ডি ভোটার (সন্দেহজনক ভোটার) ধরপাকড় নিয়ে ফের উত্তাল হল অসম বিধানসভা। অসম গণ পরিষদ ছাড়া সব দলের বিধায়ক এ সব ঘটনার প্রতিবাদ করেন। সরব ছিল এআইইউডিএফ। কংগ্রেস ও বিজেপি বিধায়করা মূলত বাঙালি-অবাঙালিতেই বিভাজিত ছিলেন। দু’দলের বঙ্গভাষী বিধায়করা যখন একযোগে কথা বলছেন, তখন অন্যরা কার্যত নীরবই ছিলেন।
বিজেপির দিলীপকুমার পাল জানতে চান— অসমে বাঙালি হয়ে জন্মানো কি অপরাধ? একতরফা রায় হবে, কাগজপত্র দেখানোর সুযোগ মিলবে না! ১০২ বছরের রেপতী দাসের কথা আজও টেনে আনেন সিদ্দেক। ধৃত বৃদ্ধকে স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে উল্লেখ করে তিনি আক্ষেপ করেন, স্বাধীনতা দিবসে আগামী কাল তাঁকে জেলেই কাটাতে হবে! তাঁর কাছে যে ভারতের নাগরিকত্ব প্রমাণের সমস্ত কাগজ রয়েছে, সিদ্দেক সে কথাও উল্লেখ করেন।
বিজেপি শিবিরে শিলচরের বিধায়ক দিলীপবাবু একাই এই বিষয়ে হইচই করেন। তাঁর সঙ্গীরা তখন টুঁ শব্দটিও করেননি। সিদ্দেক আহমদ, অর্ধেন্দু দে-র মতো কংগ্রেস বিধায়ক, প্রাক্তন মন্ত্রীরা যখন সর্বোচ্চ আদালতে হলফনামা পেশ ও পরিষদীয় কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন, তখন কংগ্রেস সরকার সরাসরি সে সব প্রস্তাব খারিজ করে দেয়।
এনআরসি সংশোধনের সময় ডি ভোটারদের ধরপাকড় বন্ধ রাখার আর্জি জানিয়ে হলফনামা পেশ প্রসঙ্গে মন্ত্রী রকিবুল হোসেন স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তাঁদের এমন কোনও চিন্তাভাবনা নেই। এআইইউডিএফ বিধায়করা চেপে ধরলে তিনি তাঁদেরই হলফনামা বা পাল্টা মামলা করতে বলেন। তবে কোনও প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক যদি নথি সংগ্রহে বিপাকে পড়েন, তবে সরকার তাঁকে সেই নথি পেতে সব রকম সাহায্য করবে বলে রকিবুল ঘোষণা করেন।
দক্ষিণ করিমগঞ্জের কংগ্রেস বিধায়ক সিদ্দেক আহমদ বলেন, ‘‘ডিটেনশন ক্যাম্পের নামে ধৃত ডি ভোটারদের অন্য বন্দিদের সঙ্গেই জেলে রাখা হচ্ছে। এমনিতেই জেলে স্থান সঙ্কুলান হয় না। তার উপর ডি ভোটারদের প্রতি দিন ধরে ধরে জেলে ঢোকানোয় সেখানে অবর্ণনীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’’ তাঁর কথার রেশ ধরেই একটি পরিষদীয় দল পাঠিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পগুলির অবস্থা দেখে আসার প্রস্তাব রেখেছিলেন বঙ্গভাষী বিধায়করা। স্পিকার প্রণব গগৈ তা খারিজ করে দেন। তবে মন্ত্রী রকিবুল হোসেন বলেন, ‘‘সরকার জেলগুলির অবস্থা খতিয়ে দেখবে।’’
হলফনামা পেশ বা পরিষদীয় কমিটি গঠনের দাবিতে অগপ বিধায়করা একযোগে প্রতিবাদ করেন। তাঁদের যু্ক্তি— ওই সব করলে বিদেশি বিতাড়ন প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাবে। সুবিধা মিলবে বিদেশিদের। ধৃতদের নাগরিকত্বের কাগজপত্র থাকলে আইনি প্রক্রিয়াতেই সে সব দেখাতে হবে। হোজাইয়ের কংগ্রেস বিধায়ক অর্ধেন্দু দে ও উত্তর করিমগঞ্জের কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ অধিবেশনের আগাগোড়ায় বঙ্গভাষীদের উপর নির্যাতন নিয়ে সরব ছিলেন। আজও তাঁরা একই ভূমিকা পালন করেন।
বিধানসভার বাইরেও এ দিন ডি ভোটার ধরপাকড় নিয়ে আন্দোলনমুখর ছিল বিজেপি। সেখানেও একই ধরনের ভাষাভিত্তিক বিভাজন। বিজেপির সদর দফতর বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার গেরুয়াবাহিনী এ নিয়ে কিছু বলছেন না। অবস্থান বিক্ষোভ পালিত হয়েছে বরাক উপত্যকার তিন জেলা সদরে।
শিলচরে জেলাশাসকের দফতরের সামনে ধর্নায় অংশ নেন দলের প্রদেশ কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজদীপ রায়, মুখপাত্র অবধেশ সিংহ, জেলা সভাপতি কৌশিক রাই, শহর কমিটির সভাপতি দীপায়ন চক্রবর্তী, যুব মোর্চার জেলা সভাপতি রাজেশ দাস, পরিমল শুক্লবৈদ্য। তাঁদের সবার বক্তব্য, পুলিশ এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। কেন্দ্র যখন এ ব্যাপারে নীতি প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, তখন পুলিশ বেছে বেছে ধর্মীয় নির্যাতনের জেরে যাঁরা এ দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের জেলে পুরছে। এর মধ্যে অধিকাংশের হাতে ১৯৭১ সালের আগের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত কাগজপত্র রয়েছে। কিন্তু পুলিশ তাঁদের বাড়িতে কখনও ট্রাইব্যুনালের নোটিস পাঠায়নি। ফলে একতরফা ভাবে তাঁদের বিদেশি বলে রায় দিয়েছেন বিচারক। বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখতে তাঁরা আর্জি জানান। অবস্থান বিক্ষোভের পর বিজেপি নেতারা জেলাশাসকের মাধ্যমে রাজ্যপাল পদ্মনাভ বালকৃষ্ণ আচার্যের কাছে স্মারকপত্র পাঠান। তাঁদের দাবি, একতরফা রায়ে যাঁদের বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, গ্রেফতারের আগে কাগজপত্র দেখানোর জন্য তাঁদের সুযোগ দেওয়া হোক। ভারতের নাগরিকরা যেন কোনও অবস্থায় হেনস্থার শিকার না হন। তা ছাড়া, শিলচরে যে নতুন বিদেশি ট্রাইব্যুনালগুলি খোলা হচ্ছে, সেগুলি শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। বিজেপির দাবি, সেগুলিকে এক জায়গায় রাখা হোক। একই আদালত চত্বরে যেমন অনেক বিচারকের এজলাস থাকে। তাতে মানুষের ভোগান্তি কমবে।
পুলিশের সীমান্ত শাখা সূত্রে জানা গিয়েছে, ‘বিদেশি’দের ধরে জেলে ঢোকানোর হচ্ছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। দু’টি পদ্ধতিতে মামলা যায় ট্রাইব্যুনালে। প্রথমত, নির্বাচন শাখার মাধ্যমে জেলা প্রশাসন ভোটার তালিকায় ‘ডি’ চিহ্নিত করে সন্দেহভাজনদের নামের তালিকা পুলিশের কাছে পাঠায়। পুলিশ সেগুলি ট্রাইব্যুনালের কাছে বিচারের জন্য পেশ করে। দ্বিতীয়ত, পুলিশ কারও অভিযোগের ভিত্তিতে বা নিজে থেকে সন্দেহভাজন বিদেশিদের খোঁজ করে। যাঁদের নিয়ে সন্দেহ হয়, তাঁদের নথিপত্র দেখাতে বলা হয়। অনেকে নানা কথা বলে এড়িয়ে যায়। তাঁদের নামে ট্রাইব্যুনালে মামলা করা হয়।
কাছাড় জেলায় এখনও পর্যন্ত ডি চিহ্নিত মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে ৪ হাজার ৬৮৫টি। তার মধ্যে ১ হাজার ৪৩২ জনকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১ হাজার ৯৮৯ জনকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। মামলা চলাকালীন মৃত্যু হয়েছে ১২২ জনের। ১ হাজার ১৪২ জনকে ট্রাইব্যুনালের নোটিস পৌঁছনোর জন্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখনও ৮ হাজার ৯৫৪টি ডি-মামলা বিচারের জন্য ঝুলে রয়েছে।
অন্য দিকে, পুলিশের পাঠানো সন্দেহভাজন মামলার মধ্যে ১ হাজার ৬৬৫টির নিষ্পত্তি হয়েছে। তাতে ৫৯১টি মামলায় ৬৪২ জনকে বিদেশি বলে রায় দেওয়া হয়েছে। ৮৯৯ জনকে ভারতীয় বলে আদালত মেনে নিয়েছে। মামলা চলাকালীন মৃতের সংখ্যা ৬৮। ১০৭ জনকে নোটিস দেওয়ার জন্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশের নিজেদের পাঠানো ৭ হাজার ১১টি মামলা এখনও বিচারাধীন।
সূত্রটি আরও জানান, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে যাঁরা ভারতে এসেছেন, তাঁদের দশ বছরের জন্য সমস্ত সুযোগ-সুবিধা বাদ দেওয়ার পর নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান রয়েছে। সেই হিসেবে কাছাড়ে ৭৩৩ জনকে চিহ্নিত করে ট্রাইব্যুনাল। তাঁদের মধ্যে ৩০২ জন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নাম নথিভুক্ত করিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy