেবারে ‘আসলি’। সেই সুসজ্জিত স্টলে নিজের চাহিদা মত পানের মশলা, জর্দা, বিনা সুপারি-বিনা জর্দা এমন দেখেশুনে ফরমায়েশ করলেই হল। তবে যাই বলো না কেন, শীতের মুডকে ধরে রাখতে বাঙালি বাড়ির রান্নাঘরটি কিন্তু আজও সেরা। বাঙালির প্রাতরাশ বলতে একটা সময়ে ছিল ঝাঁঝালো সরষে তেল দিয়ে মাখা আলুসেদ্ধ ভাত। সঙ্গে এক দলা মাখন। অথবা গাওয়া ঘি। স্কুলের তাড়া, অফিসের তাড়াহুড়ায় এ এক অতি জনপ্রিয় প্রাতরাশ পর্ব ছিল। কখনও তার সঙ্গে যোগ হত কড়া করে ভাজা মাছ কিংবা হলদে কুসুমযুক্ত নরম সেদ্ধ ডিম। গোবিন্দভোগ চালের ভাতের সঙ্গে কাঁচালঙ্কা পেঁয়াজকুচি মাখা আলু সেদ্ধ, সোনালি রঙা ঘি বা মাখন আর ডিমের হলদে সাদা সব মিলিয়ে বাঙালির সকালের সেই আহারটুকুই যেন অনন্য মাত্রায় পৌঁছে যেত। সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা। রবিবারের প্রাতরাশ কিন্তু একেবারেই আলাদা। রোব্বার মানেই ফুলকো লুচি। আর তার সঙ্গে কালো জিরে কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দেওয়া আলুর সাদা তরকারি। এ যেন প্রতিটি বাঙালি বাড়িতেই প্রাতরাশের চেনা পদ। কোনও কোনও রবিবার ফুলকো লুচির সঙ্গে সঙ্গতে লম্বা করে বা চাকা চাকা করে কাটা বেগুন ভাজা। পুজোপার্বণ বা উত্‌সবের দিনে ফুলকো লুচির সঙ্গে যোগ হত নারকেল কুচি হিং ফোড়ন দিয়ে রান্না করা ছোলার ডাল, মিষ্টি কুমড়ো, আলু, সামান্য বাদাম ভাজা বা ছোলা সেদ্ধ সহযোগে ছক্কা। অথবা লুচি ও কষা মাংস। এবং তা অবশ্যই মাটন।

শীতকালের বোরবারে অবশ্য তার সঙ্গে থাকত নলেন গুড়ের পাটালি। কখনও অপেক্ষাকৃত কম তেলে বা ঘিয়ে তিন কোনা করে বেলা ময়দার পরোটা ও সঙ্গে ঝোলা গুড়। শীতকালে অবধারিত ভাবে কড়াইশুঁটির কচুরি ও কষা আলুর দম-এ বৈকালিক আহার জমে যেত। বাঙালি বাড়িতে আরও একটা প্রাতরাশও বেশ জনপ্রিয় ছিল একসময়ে। ডিম পাউরুটি। যাকে পোশাকি নামে বলা হত ‘ফ্রেঞ্চ টোস্ট’। বাড়ির কমবয়েসিদের খুবই পছন্দের আহার এই ‘ফ্রেঞ্চ টোস্ট’। নামের সঙ্গে ফরাসি লেজুূড় থাকলেও ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। একটা বড় চ্যাটালো বাসনে কয়েকটা ডিম ফেটিয়ে সেই ডিমের গোলায় পেঁয়াজ কুচি, কাঁচালঙ্কা কুচি, নুন, মরিচ গুঁড়ো, সামান্য দুধ মিশিয়ে ভাল করে ফেটিয়ে নিয়ে তাতে তিন কোনা করে কাটা পাউরুটির স্লাইস চুবিয়ে গরম তেলে ভাজা। বেশ মুখরোচক।

কর্নফ্লেক্স-মুসলি-ওটস আসার আগে পর্যন্ত দুধ-কলা-মুড়ি বা চিড়েও একটা প্রচলিত জলখাবার ছিল প্রায় প্রতিটি বাড়িতে। গরমের দিনে তাতে রসালো মিষ্টি আম চটকিয়ে মেখেই যেন স্বাদটা বদলে যেত। কখনও ঘরে পাতা টাটকা দই-চিড়ে মাখা। বাঙালির পাতে জলখাবারের পাউরুটি সেঁকা ও এক বাটি ঘুগনিও বা চানাচুর-পেঁয়াজ কুচি-কাঁচালঙ্কা কুচি-সরষে তেল বাড়িতে কাঠখোলায় ভাজা শুকনো জিরে লঙ্কা গুঁড়ো-বাদাম ভাজা-নারকেলের ফালি সহযোগে জমে যেত বিকেলের আড্ডা। এখন তো নামী কোম্পানির প্যাকেটেই পাওয়া যায় এই ‘মশলা-মুড়ি’ বা ‘ভেল-পুরি’। আর সেই যে শীতের গাজরের ফালি, কড়াইশুটি, কুচকানো ফুলকপি, পেয়াজ আদা লঙ্কা কুচি, সামান্য লেবুর রস, বাদাম এ সব দিয়ে কড়াইয়ে গাওয়া ঘি-সরষে ফোড়ন-তেজ পাতা দিয়ে অসামান্য সেই ‘চিড়ের পোলাও’! আ-হা।

বাঙালির আড্ডা ও পরনিন্দা পরচর্চার সাবেকি ঠেক পাড়ার চায়ের দোকান। আবহমান ফুটতে থাকা ঘন দুধের চা। সঙ্গে চায়ের স্টলেই বয়ামে রাখা নানান স্বাদের লেড়ো বিস্কুট। কখনও বা কারও কারও ফরমায়েসে দুধ ছাড়া ‘লিকার চা’। চায়ের ঠেকে অতি আবশ্যিক ভাবে দু’তিনটে লিডিং বাংলা নিউজ পেপার থাকবেই। কাগজের খবরাখবর আদ্যোপান্ত পড়ে কত জ্ঞানগর্ভ আলোচনা চলতে থাকে চায়ের কাঁচের গেলাস হাতে নিয়ে। সবজান্তা বাঙালির ওটাই বক্তিমে দেখানোর আদর্শ স্থান।

এখন তো ভোল পালটে অত্যাধুনিক কাফে হয়েছে কত। কোনও কাফেতে পড়ার জন্য থরে থরে ম্যাগাজিন ও বই সাজানো। বইও ক্লাসিক নভেল থেকে কমিকস, কোনও পছন্দ মতো বিষয় হাতে নিয়ে ডুব দেওয়া যেতে পারে খানিক সময়। নানান শৈলীর গরম বা ঠান্ডা কফির মগে চুমুক দিতে দিতে সেরে ফেলা যায় বিজনেস মিটিং বা কোনও সাক্ষাত্‌কার। আবার হালকা মেজাজে খানিক আড্ডাও বন্ধুর সঙ্গে। ইদানীং অনেক কাফেতেই সৃষ্টিশীল মানুষদের জন্য রয়েছে রং তুলি ক্যানভাস অথবা গিটার। মস্ত্ সময় কাটানোর নতুন প্রজন্মের বিন্দাস ঠেক।

ও হ্যাঁ। খাদ্যরসিক বাঙালির মত্‌স্য প্রীতির কথাই তো এতক্ষণ বলা হয়নি। ‘মত্‌স্য মারিব খাইব সুখে’—সাবেক এই প্রবচন বাক্যটির কাতরতায় আজও বাঙালির অন্তর্গূঢ় মনটি। ওই যে বলে না, ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। আহারে পাতে অভ্যস্ত এক টুকরো মাছের উপস্থিতি—বাঙালি রসনায় যেন অনেকখানি পাওয়া।

পেটুক বাঙালির কবজি ডোবানো ব্যঞ্জনে অনায়াসে শ্রেষ্ঠ স্থান পেতে হাজির তোপসে ফ্রাই, পাবদা সর্ষে, দই মাছ, তেল কই, চুনো মাছের বাটি চচ্চড়ি, পার্শে ঝাল, ভাপা ইলিশ, ভেটকি পাতুরি, ডাব চিংড়ি, চিংড়ি মালাইকারি, চিতল ম্যুইঠা, বোয়াল মাছের গঙ্গা-যমুনা এমনতর এলাহি জিভে জল আনা পুরাতনী রান্নাও।

ও দিকে নিরামিষ ঘরোয়া রান্নাতেও একটু মাছের প্রলেপ দিয়ে কীই অসাধারণ হয়ে ওঠে লাউ চিংড়ি, মোচা চিংড়ি, এঁচোড় চিংড়ি, মুড়ি ঘণ্ট, ছোট ট্যাংরা দিয়ে পেঁয়াজকলি, ছ্যাঁচড়া, মাছের ডিমের বড়া, কাতলা মাছের মাথা ভেঙে মুগডাল, ভেটকি মাছের কাঁটা চচ্চড়ি। আহাপদগুলির নামটুকু লিখতে গিয়েও জিভে জল। নিদেনপক্ষে প্রাত্যহিক রান্নায়, গড়পড়তা ভাতের পাতে স্রেফ কালো জিরে কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দেওয়া ছোট মাছের পাতলা ঝোল কিংবা জিরে বাটা টম্যাটো কুচি দিয়ে বড় পোনা মাছের ঝোল, বাঙালি তাতেই খুশি।

শীতের পিকনিক মানেই একটা সময় ছিল গরম চ্যাটালো বেগুনি, শীতের সতেজ রকমারি সব্জি দিয়ে খিচুড়ি, মাছের মাথা দিয়ে বাঁধাকপির তরকারি, টম্যাটোর সুস্বাদু চাটনি। আর একটু ভাল রকম চাঁদা উঠলে সেই ভাল বাজেট মতো পিকনিক স্থলে পৌঁছতে না পৌঁছতেই থার্মোকলের প্লেটে হাজির চার পিস কড়াইশুটির কচুরি, কষা আলুর দম ও একটা নলেন গুড়ের সন্দেশ বা জয়নগরের মোয়া। পরে মধ্যাহ্নভোজনে পিস পোলাও অথবা মিক্সড ফ্রায়েড রাইস, স্টিম ফুলকপি মশালা, মিক্সড ভেজ, ফিস ফ্রাই, ভেটকি পাতুরি, টম্যাটো কাজু কিসমিস খেজুর আমসত্ত্ব দেওয়া চাটনি কিংবা তাজা মিক্সড ফ্রুট চাটনি, পাঁপড়, নলেন গুড়ের মাখা সন্দেশ। হিমেল দিনে পিঠে রোদ মেখে অপরূপ হয়ে ওঠে সেই পিকনিক পর্ব।

শীত মরসুমের সেই টাটকা তাজা খেজুর রস, নলেন গুড়, নলেন পাটালি মাটির তৈরি গুড়ের নাগরিতে ঝোলা গুড়, ফুলকপির শিঙাড়া, কড়াইশুঁটির কচুরি, সঙ্গে গোল গোল ছোট সাইজের খোসা ওঠা নতুন আলুর দম, নলেন গুড়ের সন্দেশ, জয়নগরের মোয়া, টোপা কুলের অম্বল আর পৌষপার্বণের পিঠেপুলি নিয়ে মুম্বইয়ে তেমন করে শীত আসে না। শীতের ওম- এর অভাব বোধ থেকেই যায়।

বস্তুত উপসাগরীয় অঞ্চল বলে মুম্বইয়ে শীত তেমন ভাবে পড়েই না। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে একটা মিষ্টি মিষ্টি হালকা ঠান্ডা পরশ অনুভতি হয় মাত্র। শীতের হিমেল বাতাবরণ নিয়ে শীত আসে না। মোটেই মুম্বইয়ের ঋতুবৈচিত্রে তেমন টের পাওয়া যায় না শীতকে। মুম্বইয়ে প্রতিবছর পুরো শীতকাল জুড়ে গড় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি থেকে ৩২ ডিগ্রি পর্যন্তই ঘোরাফেরা করে। এখানে শীতের আলোয়ান, গলা বন্ধ পুলওভার, হনুমান টুপি, শিমুল তুলোর লেপ ছাড়াই দিব্যি চলে যায়। হালকা সোয়েটার, নরম সিল্কের পশমিনা কম্বল, স্কার্ফ-এই কেটে যায় শীত পর্ব। এখানে মুম্বইয়ের বাঙালি ওতেই অভ্যস্ত। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জলসা, কনসার্ট, থিয়েটার, কাছেপিঠে প্রমোদ ভ্রমণ, ক্রিসমাস ও নিউইয়ার্স ইভে খানিক হুল্লোড়, এ ভাবেই কেটে যায় মুম্বইতে বাঙালিদের শীতের মৌতাত। আর শীতের মনোহারী ব্যঞ্জন ও শীতকালীন সাবেক পুরাতনী রান্নার জম্পেশ ভূঁড়িভোজ। সারাটা সময় ব্যস্ততায় কাটানো মুম্বইয়া বাঙালির অত সময় কোথায়, নষ্ট করার। এমনই এমনই কেটে যায় মুম্বইস্থিত বাঙালির জমাটি শীত বৃত্তান্ত।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE