Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
ত্রিপুরা

অনিলায়নের শিকার টিআইটি, ক্ষুব্ধ পড়ুয়ারা

উত্তর পত্রে পরীক্ষকের ছোঁয়াচটুকুও নেই! নেই লাল কালির কোনও ‘রাইট’ বা ‘ক্রশ’ চিহ্নও! তবু মেনে নিতে হবে ওই খাতা পরীক্ষা করা হয়েছে। এবং সেই মূল্যায়ণের উপরে দাঁড়িয়ে নির্ধারিত হবে এক পরীক্ষার্থীর ভাগ্যও। যদিও ছাত্রছাত্রীদের ভাগ্য বিড়ম্বনার কোনও উদাহরণ নেই।

আশিস বসু
আগরতলা শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২২
Share: Save:

উত্তর পত্রে পরীক্ষকের ছোঁয়াচটুকুও নেই! নেই লাল কালির কোনও ‘রাইট’ বা ‘ক্রশ’ চিহ্নও! তবু মেনে নিতে হবে ওই খাতা পরীক্ষা করা হয়েছে। এবং সেই মূল্যায়ণের উপরে দাঁড়িয়ে নির্ধারিত হবে এক পরীক্ষার্থীর ভাগ্যও। যদিও ছাত্রছাত্রীদের ভাগ্য বিড়ম্বনার কোনও উদাহরণ নেই। বরং অভিযোগ, বড় সহজেই পাশ করিয়ে দেওয়া হয় ত্রিপুরা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (টিআইটি) ছাত্রছাত্রীদের। অবশ্যই অভিযোগের তর্জনী টিআইটি-র এক শ্রেণির শিক্ষকের দিকে।

আসলে ত্রিপুরার শিক্ষা ব্যবস্থায় তথাকথিত ‘বামপন্থী অনিলায়ন’ শিক্ষকদের একটি অংশকে অসীম ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছে। ফলে নিয়মিত ক্লাস নেওয়া, পড়ানো বা সঠিক মূল্যায়ণের মতো ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয়গুলি তাঁদের কাছে আদৌ গুরুত্ব পায় না। এতদিন টিআইটির ছাত্রছাত্রীদের তাঁরা পরীক্ষার আগে ১০-১৫টি ‘সাজেশন’ প্রশ্ন দিয়ে এবং প্রত্যেক সেমেস্টারে পাশ করানোর গ্যারান্টি দিয়ে তাঁরা পার পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বাইরের পৃথিবীতে হাজির হয়ে সেই উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীরা হালে পানি পাচ্ছেন না। ফলে তাঁরাই রুখে দাঁড়িয়েছেন টিআইট়ি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতরের দিকে। ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ, ‘‘আমরা কিছুই না শিখে পাশ করে গিয়ে কী করব। কর্মজগতে গিয়ে তো পাত্তাই পাব না।’’

২০০৭ সালে রাজ্যের পলিটেকনিক ‘ত্রিপুরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’-কে ত্রিপুরা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি হিসেবে ঘোষণা করে শুরু করা হয় রাজ্য সরকারের অধীনস্থ একমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজটি। টিআইটি-র পাঠ্যক্রম রাজ্যে অবস্থিত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তথা ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন প্রাপ্ত। আর এর পরিকাঠামো ইত্যাদি বিষয়ে অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল অফ টেকনিক্যাল এডুকেশন (এআইসিটিই)–এর শর্তাবলী মেনে চলার কথা। স্বভাবতই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ, ‘‘কলেজ তৈরির আদি পর্ব থেকেই টিআইটির ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষার নিম্ন মান এবং পরিকাঠামোগত সমস্যায় ভুগছে। সেটা এখনও চলছে রাজ্যের উচ্চ শিক্ষা দফতরের উদাসীনতা এবং শিক্ষকদের একাংশের অশিক্ষকসুলভ আচরণের কারণে। তাঁরা রাজনীতি ও নিজেদের রাজনৈতিক উচ্চাশা পূরণে এতটাই ব্যস্ত যে পড়ানো বা ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের বিষয়ে তাঁদের কোনও আগ্রহই নেই।’’ সিভিল, মেকানিকাল, কম্পিউটার সায়েন্স, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকমিউনিকেশন—অধিকাংশ বিভাগেই পরীক্ষার আগে এই শিক্ষকরা ১৪-১৫টি প্রশ্নপত্র ‘সাজেশন’ হিসেবে দিয়ে দেন। সেই প্রশ্নপত্র থেকেই সেমেস্টার পরীক্ষায় প্রশ্ন সেট করা হয়। কোনও কোনও বিষয়ে সারা বছরে কোনও কোনও শিক্ষক ক্লাসই নেন না বলেও তাঁদের অভিযোগ। ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গিয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা তো দূরঅস্ত্। স্বভাবতই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ‘ক্ষোভ’ ধূমায়িত হচ্ছে।

২০১৩ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় সেমেস্টার পরীক্ষার উত্তরপত্রের কোনও মূল্যায়ণ ছাড়াই সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থীকে পাস করিয়ে দেওয়ার এমন একটি উত্তরপত্র আনন্দবাজারের হাতেও এসেছে। ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অঞ্জন ঘোষের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। উত্তরপত্রটি দেখে অস্বস্তিতে পড়েন উপাচার্য। এরপরেও টিআইটি পাঠ্যক্রমের অনুমোদন তাঁরা দেবেন? প্রশ্নের সরাসরি উত্তর এড়িয়ে তিনি বল ঠেলে দেন রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতরের কোর্টে। তাঁর কৌশলী জবাব, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয় টিআইটি-র পাঠ্যক্রম ঠিক করে দেয়। প্রশাসন, পঠনপাঠন টিআইটিতে হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতরের।’’ অস্বস্তিতে টিআইটি-র প্রিন্সিপ্যাল শেখর দত্তও। ওই উত্তরপত্রটির ‘সত্যতা’ তিনি অস্বীকার করেননি। তবে বিস্মিত, ‘‘এটা কী করে সম্ভব হল, বুঝতে পারছি না।’’ রাজ্যের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী তপন চক্রবর্তীও স্বীকার করেন, ‘‘প্রতিষ্ঠান তৈরির গোড়া থেকেই বেশ কিছু সমস্যা এখনও রয়ে গিয়েছে, এটা ঠিক। দেখি কী করা যায়।’’

টিআইটি-র এক প্রাক্তনীর কথায়, ‘‘ডিপ্লোমা কলেজ থেকে ডিগ্রি কলেজ হলেও এআইসিটিই-র নির্দেশিকা সম্পূর্ণ অমান্য করে সেই শিক্ষকদেরই সরকার পুষে রেখেছে। কারণ তাঁদের একটা বড় অংশ পার্টির তাঁবেতে রয়েছেন। কাজের জগতে এসে আমরা দেখেছি, কলেজে কিছুই শিখিনি। সেই কারণেই এখানে কোনও কোম্পানিও ক্যাম্পাসিং ইন্টারভিউয়ে অংশ নেয় না।’’ ছাত্রছাত্রীদের ক্ষোভ, এআইসিটিই-র ‘নির্দেশিকা’ অগ্রাহ্য করে একই বিল্ডিংয়ে ডিগ্রি কোর্স এবং ডিপ্লোমা কোর্স চালাচ্ছে টিআইটি। দু’টি কোর্সের ছাত্রছাত্রীরা একই ল্যাবরেটরি, একই লাইব্রেরি ব্যবহার করছেন একই সময়ে। তা ছাড়া, ডিপ্লোমা কোর্সের জন্য নির্দিষ্ট শিক্ষকেরা ‘ডিগ্রি’ কোর্স পড়াচ্ছেন কী ভাবে?--সে প্রশ্নও এখন তুলছেন ছাত্রছাত্রীরা। উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৭ সালে এআইসিটিই এ বিষয়ে কিছু ছাড় দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের যাঁদের এআইসিটিই’র নির্ধারিত ‘ন্যূনতম’ শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই, ২০১৪ সালের মধ্যে তাঁদের সেটি অর্জন করতে হবে। সেই শর্তও পূরণ করতে পারেনি টিআইটির বিভিন্ন বিভাগের বেশ কিছু শিক্ষক। এতে ছাত্রছাত্রীদের যে পঠনপাঠনে অসুবিধা হতে পারে, সে কথাও মেনে নিয়েছেন ত্রিপুরা উচ্চশিক্ষা দফতরের অধিকর্তা বিপ্রদাস পালিত। তাঁর মন্তব্য, ‘‘সমস্যাটি মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’’

টিআইটির অধ্যক্ষ শেখর দত্ত সমস্যাটির বিষয়ে অবগত। তিনি জানান, ‘‘ন্যূনতম যোগ্যতা
অর্জনের জন্য প্রতি বছরই এ রকম কিছু শিক্ষককে কলেজ থেকে অন্যত্র পাঠানো হচ্ছে। এখনও সাত-আট জন বাকি রয়েছেন।’’ কিন্তু এর পরেও ডিপ্লোমা পাঠ্যক্রমের জন্য লেকচারার পদে নিযুক্ত শিক্ষকদের টিআইটি’র ‘অ্যাসোয়িয়েট প্রফেসর’ করা হয়েছে এআইসিটিই-র নির্দেশিকা উপেক্ষা করেই। প্রশ্ন উঠেছে, এটাই বা কী ভাবে সম্ভব হল? উচ্চশিক্ষা দফতরের অধিকর্তাও এ বিষয়ে কোনও
সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে আঙুল উঠছে সেই অনিলায়ন বা রাজ্যের শিক্ষা-ব্যবস্থার রাজনীতিকরণের দিকেই।

অভিযোগের তীর এআইসিটিই-র বিরদ্ধেও। ন্যূনতম পরিকাঠামোর অভাব, ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই টিআইটি-কে কী ভাবে বছরের পর বছর এআইসিটিই ছাড়পত্র দিয়ে চলেছে, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE