মায়াবতী ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী এ বার খুব চেষ্টা করছেন। ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা গেল কুপোকাত মায়াবতীর হাতি। পরাস্ত খোদ মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব। অন্য দিকে কোনও মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী ছাড়াই বিজেপি স্রেফ নরেন্দ্র মোদীর ‘মুখ’ দেখিয়ে লখনউয়ের তখ্ত দখল করল ঐতিহাসিক ভাবে। অবিভক্ত উত্তরপ্রদেশে ’৮০ সালে কংগ্রেস ৩০৯টি আসন পেয়েছিল। একা দলের তিনশো পেরনোর গল্প সেখানেই শেষ। ৩৭ বছর পরে আবার ৩০০-এর বেড়া টপকে লখনউয়ের কুর্সি দখল করল কংগ্রেসের প্রধান জাতীয় প্রতিপক্ষ। বোনাস হিসেবে উত্তরাখণ্ডেও মিলল নিরঙ্কুশ জয়।
উত্তরপ্রদেশের এই বিপুল জয় আসলে বিজেপির নয়, নরেন্দ্র মোদীর। প্রচার যত এগিয়েছে, তাঁর ভূমিকা তত বেড়েছে। উত্তরপ্রদেশে এ বার মোট ২৪টি জনসভা করেছেন তিনি। এবং ফলাফল প্রমাণ করছে, ২০১৪ সালের মোদী ঝড় এখনও থামেনি। ব্র্যান্ড মোদী বা ‘মোদীত্ব’ নামক কড়াপাক এখনও সফল। এই কড়াপাকের উপাদান কী ছিল?
প্রথমত, নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে বিরোধী ও বিদ্বজ্জনদের যত আপত্তিই থাক, মোদী জনসাধারণের কাছে এটা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন যে, তিনি কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। এবং গরিবের বন্ধু হোন বা হোন, তিনি আমিরির বিরোধী। দ্বিতীয়ত, কোনও প্রতিষ্ঠিত অভিজাত রাজনৈতিক নেতার উত্তরাধিকারী নন তিনি, অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি— এই বার্তা সচেতন ভাবে প্রচার করে মোদী শিবির অখিলেশ-রাহুলের উত্তরাধিকারের রাজনীতির বিরোধিতা করেছিল। তৃতীয়ত, ২০১৪-এর তুলনায় এ বার মেরুকরণের রাজনীতিতেও নতুন কৌশল ছিল। ওবিসি এবং দলিতদের বিভিন্ন অংশকে হিন্দুত্বের ছাতার নীচে নিয়ে আসার কৌশল কাজে লাগিয়ে মোদী নিজেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন দলিত আশ্রমে গিয়ে, বাল্মীকি মন্দিরে পুজো দিয়ে দলিত নেত্রী মায়াবতীর ভোট ব্যাঙ্কেও থাবা বসিয়েছেন। এবং উন্নয়নের স্লোগানকে মিশিয়ে দিয়েছেন এই হিন্দুত্বের সঙ্গে।
আরও পড়ুন: অমিতের কৌশলেই বিপুল জয়
পাশাপাশি, মুসলিম ভোট থেকেও বঞ্চিত হয়নি বিজেপি। গোটা রাজ্যে এক জনও মুসলিম প্রার্থী দাঁড় না করিয়ে। দলের নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়র দাবি, অন্তত ১০ শতাংশ সংখ্যালঘু বিজেপি-কে ভোট দিয়েছেন। যার প্রভাব পড়েছে ২৫টি আসনে। বিজেপি নেতাদের মতে, সংখ্যালঘুরা এ বার একজোট হয়ে ভোট দেননি। মোদী-অমিত শাহের কৌশলে তাঁদের ভোটের একটা অংশ বিজেপি এবং বিএসপি-র মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে।
জিতেছে দল। আনন্দে মাতোয়ারা বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা। শনিবার উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরে। ছবি: পিটিআই।
মোদীর এই জয় দল ও সরকারের মধ্যে তাঁর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করল। এ বছরের মধ্যে রাজ্যসভায় আসন ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার সুযোগ পেল বিজেপি। জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ঐকমত্যের পথে না গিয়ে নিজস্ব প্রার্থী দেওয়ার মনস্তাত্ত্বিক বল পেল দল। এই হাওয়া অক্ষত রেখে বছরের শেষে গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনেও জয়ের জন্য ঝাঁপাবেন অমিত শাহ।
হতাশ বিরোধী কংগ্রেস নেতারা অবশ্য প্রশ্ন তুলছেন, ২০১৪ সালের ঝড় যদি গোটা দেশে অটুট থাকত, তা হলে কি পঞ্জাবে অকালি-বিরোধী তীব্র হাওয়াকে ৫৬ ইঞ্চি ছাতি দিয়ে মোদী আটকাতে পারতেন না? গোয়া-মণিপুরেও কি ত্রিশঙ্কুর পরিবর্তে স্পষ্ট দিক্নির্দেশ দেখা যেত না? তবে কি এটি আসলে সামগ্রিক ভারতের চিত্র নয়? শুধু উত্তরাপথ দখলের সাফল্য? পাল্টা যুক্তি দিয়ে বিজেপির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নোট বাতিলের পর কেন্দ্রে তিন বছরের শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তো দূরের কথা, মোদী আস্থা অর্জন করেছেন বেশি। প্রকৃতির নিয়মে মসিহার ভূমিকায় হয়তো সামান্য ফাটল ধরেছে, ২০১৪ লোকসভার তুলনায় এই নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত হয়তো সামান্য কমেছে, কিন্তু বড় ছবিটা তাতে কিছুই পাল্টায়নি। তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন, মোদীর বিরুদ্ধে বিকল্প কোনও উন্নয়নের মডেল কি অখিলেশ-রাহুল তুলে ধরতে পেরেছেন? দুই যুব নেতৃত্ব নবীন প্রজন্মকে চাকরির স্বপ্ন দেখিয়েছেন। উন্নয়নের স্লোগান দিয়েছেন। কিন্তু রাজ্য স্তরে মুলায়মের গুন্ডা-গর্দির স্মৃতি বারংবার উস্কে দিয়েছেন মোদী, তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে। বিজেপির এক শীর্ষ নেতা বললেন, ‘‘বাজপেয়ীর বাগ্মিতা ছিল। মোদীজির দক্ষতা হলো তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাস্তববোধ।’’
ঘটনা হলো, ভোটের উত্তরপ্রদেশে যে শুধু মোদীর ভাষণ শুনতেই মানুষের ঢল নেমেছিল এমন নয়। ভিড় উপচে পড়েছিল অখিলেশ-রাহুলের সভাতেও। কিন্তু যাঁরা এলেন, তাঁরা কেন ভোট দিলেন না, সেটা যে তাঁর মাথায় ঢুকছে না, সে কথা আজ কবুল করেছেন অখিলেশ। কিন্তু ইতিহাস বলে এমন ঘটনা নতুন নয়। পশ্চিমবঙ্গে একদা একের পর এক নির্বাচনী সভায় ঝড় তুলেছিলেন রাজীব গাঁধী। ভিড়ের বহর দেখে জ্যোতি বসুকে অবসর নেওয়ার পরামর্শ পর্যন্ত দিয়ে বসেছিলেন তিনি। ভোটের ফলে কিন্তু বিপুল ভোটে জিতেছিল সিপিএম। একই অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০১ সালে ‘হয় এ বার নয় নেভার’-এর ভোটে হেরে তিনি খেদোক্তি করেছিলেন, মানুষকে বুঝতে এত ভুল করলাম!
আসলে শতকরা হিসেবে ভোটপ্রাপ্তি আর আসন জয় ভারতের রাজনীতিতে এক চিরকালীন ধাঁধা। ২০১২ সালে সপা পেয়েছিল ২৯.৫ শতাংশ ভোট। তাদের আসন সংখ্যা ছিল ২২৪। এ বার কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে তাদের ভোটের হার মোটামুটি তার কাছাকাছিই— ২৮.৪%। কিন্তু মিলিত আসন কমে হয়েছে মাত্র ৫৪।
ভোটের শতাংশ আর আসন সংখ্যার মেলবন্ধন ঘটিয়ে আপাতত ভারতের রাজনীতিতে কার্যত এক অবতারে পরিণত হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। অবতারের প্রতি মানুষের যখন আস্থা থাকে, তখন যুক্তির চেয়েও ভক্তি অনেক বড় বিষয় হয়ে ওঠে। এমনটাই মনে করে সঙ্ঘ পরিবারও। সঙ্ঘ নেতারা তাই বলছেন, উত্তরপ্রদেশের ভোটারেরা এই ভক্তি প্রদর্শন করেছেন। অমিত শাহ বলেছেন, ‘‘ভোটাররা মোদী সরকারের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন।’’
বিজেপির কৌশল এ বার সেই ভক্তি-শ্রদ্ধাকে কাজে লাগিয়ে ২০১৯ সালের যাত্রাপথ মসৃণ করে তোলা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy