সাতের দশকে চারু মজুমদার অনুপ্রাণিত কলকাতার দেওয়ালে লেখা হয়েছিল, ‘চিনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান।’ ১৫ অগস্টের সকালে লালকেল্লার দেওয়ালে নরেন্দ্র মোদী যেন লিখে দিয়েছেন, ‘চিনের সংস্কার, আমাদের সংস্কার।’
যোজনা কমিশনের জায়গায় যে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরির কথা ভাবছে মোদী সরকার, তার গায়ে ‘মেড ইন চায়না’র ছাপই দেখা যাবে বলে দিল্লি দরবারের খবর। অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নে নতুন চিন্তাভাবনার জোগান দেওয়ার জন্য মোদীর ভাবনায় রয়েছে চিনের ‘জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশন’-এর আদল।
শুধু ‘সংস্কার কমিশন’ নয়। মোদী সরকার আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে চিনের সাফল্য অনুকরণ করতে চাইছেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই চিন সফরে গিয়েছিলেন। সে সময় চিনের জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনের কর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছিল তাঁর। মোদীর ঘনিষ্ঠ মহল মনে করে, সে সময়ই চিনের অনুকরণীয় পদক্ষেপগুলি নোটবুকে লিখে এনেছিলেন তিনি। গুজরাতে তার কিছু নিদর্শন ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে দেশ গড়ার কাজেও এ বার সেই পথে হাঁটছেন মোদী। চিনের মতোই ভারতে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’ তৈরির স্বপ্ন যার অন্যতম। যেখানে দেশীয় সংস্থা ছাড়াও বহুজাতিক সংস্থাগুলিও এসে পণ্য উৎপাদন করবে।
মজার কথা হল, নরেন্দ্র মোদী শুধু চিনের অনুকরণই করছেন না। কিছু ক্ষেত্রে চিনের সাহায্য নিচ্ছেন। আবার চিনের সঙ্গেই টক্কর দিতে চাইছেন। সরকারি সূত্র বলছে, চিনের আদলে যে উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশন তৈরি করতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী, তার অন্যতম কাজ হবে এই জাপান, কোরিয়া, এমনকী চিনের সংস্থাগুলিকেও বুঝিয়ে এ দেশে কারখানা তৈরির জন্য ডেকে নিয়ে আসা। সেই স্বপ্ন সাকার করার ডাক দিয়েই স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে মোদী বলেছেন, ‘আসুন, ভারতে পণ্য তৈরি করুন। বিশ্বের যে কোনও দেশ সেই পণ্য তৈরি করুক। কিন্তু এখানে তৈরি করুক।’ অর্থাৎ পৃথিবীর যে কোনও দেশের বাজারে এ বার ‘মেড ইন চায়না’র মতোই ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ ছাপ দেখতে চান মোদী।
অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি মানছেন, চিনের আসল শক্তি হল, সস্তার পণ্য উৎপাদন। সুতরাং তিনি বলেই দিচ্ছেন, “ভারতীয় পণ্যকে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলেও সস্তায় সুদ, নিচু হারে কর, বিশ্বমানের পরিকাঠামো, কম দামে বিদ্যুৎ, দ্রুত ছাড়পত্র এবং শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বাধীনতার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।”
ক্ষমতায় আসার এক মাসের মাথাতেই মোদীর মন্ত্রিসভা এ দেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরির জন্য চিনের সঙ্গে সমঝোতা-চুক্তিতে সিলমোহর বসিয়েছে। সস্তায় পণ্য তৈরির জন্য এ দেশেই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হবে। সেখানে বিনিয়োগ করবে চিন। অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “সস্তায় পণ্য উৎপাদনের পিছনে চিনের সবথেকে বড় শক্তি ছিল কম বেতনের শ্রমিক। কিন্তু এখন চিনেও শ্রমিকদের পিছনে খরচ বাড়ছে। নতুন সরকার তার ফায়দা তুলতে চায়। তাই শ্রম আইনের সংশোধন হয়েছে।”
শিল্প ও প্রশাসনিক মহল অবশ্য মনে করে, আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে চিনের অনুকরণ করতে পারে মোদী সরকার। কী রকম?
সরকারের বহর কমানোর কথাই ধরা যাক। চিনের জনসংখ্যা ১৩৫ কোটি। সরকারে মন্ত্রক রয়েছে ২২টি। ভারতের জনসংখ্যা চিনের থেকে ১২ কোটি কম হলেও মন্ত্রকের সংখ্যা চিনের থেকে ২৯টি বেশি। শিল্প মহলের সুপারিশ ছিল, মন্ত্রকের সংখ্যা কমানো হোক। রেল, বিমান, সড়ক পরিবহণ, জল পরিবহণের মতো মন্ত্রকগুলি মিশিয়ে দেওয়া হোক। বিদ্যুৎ মন্ত্রকের সঙ্গে কয়লা বা অপ্রচলিত শক্তি মন্ত্রক মিশে যাক। অনাবাসী মন্ত্রক বা ক্রীড়া ও যুব কল্যাণের অপ্রাসঙ্গিক মন্ত্রক বিলুপ্ত হোক। এই সব মন্ত্রক ছাঁটা হলে সরকারের ব্যয়ভার কমবে। লাল ফিতের ফাঁসও কাটবে।
নরেন্দ্র মোদী এখনও অবধি একই মন্ত্রীকে একাধিক মন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়েছেন। বিভিন্ন মন্ত্রকের মধ্যে বার্লিন-প্রাচীর ভাঙার কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু কোনও মন্ত্রক একেবারে তুলে দেননি। মন্ত্রকের সংখ্যা কমিয়ে মোদী কবে ‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট’-এর পথে হাঁটবেন, অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
চিনে কে মন্ত্রী হবেন, সরকারের উচ্চপদে কে বসবেন সে বিষয়ে পাণ্ডিত্য ও নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষতাই শেষ মাপকাঠি। পরিসংখ্যান বলছে, চিনের মন্ত্রিসভা বা সরকারি পদে যত জন ডক্টরেট রয়েছেন, আর কোনও দেশে তা নেই। মোদীর সরকারে পিএইচডি ডিগ্রিধারীর সংখ্যা মাত্র এক জন। মনমোহন মন্ত্রিসভায় দু’জন ডক্টরেট ছিলেন। মোদী সরকারের শিক্ষামন্ত্রী স্মৃতি ইরানির শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নিদেনপক্ষে স্নাতক না হয়েও স্মৃতি কী ভাবে শিক্ষামন্ত্রীর গদিতে বসেন, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা মেনে যে দেশে মন্ত্রী বাছাই করতে হয়, সেখানে মোদী শেষ পর্যন্ত বেজিংকে কতটা অনুসরণ করতে পারেন, সেটাই দেখার।
শিল্পমহল বলছে, সরকারি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সংস্কারের কাজটা করাটাও মোদীর পক্ষে একেবারেই কঠিন নয়। এ দেশে মাটির তলায় যত কয়লা রয়েছে, তার মালিকানা কয়লা মন্ত্রকের। কাকে কোথায় কয়লা খননের সুযোগ দেওয়া হবে, তা ঠিক করে মন্ত্রক। আবার মন্ত্রক নিজেই কোল ইন্ডিয়া চালায়। বিমান মন্ত্রক নিজে এয়ার ইন্ডিয়া চালায়। আবার অন্যান্য বিমান সংস্থার জন্য তারাই নীতি তৈরি করে। অর্থাৎ মন্ত্রক একাধারে নিজেই প্রতিযোগী, নিজেই নীতি নির্ধারক। কিন্তু এ দু’টি সম্পূর্ণ পৃথক করতে না পারলে নীতি নির্ধারণ কখনও পক্ষপাতশূন্য ও নৈর্ব্যক্তিক হতে পারে না। চিনে এই ব্যবস্থাটা সফল ভাবে রূপায়িত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদীও এ দেশে সেই ভাবনা বাস্তবায়িত করতে পারেন।
কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রেও চিনকে অনুকরণ করা যেতে পারে বলে কৃষি মন্ত্রকের অনেকের মত। শুধু ধানের ক্ষেত্রেই তুলনা করলে, চিনের হেক্টর প্রতি ধান উৎপাদন ভারতের তুলনায় দ্বিগুণ। ফলে ভারতের থেকে অনেক কম জমিতে ধান চাষ করেও বেশি ধান উৎপাদন করে চিন। কারণ ষাটের দশক থেকেই ধানে হাইব্রিড বীজ ব্যবহার শুরু করেছে চিন। ভারত এখনও সেই ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy