মন্দিরের সিংহদুয়ারের উল্টোদিকের সিঁড়ির চাতালটা তত ক্ষণে এক ঝাঁক ক্যামেরাধারীর দখলে! শুনলুম, ওই সব ছাদ-টাদের আধ হাত ভূমি দখল করতে গেলেও কয়েক হাজার টাকা খসাতে হবে!
জগন্নাথ মন্দিরের সামনের রাস্তা বড় দাণ্ড বা গ্র্যান্ড রোডে আশপাশের যে কোনও ছাদ-বারান্দাই রাতারাতি মহার্ঘ হয়ে উঠেছে। রীতিমতো নিলাম করে মাথাচাড়া দিয়েছেন ছাদের এক-একজন স্বত্ত্বাধিকারী। ছাদে উঠতে তাঁদের দক্ষিণা দিতে হবে। মন্দিরের ভিতরে গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে জগন্নাথদেবের রথারোহণের দৃশ্য বা ‘পাহুন্ডি বিজে’ চাক্ষুষ করতেও কয়েক শো টাকার টিকিট বিক্রি হচ্ছিল আগের দিন দুপুরে। সিংহদুয়ারের উল্টো দিকের ছাদটাই সব থেকে দামি, সেখানে ঠাঁই পেলে দূর থেকেই মন্দিরের ভিতরের পাহুন্ডিরও সাক্ষী থাকা যাবে। যা বুঝলুম, আপাতত কোথাওই গতি হবে না আমার মতো লেটলতিফের।
পাঞ্জাবির বুকপকেটে সাংবাদিকের পরিচয়পত্রটি অতএব হাত দিয়ে দেখে নিই একবার। ওটাই ভরসা! তিন বছর আগে উৎকলের সর্বময় কর্তা প্রভু জগন্নাথদেবের নবকলেবরের পটভূমিতে শ্রীক্ষেত্রে এসে সরকারি শিলমোহর মারা কাগজটিই সম্বল। এমনিতে সরকারি কর্তারা সর্বত্রই কিছুটা এক ধাঁচের। একই রকম রাশভারী। ব্যস্ত। তাঁদের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে জোগাড় করা সেই কাগজটার সৌজন্যেই তবু মন্দিরের সিংহদুয়ারের একেবারে সামনে অবধি আসতে পেরেছি। গোটা পুরীধামে কাছের-দূরের বিভিন্ন জনপদ থেকে আগত অগণিত ভক্ত অবশ্য কোনও পরিচয়পত্রের তোয়াক্কা করেন না। রথ দেখা হবে কি হবে না, রশি স্পর্শ করা হবে কি হবে না— সবই তো প্রভুর ইচ্ছে। সব কিছু জগন্নাথে সমর্পণ করে তাঁর ভরসাতেই ওঁরা এই প্রবল ভিড়ে ভিড়াক্কার শ্রীক্ষেত্রে পা রেখেছেন।
সমু্দ্রের ধারে খোলা প্রান্তরে বা অস্থায়ী শিবিরে বিনিদ্র রাত কাটিয়ে এই প্রাণঘাতী খর রোদে জগন্নাথের পথের আনাচ-কানাচের গলিঘুঁজিতে বড়জোর ব্যারিকেডের মুখটুকু অবধি আসতে পেরেছেন অনেকেই। সব আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে রথ ছাড়তে ছাড়তে বিকেল হবে জানা কথা! তবু একবারটি রথে প্রভুকে দর্শনের আশায় সকাল থেকেই বড় দাণ্ডের কিনারে হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন তাঁরা। জগন্নাথদেবকে রথে একবারটি দেখলেই যে জীবযন্ত্রণার ক্লেশ আর ভুগতে হবে না।
রথযাত্রা আসলে ভক্তের এই অতিমানব হয়ে ওঠার আখ্যান। ঈশ্বরের মন্দির ছেড়ে পথে আমভক্তের মাঝে প্রকট হওয়ার রূপকে লোকে কত রকমেরই না অর্থ খুঁজেছে। রথের রশি কী ভাবে জাতধর্ম নির্বিশেষে সবার-পরশে-পবিত্র হয়ে ওঠে তা নিয়ে সাহিত্য, লোকগাথা কম সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু ঈশ্বর নামক এক অজানা রোমাঞ্চের টানে মানুষের অনন্ত ধৈর্যের পরীক্ষাও কম কাব্যিক নয়। নবকলেবরের বছরে রথযাত্রায় প্রভু জগন্নাথ নতুন শরীরে সর্বসাধারণের জন্য প্রকট হবেন। তার আগের রাতে পুরীর সমুদ্রতীর জুড়ে ছোট-ছোট শিবির বা নবকলেবরগ্রামগুলি জুড়ে এক ব্যাখ্যাতীত আনন্দের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। রাতভর দলে দলে লোকে নামগান, কীর্তন করছেন, ঘুমের পরোয়া নেই। পরের দিন ভিড়ের স্রোতে ভেসে বড় দাণ্ডের দিকে ছিটকে যাওয়া। সারা দিন খিদেতেষ্টার ঠিক-ঠিকানা নেই। পুরীর রোদের তেজ আষাঢ়ে কোন পর্যায়ে পৌঁছয়, তা বলে বোঝানো যাবে না। ভাগ্যিস, কিছু স্বেচ্ছাসেবী জলসত্র খুলে বসেছিলেন। শরীরের আর্দ্রতার ভাগ বহাল রাখতে বড় দাণ্ডের এক-একটি মোড়ে লজেন্সও বিলি করছিলেন কোনও কোনও স্বেচ্ছাসেবী। আর চলছিল প্রভুর রথারোহণের সেই অনন্ত প্রতীক্ষা।
মন্দিরের একেবারে মুখটায় রথ তিনটির কাছাকাছি বড় দাণ্ডের অংশ ঘিরে রয়েছে বিরাট পুলিশবাহিনী। সেটাই ভিআইপি-জোন। তবে পুলিশ বা আইএএস অফিসার— রথের পুরীতে সকলেরই একটা পরিচয়। ভক্ত! প্রোবেশনারি পর্যায়ে থাকা তিন জন আইএএস অফিসার দেখি হাতে নারকোল নিয়ে তেতে-ওঠা কংক্রিটে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে। এমনিতে বিশৃঙ্খলা এড়াতে রথের সামনে নারকোল ফাটানো সে-বার নিষিদ্ধ। তবু আইএএস অফিসারদের জন্য খানিক ছাড় দেখি! জগন্নাথ রথে চড়লে রথের সামনে তাঁরা নারকোল ফাটাবেন।
জগন্নাথদেব রথে ওঠার কিছু পরে দুপুরের দিকটায় দেখি কী ভাবে কাঁচাপাকা চুলের এক ভারী মিষ্টি প্রৌঢ়া ওখানে ঢুকে পড়েছেন। মহিলার বাড়ি সম্ভবত টালিগঞ্জে। পুরীতে এসেছেন ভাইয়ের সঙ্গে। তা-ও রথের দিন ভয়ানক ভিড় হবে বলে ভাই আসল দিনেই হোটেল থেকে বেরোলেন না। অগত্যা দিদি একাই চলে এসেছেন। সকাল থেকে পাহুন্ডি শেষ হওয়ার পরে ভিআইপি-জোন-এর কড়াকড়ি একটু শিথিল হয়। পাহুন্ডি দর্শনের পরে মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য ভিআইপি-রা সার্কিট হাউজ়ে মধ্যাহ্নভোজ সারতে বা একটু বিশ্রাম নিতে যান। ঠিক তখনই মহিলা কোনওভাবে রথের কাছটিতে এসে হাজির। বিহ্বল হয়ে মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জগন্নাথের রথের নীচে তিনি ঢুকে পড়েছেন। আর তখনই রথের উপর থেকে পদ্মের পাপড়ি ঝরে ঝরে পড়ল। তাতে পুলকিত ভক্ত নারী কেঁদেকেটেঅ্যাকসা! আলাপ হতে নিজের সব কথা শুনিয়ে বললেন, ভাগ্যিস ঠাকুরের নাম করে চলে এসেছিলুম! এ বারের রথ আমায় শেখাল, কখনও কোনওকিছুর জন্য তিনি ছাড়া আর কারও উপরে ভরসা করব না।
ভক্তের সমর্পণের এই আবেগ মাথায় রেখেই পুরীর রথ ঘিরে অমানুষিক ধকল সয়ে উন্মাদনা দেখতে কিছুটা ভয়ই করছিল। নবকলেবরের সেই বছরেই দেখেছি, ক্ষণেক্ষণে ব্যারিকেডের ও পারে মানুষ গরম আর কষ্ট সহ্য করতে না-পেরে ঝপাঝপ মাটিতে পড়ছেন। স্বেচ্ছাসেবী বা পুলিশ ছুট্টে তাঁদের স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। জগন্নাথের পাহুন্ডি শুরু হওয়ার আগে থেকেই তবু মন্দিরের দিকে তাকিয়ে অদ্ভূত টান-টান উত্তেজনা। প্রথমে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার সঙ্গী কাঠের একটি দণ্ড বা সুদর্শনকে সুভদ্রার রথে তোলা হয়। তারপরে বোন সুভদ্রা, দাদা বলভদ্র এবং সব শেষে মহাতারকা জগন্নাথ রথ অভিমুখে যাবেন। নারীবেশী পুরুষের দল প্রভুর সামনে একনাগাড়ে অপরূপ গোটিপুয়া লোকনৃত্য পরিবেশন করে চলেছেন। এই গোটিপুয়া শিল্পীরাই সাধারণত পরে ওড়িশি নৃত্যকলা আয়ত্ত করেন। মনে আছে তখন ছবি তুলছিলেন নামী আলোকচিত্রশিল্পী রঘু রাই। দরদরিয়ে ঘামতে ঘামতে অসাধারণ এই নাচ অভিভূত হয়ে দেখছিলেন চিত্রশিল্পী যতীন দাশও। যিনি বললেন, ‘‘ভেতরে অসম্ভব আনন্দের অনুভব না-থাকলে এই কষ্ট সহ্য করা যায় না।’’
রথ ছাড়তে ছাড়তে অবধারিত বিকেল হবেই। পাহুন্ডির পরে পুরীর শঙ্করাচার্যের মতো ভিআইপি-রা রথেই প্রভুকে দর্শনের জন্য আসবেন। তারপরে মাঝদুপুরে ছেরা পহরা। সোনার ঝাড়ু নিয়ে পুরীর গজপতি রাজা পথ পরিষ্কার করবেন। এর পরে একে-একে ছাড়ে বলভদ্র, সুভদ্রা ও জগন্নাথের রথ। নির্দিষ্ট সময় কিছু নেই। সবই না কি জগন্নাথের ইচ্ছে। নবকলেবরের বছরে মনে আছে, সবার শেষে জগন্নাথের রথ ছাড়ার সময়ে বিকেল পাঁচটা বেজে গিয়েছে।
সন্ধের মুখে সে-বার রটেছিল, পদপিষ্ট হয়ে তিন জন না চার জন না কি মারা গিয়েছেন। কিন্তু কোথায় কত জন তখন তা নিশ্চিত জানার উপায় নেই। স্থানীয় টিভি-র খবরে কিছু জানা যাচ্ছে না। ফোনের নেটওয়ার্ক জ্যাম। ইন্টারনেট কাজ করছে না। এই উন্নত যোগাযোগের যুগেও পুরীকে দেখলে মনে হয় এখনও ১৯৭০-এ পড়ে রয়েছে। তাতে অবশ্য গুজবের দ্রুত সফর আটকায় না। তীব্র উৎকণ্ঠার মধ্যে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে রাতে ভুবনেশ্বরে ডিজি-কে ফোনে ধরতে পেয়ে মালুম হল, পদপিষ্ট কেউ হননি। তবে দিনভর যাঁরা অসুস্থ হচ্ছিলেন তাঁদের দু’জন মারা গিয়েছেন। জনৈক আইপিএস অফিসার বলে ওঠেন, প্রভু রক্ষা করেছেন।
পুরীর জগন্নাথের রথযাত্রা, কুম্ভমেলা, মুম্বইয়ের গণেশপুজো, বাংলার দুর্গোৎসব বা ইদের জমায়েত— যা-ই হোক না কেন, গুরুদায়িত্ব থেকে যায় দেশের প্রশাসনের ’পরে। তবে জগন্নাথের ৩৬৫ দিনই লীলাময়। রথে সেই লীলার সব থেকে বড় উৎসবমুখর প্রকাশ। যাবতীয় দায়ভার কাঁধে নিয়েও ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসনই কার্যত জগন্নাথের ইচ্ছেয় ভর দিয়ে সব কিছুর আয়োজন করে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy