Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

ঝরনা-উপত্যকা-শীত-চকোলেট

শৈলশহরটি তিন দিনেই মায়াবী আলোয়ানের মতো জড়িয়ে ধরে। পাহাড়ি শৈলশহরগুলির স্বাভাবসিদ্ধ সৌন্দর্যব্যঞ্জনা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সবুজে ছাওয়া সোঁদা গন্ধ মাখা পাইন বন কবিতার মতো উপত্যকা আকৃষ্ট করে আমাদের সমতলে থাকা শহুরে মানুষদের। এই সুন্দরতার আবেশ নেশা ধরায় আজন্মলালিত ভ্রমণরসিক মনে। মেঘের জলছবি ছাওয়া সবজে নীল পাহাড় আবিষ্ট করে রাখে। কোদাইকানাল থেকে উতরাই পথে ফিরতে ফিরতে স্মৃতিতে ধরে রাখি ওই ঝিল, ওই অস্থায়ী আবাস, প্রপাত, উপত্যকা, চকলেটের গল্পগাথা। ভ্রমণের ভিন্ন ব্যঞ্জনা শোনালেন মধুছন্দা মিত্র ঘোষ।“ There is a big difference between simply being a tourist and a true travelor”— কথাটা কোথায় যেন পড়েছিলাম, এ কথা ভাবতে ভাবতেই মনে হল, প্রাত্যহিকতার একঘেয়েমি ক্লান্ত মন চায় ক্ষণিক অবসর। প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে শ্রেষ্ঠ আর কী বা হতে পারে।

হঠাৎ ঘনায় আঁধার--- মেঘ-কুয়াশা। ছবি: দেবাশিস ভাদুড়ি।

হঠাৎ ঘনায় আঁধার--- মেঘ-কুয়াশা। ছবি: দেবাশিস ভাদুড়ি।

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

“ There is a big difference between simply being a tourist and a true travelor”— কথাটা কোথায় যেন পড়েছিলাম, এ কথা ভাবতে ভাবতেই মনে হল, প্রাত্যহিকতার একঘেয়েমি ক্লান্ত মন চায় ক্ষণিক অবসর। প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে শ্রেষ্ঠ আর কী বা হতে পারে। বাড়ির ওই চৌহদ্দিটুকুও তখন তুচ্ছ মনে হয়। মনের ভেতরেও যে যত্ন করে রাখা বাউন্ডুলে মনটা আছে—সেখানে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে পর্যটন আয়োজন। চেনা চৌহদ্দির বাইরে প্রকৃতির স্নিগ্ধ রংরূপের প্রলেপে প্রাণে নতুন স্ফূর্তির নানান সুলুকসন্ধান। মনভাসির টানে শুরু হয়ে গেছিল, কোথাও বেরিয়ে পড়ার দে ছুট পাড়ি।

হা-পিত্যেস মনে তখন কোথায় যাই কোথায় যাই। কখনও মনে হয় কোঙ্কন উপকূলে সমুদ্দুরের লোনা জল ও হাওয়ায় বালুতটে ঢেউয়ের সঙ্গে দেদার খুনসুটি করি, কখনও ভাবি বরফমোড়া হিমালয় তো কখনও নীলগিরি চা-বাগিচাময় ঢেউ খেলানো পাহাড়। অথবা নিঃশ্ছিদ্র জঙ্গল কিংবা ইতিহাসের পাতা ছেঁড়া আকর ঐতিহাসিক প্রাচীন শহর, দুর্গ, হাভেলি, মন্দির-মসজিদ। কিংবা জঙ্গল সাফারি, জিপ থেকে বনের রাজাকে দেখার অভিজ্ঞতা বা হাতির পিঠে জঙ্গল ভ্রমণ এর অমোঘ আকর্ষণ।

তারপরই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই— এ বারের গন্তব্য হোক নীল পাহাড়ের আঁচলে সবুজে ছাওয়া প্রকৃতির মাঝে ‘THE PRINCESS OF HILL STATION’ কোদাইকানাল। রাত ১০.৩৫-এ মুম্বইয়ে লোকমান্য তিলক স্টেশন থেকে কোয়েম্বাত্তুর এক্সপ্রেস রওনা দিল। দু’রাত কাটাতে হবে রেলগাড়ির কামরায়। আমাদের আসন সংলগ্ন সহযাত্রীরা তামিল-তেলেগু-রাজস্থানি-পঞ্জাবি আর আমরা বাঙালি তো রয়েইছি। ব্যাপারটা বেশ চমকপ্রদ। যেন কামরার ওই ওপর নীচ পাশের আটটি আসনই মিনি ভারত সংস্করণ। আড়াই দিনের দীর্ঘ সফরে আমরা সবাই পরস্পরের পরিচিত হয়ে গেছি। ৭ জুন সঠিক সময়েই কোয়েম্বাত্তুর পৌঁছে গেছি। মুম্বই থাকতেই অনলাইন বুকিং এর মাধ্যমে গাড়ির বন্দোবস্ত ছিল। স্টেশনের বাইরে আসতেই আমাদের আগামী কয়েক দিনের গাড়ির সারথী সতীশ মরুগন কাছে এসে অভ্যর্থনা জানালেন।

কোয়েম্বাটুর তামিলনাড়ু রাজ্যের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক শহর। নয়্যাল নদী তীরে স্থিত কোয়েম্বাটুরকে বলা ‘THE TEXTILE CAPITAL OF SOUTH INDIA’ এবং ‘MANCHESTER OF SOUTH’। কোয়ম্বাত্তুর প্রাচীন ঐতিহাসিক শহরও। এখানে রাজ্য পরিচালনা করে এসেছেন চোল, রাষ্ট্রকুট, চালুক্য, পাণ্ডয়া, হোসেল ইত্যাদি বংশ থেকে বিজয়নগরের রাজাবিরাজও। প্রাচীনকালে এ রাজ্যের নাম ছিল KONGUNUD। পরে ব্রিটিজ জমানায় এই ছোট রাজ্যটির নাম হয় কোয়েম্বাত্তুর।

কোয়েম্বাত্তুর থেকে সকাল সাড়ে আটটায় গাড়ি ছাড়ল। সুন্দরাপুরম অঞ্চলে পোল্লাচি রোডের ধারে ‘শ্রী অনধাস ভেজ রেস্তোরাঁয়’ দক্ষিণ ভারতীয় ‘মিনি টিফিনে’ মোট সাত রকম পদ। ইডলি ১ পিস, মিনি পুরি ১ পিস, ভাজহইথান্ডু, পোঙ্গল, মিনি সম্বর বড়া, মিনি উত্তপম। সঙ্গে ছোট ছোট বাটিতে পরিবেশিত সবজি, সম্বর ও চাটনি। শেষে স্টিলের বাটিগেলাস মিনি কফি। রেস্তোরাঁটি পরিচ্ছন্ন এবং খাবারের মানও যথেষ্ট উন্নত।

সুদূর ঝরনায়। কোদাইকানাল।

কোয়েম্বাত্তুর থেকে কোদাইকানাল দূরত্ব ১৭০ কিমি। কোয়েম্বাত্তুর থেকে ৪০ কিমি দূরে পোল্লাচি একটি জমজমাট বাণিজ্যিক শহর। ২০৯ জাতীয় সড়ক ধরে অপূর্ব সুন্দর মসৃণ পথ সাঁতরে চলেছি। যাত্রাপথের ধারে কৃষ্ণচূড়া গাছগুলিতে জুন-এর প্রথমারাম্ভে উজ্জ্বল লাল-কমলা ফুলে ফুলে ছয় লাপ। প্রচুর বেসরকারি কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আর রয়েছে ফাঁকা প্রান্তরের দু’ধারে একের পর এক উইন্ড মিল। হাওয়ার গতি নিরিখে বায়ুযন্ত্রের বড় বড় পাখাগুলি অনবরত পাক খাচ্ছে। এত বায়ুযন্ত্র প্রথম দেখলাম। উদুমালপেট নামে আরও একটি জনপদ। আরও বেশ খানিক দূরে পালানি। এখানে যাত্রাপথের বাঁদিকে ১০০০ ফুট উচ্চতায় একটা পাথরটিলার উপর শ্রীসুব্রহ্মণ্য মন্দির। ৬৫০ ধাপ সিঁড়ি উঠে পালানি পাহাড়ের ভগবান সুব্রহ্মণ্য মন্দিরে পৌছানো যায়। স্থানীয়দের কাছে খুবই জাগ্রত মন্দির। এ বার রাস্তাটা সটান ডান দিক ঘুরে পালানি ঘাট রোড শুরু হল। পথে নেমে পালানি মন্দিরের ছবি নিলাম আর ঠান্ডা পানীয় গলায় ঢাললাম। খানিক হাত-পা ছাড়িয়ে নেওয়াও হল। এ পথের ধারে গ্রামগুলোয় প্রচুর নারকেল গাছের কানন। খানিক যেতেই ঠাহর হল আমরা ক্রমশ পাহাড় জড়িয়ে ওপরে উঠছি। পালানি পাহাড় ও মন্দিরকে ওপর থেকে দেখতে পাচ্ছি। এক ধারে পাহাড় অন্য পাশে অপরূপ উপত্যকা। অনন্ত লাবণ্যতায় প্রকৃতি। এমন পার্বত্য পথ ও প্রকৃতির রূপমাধুরী অনেকক্ষণ। নীচে উপত্যকায় এক বিস্তৃর্ণ জলাধার ও নীলচে সবুজ পাহাড় আর আদিগন্ত কফির খেত। গাড়ির গতি রুদ্ধ করিয়ে পথ পার্শ্বে একটা ভিউ পয়েন্ট নেমে আবারও কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম সেই অনাবিল উপত্যকার।

এ বার শুরু হয়ে গেল কোদাইকানাল ঘাট রোড। একে ল’স ঘাট রোডও বলা হয়। যাত্রাপথের ডান দিকে সিলভার ক্যাসকেড জলপ্রপাত। কোদাই হ্রদের অতিরিক্ত জল ১৮০ ফুট উঁচু থেকে পাহাড় বেয়ে দুর্বার গতিতে আছড়ে পড়ছে নীচে। রেলিং ঘেরা অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভিউ পয়েন্ট। ‘সিলভার ক্যাসকেড’ সূর্যের আলো ঠিকরানো নিঃসীম বেগবতী এই প্রপাতের জলকে রুপালি বাহারই মনে হচ্ছে। যেটি প্রপাতের নামটি সার্থক করে তুলেছে। ট্রাভেল বাস, প্রচুর গাড়ি ও পর্যটকের ভিড়ে ঠাসা। পর্যটকরা দেদার ছবি তুলছেন ওই ‘রূপালি জলপ্রপাতের’ আঙিনায়।

ইউক্যালিপটাস, পাইন, ফার, শোলা, ম্যাগনোলিয়া গাছে ঘেরা পথটা এ বার ৬৯৯৮ ফুট (২,১৩৩ মিটার) উঁচু কোদাইকানাল শহরে প্রবেশ করল। শহরের ফার্ন হিল রোডে, তামিলনাড়ু ট্যুরিজম (টিটিডিসি)-এর হোটেল মাস খানেক আগে থাকতেই অনলাইন বুকিং করা ছিল। এপ্রিল-মে-জুন কোদাইকানালে পিক সিজন। এই সময়টা প্রচুর পর্যটক সমাগম হয় এখানে। আমাদের কটেজটা ভারি সুন্দর। ঘরের সামনে লাল মেঝের এক চিলতে বারান্দা। পাহাড়ের খাঁজে এই কটেজটি আমাদের আপাত তিন দিনের অস্থায়ী ঠিকানা।

পাহাড়ের কোল জুড়ে টিটিডিসি-র হোটেল চত্বরটা অনেকটা খোলামেলা ছড়ানো। একটা পাহাড়টিলাকে পেঁচিয়ে হোটেল চত্বরটা। কখনও পথ নেমে গেছে ঢালে, সেখানেও বেশ কিছু কটেজ। আবার তারই খাঁজেখন্দে উপযুক্ত তদারকি ও পরিচর্যার গুণে বর্ণময় হয়ে আছে এক এক চিলতে ফুলেল বাগিচা। রয়েছে দোলনা ও শিশু উপযোগী কিছু রাইডস, বসার জায়গা। রিসেপশন সেন্টার ও খাবারের প্রশস্ত হল ঘরটিতে পাহাড় চত্বরেই অনেকগুলি সিঁড়ি নেমে যথেষ্ট নীচে। অনেকখানি একর জমিতে ইউক্যালিপটাস পাইন গাছে ছাওয়া টিটিডিসি ‘হোটেল তামিলনাড়ু’র বাগানে ঘুরেই দিব্যি কেটে যেতে পারে আস্ত একটা দিন। শহুরে আভিজাত্যের সঙ্গে পাহাড়ি আটপৌরে ভাবের মিলমিশে দারুণ ব্যবস্থা। স্বাচ্ছন্দ্য ষোলো আনা অথচ শহুরে দমবন্ধ। একঘেয়েমি ছেড়ে নতুন আবহে শীত শীত আরাম ও আয়েশের নির্ভেজাল পরিকাঠামো।

দক্ষিণ ভারতে তামিলনাড়ু রাজ্যের ডিন্ডিগল জেলার, কোদাইকানাল শৈলশহরকে যে ‘শৈলশহরের রানি’ বলা হয়—কথাটি যে একেবারেই অতু্যক্তি নয়, শহরে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে বোঝা গেল। কোদাইকানাল শব্দটির তামিল তর্জমা করলে ‘THE GIFT OF FOREST’। তামিল শব্দ ‘KOE-DEI’ মানে ‘গ্রীষ্ম’ আর ‘KANAL’ মানে ‘দেখা’। আবার অন্য আরেকটি অর্থ হল তামিল শব্দ ‘কানাল’ মানে ‘গভীর জঙ্গল’। তাই তো তামিল জনসাধারণ কোদাইকানাল শৈলশহরটিকে আদর করে কখনও বলেন ‘THE FOREST OF CREEPERS’, ‘THE END OF THE FOREST’ ‘THE FOREST OF VINES’ কিংবা ‘GIFT OF FOREST’। তবে নাম বিশেষণ যাই থাক, কোদাইকানাল শৈলশহরটির শান্ত বাতাবরণ ও প্রাকৃতিক ব্যাঞ্জনা দুর্নিবার হাতছানি দেয় পর্যটক মনে এক আদুরে ঢংয়ে। নৈসর্গিক সুন্দরতা আর অনন্ত পাহাড় ও দুরান্তে উপত্যকার সৌন্দর্য যেন ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে ছেঁড়া কোনও অপরূপ ছবি। পাহাড়ি প্রেক্ষাপটে জোড়া এ আকর্ষণ উপেক্ষা করা যায় না। বাড়ির বাইরে বেড়াতে এসে যাঁরা নিপাট নির্জনতা পছন্দ করেন তাঁদের জন্য আদর্শ গন্তব্য তামিলনাড়ুর এই শৈলশহর।

কোদাইকানালে শৈলশহরের একটা প্রাকৃতিক সুন্দরতার সংযোজন হল ‘কুরঞ্জী ফুল’। কথিত আছে প্রতি বারো বছর অন্তর এই অলৌকিক কুরঞ্জী ফুল ফোটে। সেই বছর নাকি কোদাইকানালের রূপমাধুরী দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এই ফুলের মাদকতা ও বৈভব, তামাম পর্যটকের কাছেও খুব আদরের সন্দেহ নেই।

বিকেলেই চলে গেলাম কোদাইকানালের হৃদয় উদ্যত কোদাই হৃদে। শহরের প্রাণকেন্দ্র এই কৃত্রিম ঝিলটি দেখতে তারা মাছের মতো। ৬০ একর আয়তন যুক্ত এই ঝিলটি ১৮৬৩ সালে স্যর হেনরি লেভিঞ্জ খনন করান। এবং ঝিলটিতে প্রচুর মাছ ছাড়েন। তিনি ছিলেন মাদুরাই শহরের কালেক্টর, এবং অবসর গ্রহণের পরই এখানে বসবাস শুরু করেন। ১৮৯০ সাল নাগাদ তিনি তুতিকোরিন থেকে প্রথম একটি নৌকা আনান এখানে এবং এখানে বোট ক্লাব-এর সূচনা করেন। তারও বহু বছর পর ১১৯৩২ সাল থেকে আমজনতা ও পর্যটকদের জন্য নৌকা আরোহন ব্যবস্থা চালু হয়। ঝিলের জলে হংস আকৃতির নৌকা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরাও কিছুক্ষণ সেই বিনোদনী অভিজ্ঞতার শরিক হলাম। ঝিলের জলে অনেক মাছ। সমস্ত ঝিলটাকে প্রদক্ষিণ করে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেক বিদেশি। সমস্ত এলাকাটা শীতবস্ত্র, চকোলেট, নানাবিধ তেল ও সুগন্ধী, সানগ্লাস, ঝুটো গয়না, খাবার দোকানে ঠাসা। টোস্টেড মশলামাখা মকাইদানা হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছি সব। ‘হোম মেড চকোলেট’এর সাইনবোর্ড ঝুলছে প্রায় প্রতিটি চকোলেটের দোকানেই। আমাদের গাড়ির সারথী সতর্ক করল এখান থেকে তেল ও চকোলেট না কেনার জন্য। পার পম্বারপুরম অঞ্চলে কোদাই বিগ বাজারে তামিলনাড়ু সরকারি সংস্থার দোকান থেকে প্রাকৃতিক ভেষজ তেল, ভেষজ গ্রীন টি, কোদাই-মধু, কোদাই-মশলা, চকোলেট নাটস ইত্যাদি কেনা হল কিছু বাড়ির জন্য ও প্রিয়জনদের উপহার দেওয়ার স্মারক হিসাবে।

সন্ধেবেলা কোদাইকানাল মূল বাজার অঞ্চলে এক রেস্তোরাঁয় বসে ধূমায়িত হট চকোলেট তারিয়ে তারিয়ে খেতে খেতে সকালে সিলভার কাসকেড জলপ্রপাত নিয়ে কবিতাই দু’ছত্র লিখে ফেললাম সঙ্গের নোট বুক-এ।

“সেই প্রপাতটি নেই

অথবা আছে

বন্ধ হল অভিমানের খেলা

আমার, তোমার ইচ্ছে ছুঁয়ে

প্রপাত, বা ওই প্রপাতের ছায়া..”

আজও আবার সেই কথাগুলো লিখতে যেয়ে টের পাই আবেগ আতিশয্যের আভাস। বেড়াতে যেয়ে তাই-ই তো হয়। আবেগের রাশকে বড় বেশি আলগা ছেড়ে দিই।

পরদিন, টিটিডিসির রেস্তোরাঁয় ‘কমপ্লিমেন্টরি ব্রেকফাস্টে’ ইডলি, সম্বর, বড়া, পোঙ্গল আর কফির কাপে চুমুক দিয়েই বেরিয়ে পড়ি সাইট সিয়িং-এ। সমগ্র কোদাইকানাল অঞ্চলে অনেকগুলি দ্রষ্টব্য স্থান রয়েছে। যেমন কর্কাস পয়েন্ট, আপার লেক ভিউ, পাইন ফরেস্ট সিনে স্যুটিং প্লেস, ময়্যার পয়েন্ট মেমোরিয়াল পিলার, ফোর পিলার রক, ভাগাই ড্যাম ভিউ, গলফ কোর্স গ্রীন ভ্যালি ভিউ, মাউন্টেন বিউটি, বেরিজম লেক, সাইলেন্ট ভ্যালি ভিউ ইত্যাদি।

ব্যক্তিগত ভাবে সবচেয়ে ভাল লাগায় ভরিয়ে দিয়েছিল কোদাইকানালের ‘কর্কাস ওয়াক’। লেফটেন্যান্ট কর্কাস ১৮৭২ সালে এই পাহাড়ি সমতল পথটি আবিষ্কার করেন। কোদাই-এর মানচিত্র এই ককার্সই তৈরি করেছিলেন। টানা ২ কিমি রেলিং ঘেরা টালির টাইলস বসানো পথটির ওপর দিয়ে যেতে যেতে মনে হয় ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’। রেলিং-এর ওপাশে ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট বাড়িঘর নিয়ে ছবির মতো পল্লিসমাজ। এখানকার ‘টেলিস্কোপ হাউস’ থেকে আরেক প্রস্থ প্রবেশমূল্য দিয়ে টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে দেখে নেওয়া যায়, কাঁচের ঘরটির বহু দূরে থাকা পাহাড়ি ঝর্না ও দূরবিজনে ঘুমিয়ে থাকা নিরিবিলি কিছু গ্রাম।

‘গ্রীন ভ্যালি ভিউ’ বা সবুজ উপত্যকাকে স্থানীয়রা বলেন, ‘সুইসাইড পয়েন্ট’। দু’ধারে রকমারি পসরা নিয়ে দোকান। সরু গলির মতো বাঁধানো রাস্তা ক্রমশ এগিয়ে গেছে তারের জাল দিয়ে ঘেরা ৪,৯০০ ফুট। এখান থেকে দু’চোখ প্রসারিত করলে দেখা যায় নীচে ভাইগাই ড্যাম ও পাহাড়ের পর পাহাড়ের মেঘে ঢাকা অপার রূপ।

কোদাইকানালের দক্ষিণ-পশ্চিমে পাইন ফরেস্ট, মিস্টার ব্রায়ান্ট সাহেবের তত্ত্বাবধানে ১৯০৬ সালে নির্মিত হয়। সমস্ত অঞ্চলটাই মূলত দক্ষিণ ভারতীয় চলচিত্রের গুরুত্বপূর্ণ সুটিং স্থল। সবুজ ঘাসে ঢাকা একটা উপত্যকা ঘেরা সুন্দর এলাকা দেখিয়ে ড্রাইভার সতীশ জানাল যে এটি নাকি বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা কমল হাসানের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন এলাকা। কমল হাসান আমার খুবই প্রিয় পছন্দের অভিনেতা। তাই গাড়িতে বসেই চোখ গোল গোল করে দেখতে থাকি জায়গাটা। ৪০০ ফুট উঁচু তিনটে বিশাল পাথরের ‘পিলার রকস’ প্রাকৃতিক রূপও অসাধারণ। রেলিং ঘেরা ভিউ পয়েন্টের ও পাশেই অতলান্ত খাদ। সবুজ মখমলের মতো গালিচা বিছানো গলফ চত্বরটিও অপূর্ব। ৬০০০ ফুট উচ্চতায় শতাধিক একর অঞ্চল নিয়ে গঠিত এই গলফ ময়দান। ফিরতি পথে আপার লেক ভিউ পয়েন্ট থেকে নীচে তারার মতো আকৃতির কোদাই হ্রদ ও পাহাড় বাড়িঘর ঘেরা কোদাইকানাল শহরটিকে পাখির চোখ দিয়ে দেখতে একদম অন্য রকম লাগে।

কোদাইকানাল শৈলশহরটি তিন দিনেই মায়াবী আলোয়ানের মতো জড়িয়ে ধরে। পাহাড়ি শৈলশহরগুলির স্বাভাবসিদ্ধ সৌন্দর্যব্যঞ্জনা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সবুজে ছাওয়া সোঁদা গন্ধ মাখা পাইন বন কবিতার মতো উপত্যকা আকৃষ্ট করে আমাদের সমতলে থাকা শহুরে মানুষদের। এই সুন্দরতার আবেশ নেশা ধরায় আজন্মলালিত ভ্রমণরসিক মনে। মেঘের জলছবি ছাওয়া সবজে নীল পাহাড় আবিষ্ট করে রাখে। কোদাইকানাল থেকে উৎরাই পথে ফিরতে ফিরতে স্মৃতিতে ধরে রাখি ওই ঝিল, অস্থায়ী আবাস, প্রপাত, উপত্যকা, চকলেটের গল্পগাথা...।

অন্য বিষয়গুলি:

kodaikanal madhuchanda mitra ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE