পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ চাপে সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সরতাজ আজিজ বাধ্য হয়েছেন, উফা-বৈঠকের পরে নেতিবাচক কথাবার্তা বলতে। ফলে তাকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে মোদী-শরিফ বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিটিকেই পাথেয় করে এগোতে চাইছে নয়াদিল্লি। আজ সরকারি সূত্রে এ কথা জানানো হয়েছে।
গতকাল সরতাজ-বোমার ফলে যে সার্বিক নেতিবাচক আবহাওয়া তৈরি হয়েছে তা দূর করতে কেন্দ্রে সক্রিয় হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘ বিদেশ সফর শেষ করে আজ ভোরবেলা নয়াদিল্লির টারম্যাকে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সক্রিয় হয়েছে তাঁর দফতর। সরকারি শীর্ষ সূত্র আজ জানাচ্ছে, পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সরতাজ আজিজের মন্তব্য নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং নওয়াজ শরিফ উফা-বৈঠকে যা আলোচনা করেছেন তার সারসংক্ষেপ নিয়েই তৈরি করা হয়েছে যৌথ বিবৃতি। সেই বিবৃতিতে সিলমোহর রয়েছে বিদেশসচিব এস জয়শঙ্করের পাশাপাশি পাক বিদেশসচিবেরও। ফলে সেটাই দু’দেশের ভবিষ্যতের এক এবং একমাত্র দিকনির্দেশিকা। যা কিনা পাকিস্তান সরকারের একটি নথিও বটে।
গতকাল সাংবাদিক সম্মেলন করে সরতাজ যা বলেছেন, তা তাঁদের ঘরোয়া রাজনৈতিক চাপের মোকাবিলা করার জন্য বলেই মনে করছে সাউথ ব্লক। এক কর্তার কথায়: ‘‘সরতাজ যা করেছেন তাকে মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ বলা যেতে পারে। অর্থাৎ, কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সাবেক অবস্থানের সঙ্গে উফা বৈঠকের কিছু অংশ মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত ঘরের চাপের মুখে এমনটা করতে হচ্ছে তাঁকে। অথচ যে কোনও বকেয়া বিষয় নিয়ে আলোচনার কথা তো যৌথ বিবৃতিতে রয়েছেই। তা তো কেউ আটকাচ্ছে না!’’ ভারতীয় সূত্রে জানাচ্ছে, যৌথ বিবৃতিকে নস্যাৎ করে কোনও সরকারি বার্তা ইসলামাবাদের কাছ থেকে নয়াদিল্লির কাছে আসেনি। নয়াদিল্লি তাই চাইছে, ‘যত দ্রুত সম্ভব’ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের আলোচনা শুরু করতে।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য মনে করছেন, উফা বৈঠকের পর আলোচনার ভবিষ্যৎ পুরোপুরি ভেস্তে না গেলেও, বিষয়টিতে খুব সহজেই অগ্রগতি ঘটবে এমনটাও নয়। এক কথায়, বল এখন পুরোপুরি ইসলামাবাদের কোর্টে। যে যৌথ বিবৃতিটিতে পাকিস্তান সই করেছে তাতে ‘কাশ্মীর’ শব্দটিই নেই। সাম্প্রতিক অতীতে এমন ঘটনা এই প্রথম। তাই এটা খুবই স্বাভাবিক যে, এই যৌথ বিবৃতিটি পাকিস্তানের সেনা, আইএসআই এবং মোল্লাতান্ত্রিক সংগঠনগুলি সহজে মেনে নেবে না। বিবৃতিতে মুম্বই বিস্ফোরণের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির কথা রয়েছে, সন্ত্রাস দমনের যৌথ অংশীদারিত্বের কথা রয়েছে, কিন্তু বালুচিস্তানের উল্লেখ করা হয়নি। সমঝোতা এক্সপ্রেসও নয়। নিঃসন্দেহে ভারতের জন্য এই অস্বস্তিকর বিষয়গুলি বিবৃতিতে না রাখা—নয়াদিল্লির একটি বড় কূটনৈতিক জয়। সবসময়েই ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যৌথ বিবৃতি নিয়ে দরকষাকষি এমন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছয় যে বৈঠকের পর ৪৮ ঘণ্টা কেটে যায়, কিন্তু বিবৃতিতে একটা-আধটা শব্দ বদল নিয়ে চলে তুল্যমূল্য লড়াই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মোদী-শরিফের বৈঠক শেষ হওয়ার ৪০ মিনিটের মধ্যে, করিডরে বসেই দু’দেশের বিদেশসচিব যৌথ নথি তৈরি করে ফেলেছেন, তা-ও আবার মূলত ভারতের উদ্বেগগুলিকে গুরুত্ব দিয়েই। স্বাভাবিক ভাবেই সাউথ ব্লক এটা জানত যে এই বিবৃতিটি নওয়াজ শরিফের সদিচ্ছাকে প্রতিফলিত করলেও সে দেশের ক্ষমতাকেন্দ্রগুলি একে সহজে মেনে নেবে না। তাই সরতাজের গতকালের রূঢ়ভাষণ নয়াদিল্লিকে আশ্চর্য করেনি।
বিবৃতিতে বলা আছে ‘শান্তি এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে, ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ের যৌথ দায়িত্ব রয়েছে। আর সেই লক্ষ্যে সমস্ত বকেয়া বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে তারা প্রস্তুত।’’ নয়াদিল্লির ব্যাখ্যা, সমস্ত বকেয়া বিষয়ের মধ্যে কাশ্মীরও পড়ে। ফলে আলাদা করে কাশ্মীর প্রসঙ্গ রাখার প্রয়োজন হয়নি। মোদী-শরিফ বৈঠকে তিনটি স্তরে আলোচনা শুরু হওয়ার কথা হয়েছে। এক, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, দুই, সীমান্তরক্ষী এবং তিন, ডিজিএমও। কেন্দ্রীয় সূত্রের বক্তব্য, সরতাজ আজিজ তাঁর দেশের অভ্যন্তরীণ অসন্তোষকে ঠান্ডা করার জন্য ভারত বিরোধিতার তাস খেলতেই পারেন, কিন্তু তবুও তিনি গতকাল এমন কিছু বলেননি যাতে এই তিনটি পর্যায়ের আলোচনা ভেস্তে যেতে পারে। তিনি এমনটা কখনওই বলেননি যে শীর্ষ পর্যায়ে যা স্থির হয়েছে তা অমান্য করে তাঁরা এই বৈঠকগুলি বয়কট করলেন!
যৌথ বিবৃতিতে আরও যে দু’টি বিষয় রয়েছে তার মধ্যে একটি উত্থাপন করেছেন মোদী, অন্যটি নওয়াজ। সূত্রের খবর, বৈঠকে মোদী শরিফকে বলেন, দু’দেশের দরিদ্র মৎস্যজীবীরা বিবেচনার ভুলে বা অন্য কারণে একে অন্যের জলসীমা লঙ্ঘন করেছেন। মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া উচিত। শরিফ এক কথায় বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক পর্যটনের প্রস্তাবটি এসেছে নওয়াজের পক্ষ থেকে। সন্ত্রাস প্রসঙ্গে জাকিউর রহমান লকভিকে নিয়ে বেশ কিছু ক্ষণ আলোচনা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। মোদী শরিফকে বলেন, লকভিকে ছে়ড়ে দেওয়ার বিষয়টি ভারতের সাধারণ মানুষের আবেগের সঙ্গে যুক্ত। লকভিকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হলে পাকিস্তান সম্পর্কে ভারতের জনমত অনেকটাই পাল্টে যাবে। পারস্পরিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, দু’দেশের মানুষের মধ্যে আদানপ্রদান, পর্যটন— সব ক্ষেত্রেই যার প্রভাব পড়তে বাধ্য। সাউথ ব্লকের বক্তব্য, নওয়াজ শরিফ নিজে রাজনীতিবিদ। পারভেজ মুশারফের মতো ফৌজি নন। ফলে, জনমত বিষয়টির গুরুত্ব তিনি বুঝতে পারবেন এমনটাই আশা করছে নয়াদিল্লি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy