কেঁড়াগাছিতে সীমান্ত-লাগোয়া হরিদাস ঠাকুরের মন্দির। নিজস্ব চিত্র
সন্ধ্যায় বাংলাদেশে কীর্তন হচ্ছে, নদীর ও পারে ভারতের মাটিতে তা শুনতে ভিড়। ভাবের ঘোরে দু’হাত তুলে নেচে চলেছেন দু’পারের মানুষ।
মাঝে বয়ে চলা নদীর নাম সোনাই।
গাঁয়ের যে কোনও দামাল ছেলে বুকে দম ভরে এক ডুবে পেরিয়ে যাবে এ পার থেকে ও পার। চলে যাবে এক দেশ থেকে অন্য একটা দেশেও।
ইচ্ছেবাঁকের এই সোনাই নদীই ভারত-বাংলাদেশকে আলাদা করেছে সাতক্ষীরার কলারোয়ার একটা বিস্তীর্ণ এলাকায়। উল্টো দিকে উত্তর ২৪ পরগনার হাকিমপুর। সোনাই পারের কেঁড়াগাছি গ্রাম হরিদাস ঠাকুরের জন্মস্থান। চৈতন্যদেবের সহচর এই বৈষ্ণব গুরুর স্মরণে সে দিন সকাল থেকে সেখানে ধর্মীয় আলোচনা, সংকীর্তন। রাতে ম্যারাপ বেঁধে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আর তা শুনতে ছেলে-বুড়ো ভিড় জমিয়েছেন সোনাইয়ের ও পারে, ভারতের দিকে। মাইকে কীর্তনের সুরে তাঁরাও নাচছেন দু’হাত ছড়িয়ে।
দখল হয়ে যাওয়া পুূণ্যভূমি লড়াইয়ে আদায় করে সেখানে ‘হরিদাস ঠাকুর জন্মভিটা আশ্রম’ গড়ে তোলা সে এক অন্য কাহিনি। এলাকার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কোমর কষে লড়েছেন সেই কঠিন লড়াই। আশ্রমের সভাপতি কার্তিকচন্দ্র মিত্র জানালেন, সকাল থেকে সোনাই পেরিয়ে অন্তত হাজার পাঁচেক ভারতীয় এসেছেন, নামগান শুনেছেন, সূর্য পাটে বসার ক্ষণে ফিরে গিয়েছেন নিজের দেশে। রাইফেল কাঁধে বিজিবি যেমন পাহারায় রয়েছে, ঘাটে বাঁধা রয়েছে পারাপারের শালতি নৌকোও।
ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা বলছেন, লালগোলা-রাজশাহি ও তার পাশের ভগবানগোলা-চাঁপাই সীমান্তের মতোই চোরাচালানের মুক্তাঞ্চল এই হাকিমপুর-সাতক্ষীরা সীমান্ত। দু’দেশের জঙ্গিদের যাতায়াতের করিডরও। খাগড়াগড়ে তৈরি হওয়া শক্তিশালী সকেট বোমার একটা অংশ এই পথেই বাংলাদেশে ঢুকেছে বলছে এনআইএ। আবার খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পরে জঙ্গি-জালের কয়েক জন চাঁই এই সীমান্ত দিয়েই বাংলাদেশে ঢুকে গা-ঢাকা দিয়েছে বলে তাদের অনুমান। ভারত থেকে মাথায় করে নুন আর রসুনের বস্তা পাচার করে চোরাচালানিরা। অভিযোগ, সেই বস্তার অনেকগুলোতেই ভরা থাকে ফেনসিডিলের শিশি থেকে হেরোইনের মোড়ক, এমনকী পিস্তল-বিস্ফোরকও।
হরিদাস ঠাকুরের প্রেমের বাণীতে যে পাচারকারীরা মজেনি, তা বোধ হয় বোঝেননি সাতক্ষীরার ভোমরায় মোতায়েন বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি-র কম্যান্ডার নজরুল ইসলাম। খাগড়াগড় কাণ্ডের পর কড়া পাহারার নির্দেশই দিয়েছিলেন তিনি। ভোর রাতে কিছু ‘খবর’ পেয়ে সপ্তাহ খানেক আগে মাত্র এক জন সিপাহি নিয়েই লক্ষ্মীদাঁড়ি গিয়ে চোরাচালানিদের চ্যালেঞ্জ করেন। পাল্টা মারে জান খোয়াতে হয়েছে নজরুলকে।
কলারোয়ার প্রবীণ বাসিন্দা আরিফ মিয়াঁ তাই বলেন, “বিজিবি-কে ভরসা নেই বড়ভাই, পারলে আপনাগো বিএসএফ-ই পারবা।”
রাজশাহি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ কানসাটের মতো সাতক্ষীরাতেও শেকড় গেড়ে রয়েছে জামাতে ইসলামির বটগাছ। সাতক্ষীরা শহরে সদর রাস্তার গায়েই তাদের দফতর। শেখ হাসিনার সরকার একাত্তরে পাক বাহিনীর সহচরদের বিচার শুরুর পরে গোটা বাংলাদেশে জামাত যে ভয়ানক সন্ত্রাস চালায়, তাতে সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সাতক্ষীরার। তার পরে র্যাব ও পুলিশকে অভিযান চালাতে হয় সশস্ত্র জামাত ক্যাডারদের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ ঢোকার পরে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসে তাদের দিকে বলছিলেন সেই অভিযানে থাকা এক পুলিশ অফিসার। তাঁর কথায়, “সাতক্ষীরার সীমান্ত-সংলগ্ন একটা বিস্তীর্ণ এলাকা বাংলাদেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। পুলিশকে রুখতে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার গাছ কেটে ফেলে রাখা হয় রাস্তায়। পুলিশ প্রথমে জামাতের শক্তি ও অস্ত্রভাণ্ডারের বিষয়ে কোনও ধারণা করতে পারেনি।” ওই পুলিশ কর্তা জানান, অভিযানের পর ধরা পড়া জঙ্গি-দুষ্কৃতীদের জেরা করে জানা যায়, সীমান্তের ও পার থেকে বিপুল অস্ত্র ও বিস্ফোরক এসেছে সাতক্ষীরায়।
শুধু কি অস্ত্র-বিস্ফোরক? জামাত-বিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন)-এর এক অফিসারের দাবি জেহাদের নামে ভারতের কয়েকটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রদেরও নিয়ে এসেছিল মৌলবাদীরা। তাদের হাতে বোমা-বন্দুক দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামানো হয়েছিল।
কী প্রমাণ যে তারা বাংলাদেশের নাগরিক নয়?
র্যাবের ওই কর্তা বলেন, “মাস খানেক ধরে অভিযান চলেছে। আমাদের হিসেবে ওদের ক্যাজুয়ালটি-র সংখ্যা খুব একটা কম নয়! কিন্তু জামাত তাদের মাত্র পাঁচ জন কর্মী মারা যাওয়ার খবর স্বীকার করেছে।” অর্থবোধক হাসি তাঁর মুখে, “তবে কি বাকিরা পশ্চিমবঙ্গের কিছু এতিমখানা (অনাথ আশ্রম)-র ছাত্র, যাদের জেহাদের নামে লড়তে পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশে?” শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ওই র্যাব-কর্তার দাবি তাঁদের হাতে ধরা পড়া বহু জঙ্গি বাংলা ভাষাই বুঝতো না। তারা সম্ভবত বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা।
সাতক্ষীরার তালা-কলারোয়া আসনের সাংসদ মুস্তাফা লুৎফুল্লার অভিযোগ, এই এলাকা থেকে তাড়া খেয়ে পালানো বহু মৌলবাদী সীমান্তের ও পারে নানা জায়গায় ডেরা গেড়ে রয়েছে। মাসের পর মাস তারা সেখানে বসবাস করছে, অনেকে পশ্চিমবঙ্গের রেশনকার্ডও করিয়ে নিয়েছে। কেউ কেউ ভারতের বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজকর্ম করছে বলেও স্বজনরা জানিয়েছেন।
সাতক্ষীরায় জঙ্গিদের অন্যতম প্রধান সংগঠক জিয়া আফগানি। আফগানিস্তানে তালিবানের হয়ে সোভিয়েত সেনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কৃতিত্ব নিতেই আফগানি পদবি নিয়েছে এই জঙ্গি, জানালেন এক পুলিশ অফিসার। আল কায়দা ও তালিবানের সঙ্গে নিজের যোগাযোগও জাহির করে এই জিয়া। কয়েক মাস আগে তার খোঁজখবর করতে গিয়ে পুলিশ জেনেছে, বছর খানেক ধরে বেনামে পশ্চিমবঙ্গে ডেরা বেঁধে নতুন কোনও দায়িত্ব পালন করছে এই জিয়া আফগানি।
সে দায়িত্ব কি সন্ত্রাসের নতুন মডিউল গড়ে তোলা?
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy