শরীর খারাপ হলেই গুগল সার্চে ওষুধ খুঁজছেন! ছবি: সংগৃহীত।
শরীর খারাপ হল কি হল না, হাত চলে যায় ইন্টারনেটে। ফটাফট নিজের উপসর্গগুলি লিখে নেট দুনিয়ায় সমাধান হাতড়াই আমরা। চিকিৎসকের কাছে না গিয়েও যদি ওষুধটা বা পথ্যটা জেনে নেওয়া যায়, তা হলে ক্ষতি কী! সময় বাঁচে, আর পকেটও।
বিশ্ব জুড়েই এখন এই ট্রেন্ড চলছে। যখন যা কিছু হবে, সবই গুগলে গিয়ে টাইপ করে ফেলো। তার পর সার্চে ক্লিক করলেই যেন বিশ্বকোষ খুলে যাবে। জীবনের প্রতিটা খুঁটিনাটি বিষয়ে উত্তর খোঁজার জন্য ইন্টারনেটেই ভরসা রাখছি আমরা। সে সম্পর্কের সমীকরণ বোঝা হোক বা রোগের চিকিৎসা— ষোলো আনা বিশ্বাস জিতে নিয়ে নিয়েছে নেট দুনিয়া। আধুনিক প্রযুক্তির মায়াজালে জড়িয়ে বাস্তবটাই ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আর সেখানেই ঘনিয়ে আসছে বড় বিপদ।
সমস্যাটা ঠিক কোথায়? ধরুন, মাথাব্যথা হচ্ছে। কী ওষুধ খেলে ভাল বা কী ধরনের জেল লাগালে ব্যথা কমবে, গুগলে সার্চ করলেই নতুন এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) টুল একগাদা ওষুধের নাম দেখিয়ে দেবে। তার মধ্যে কোনটা আপনার জন্য ভাল, তা না বুঝেই সেটা কিনে খেয়ে ফেললেন। পরে দেখা গেল, ওই ওষুধের জেরেই অন্য সমস্যা হচ্ছে আপনার। ইদানীং এমন ঘটনা ঘটেছে যে, অনলাইনে ওষুধের নাম দেখে বা ডায়েট চার্ট অনুসরণ করে রোগ আরও বাড়িয়ে তুলেছেন রোগী। চিকিৎসকের কাছে যখন যাচ্ছেন, তখন দেরি হয়ে যাচ্ছে অনেকটাই।
ওষুধপথ্য খোঁজার ব্যাপারেও কি অনলাইনের আধুনিক প্রযুক্তিকে বিশ্বাস করা যায়? কোনও জটিল রোগের চিকিৎসাও কি সঠিক ভাবে করে দিতে পারবে ডিজিটাল প্রযুক্তি? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন সেটাই। চলুন জেনে নিই, চিকিৎসক আর প্রযুক্তিবিদেরা কী মতামত দিচ্ছেন।
এক জন চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসা করেন, কারণ রোগটার নাম জানা, রোগীই অচেনা। তাই চিকিৎসা কোন পথে হবে সেটাই আসল, এমনই মনে করছেন রাজ্যের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী। সাম্প্রতিক সময়ে এমন অনেক রোগীকেই তিনি দেখেছেন, যাঁরা ইন্টারনেট ঘেঁটে ওষুধপত্র খেয়ে বিপদে পড়েছেন। চিকিৎসক বলছেন, ‘‘নেট হাতড়ে নিজের চিকিৎসা নিজেই করার এই অভ্যাসই এখন একটা রোগ হয়ে গিয়েছে। এর নাম ‘ইডিয়ট সিনড্রোম’। কমবয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে এখন এই প্রবণতা বেশি। যদি নেট প্রযুক্তিই চিকিৎসা করতে পারত, তা হলে আর চিকিৎসকের দরকার পড়ত না। বই পড়ে বা গবেষণাপত্র দেখেই ওষুধ দিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু তা হয় না। রোগীকে দিনের পর দিন দেখে, তার উপসর্গ বুঝে, রোগের ধরন বুঝে তবেই এক জন চিকিৎসক সঠিক ভাবে চিকিৎসা করতে পারেন। প্রতিটা মানুষ একে অপরের থেকে আলাদা। তাই তাদের রোগের ধরন ও উপসর্গগুলিও আলাদা। চিকিৎসা পদ্ধতিও তাই এক গতে হবে না। সুবর্ণ গোস্বামীর পরামর্শ, ইন্টারনেট দেখে বিভ্রান্ত হবেন না। রোগ হলে চিকিৎসকের কাছে যান। সঠিক ওষুধ খান।
মনের রোগ বুঝতেও আজকাল ইন্টারনেটে খোঁজাখুঁজি বেড়েছে! সমীক্ষা বলছে, লকডাউনের সময়ে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সিরাই সবচেয়ে বেশি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নেট দুনিয়ায় সার্চ করেছিলেন। এমনকি, দাম্পত্য কলহ, মানসিক চাপ থেকে বাঁচার উপায় জানতেও বিস্তর খোঁজাখুঁজি হয়েছে গুগলে। এখনও যে হচ্ছে না, তা নয়, বরং অনলাইনে মনের ব্যাধির ওষুধ খোঁজার হার এখন সবচেয়ে বেশি, এমনটাই বললেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শর্মিলা সরকার।
শর্মিলার কথায়, অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা, মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হওয়ার কিছু টোটকা গুগল দিতে পারবে ঠিকই, কিন্তু জটিল মনোরোগের চিকিৎসা করা কখনওই সম্ভব নয়। কারণ, একটা ওষুধের নানা রকম প্রয়োগ আছে। যে ওষুধ অবসাদের জন্য দেওয়া হয়, সেটি অন্য মানসিক রোগের জন্যও দেওয়া হতে পারে। কাজেই কোন ওষুধ কার জন্য ঠিক, সেটা একমাত্র চিকিৎসকই বুঝবেন। তা ছাড়া, চিকিৎসক যদি বোঝেন মনের অসুখ অনেক গভীরে, তখন রোগীর কাউন্সেলিং করানো হয়। রোগীর কথাবার্তা, আচার-আচরণ দেখে তবেই চিকিৎসা শুরু হয়। রোগীর মন ও মস্তিষ্কে কী চলছে, সেটা বোঝা খুব দরকার। প্রযুক্তি এই কাজটা করতে পারবে না। এর জন্য দীর্ঘ দিনের পড়াশোনা, অভ্যাস, বাস্তব থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতার দরকার হয়।
আইটি কর্মী নবনীতা সব সময়েই ইন্টারনেটে ওষুধের খোঁজ করেন। তিনি বললেন, কয়েক মাস আগে বুকে খুব ব্যথা হচ্ছিল। নেটে খুঁজতেই দেখলেন, এই ধরনের উপসর্গ হলে কী কী ওষুধ খাওয়া যেতে পারে, তার তালিকা রয়েছে। একটা বেছে কিনে খেয়েই ফেলেছিলেন। কিছু দিন পর থেকে দেখলেন, বুকে ব্যথা তো কমলই না, উল্টে নতুন করে মাথাব্যথা শুরু হল। শেষমেশ কার্ডিওলজিস্টের শরণাপন্ন হয়ে জানতে পারেন সমস্যাটা হার্টের। আর তিনি যে ওষুধ খেয়েছিলেন তা একেবারেই তাঁর জন্য নয়।
গলদটা হচ্ছে গোড়াতেই। হার্টের চিকিৎসক রাজা নাগও এমনই মনে করেন। ইন্টারনেটের আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ নির্ভুল তো হবেই না, উপরন্তু বিপজ্জনক হয়ে উঠবে বলেই মত তাঁর। ডাক্তারি বই, বিভিন্ন গবেষণাপত্র খুঁটিয়ে দেখেই সমাধান বাতলায় গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বাস্তবের সঙ্গে তার মিলমিশ না-ও হতে পারে। দশ জন হার্টের রোগী ইন্টারনেট ঘেঁটে একই উত্তর পাচ্ছেন। তাঁরা একই রকম ওষুধের নাম দেখছেন। কিন্তু দশ জনের প্রত্যেকের হার্টের অবস্থা, হৃদ্গতি, স্পন্দন আলাদা। তাই চিকিৎসাও আলাদা হওয়া উচিত। শুধুমাত্র কিছু সাধারণ উপসর্গের মিল দেখে রোগীরা বিশ্বাস করে ওষুধ খেয়ে ফেলছেন। বিপদ হচ্ছে এখানেই।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চিকিৎসা ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু চিকিৎসক হতে পারে না— এমনটাই মত ইউরোগাইনোকোলজিস্ট মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর মতে, ভবিষ্যতে চিকিৎসার অনেক জটিল পদ্ধতি, রোগ নির্ণয়, ওষুধ আবিষ্কার ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে পারি। এখন তো আধুনিক অস্ত্রোপচারে রোবোটিক্সের প্রয়োগ হচ্ছে। সেই যন্ত্র চালাচ্ছে এক জনই। তেমনই গুগলের এআই টুল কী উত্তর দেবে, তার প্রোগ্রামিং করছেন কোনও প্রযুক্তিবিদই। যন্ত্রের বুদ্ধি মানুষের বুদ্ধিকে ছাপিয়ে যায়নি এখনও। টেলি মেডিসিন পরিষেবায় বহু দূর থেকেই রোগীকে দেখে ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও এক জন চিকিৎসকই থাকেন। কাজেই চিকিৎসা ক্ষেত্রে চিকিৎসকের ভূমিকা ও দায়িত্ব সব সময়েই আগে থাকবে।
তবে এই বিষয়টি নিয়ে এখনই কোনও সিদ্ধান্তে চলে আসতে রাজি নন প্রযুক্তিবিদেরা। কলকাতার এক বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদে রয়েছেন মিতালি বিশ্বাস। তিনি পেশায় সফ্টঅয়্যার ডেভেলপার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নাড়াঘাঁটা করতে হয়। তিনি বললেন, ‘‘আধুনিক চিকিৎসার খুব বড় সহায়ক হতে চলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। অনেক জটিল চিকিৎসার অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি বিশ্লেষণ করতে পারে এআই। সিটি স্ক্যান, এক্স-রে, এমআরআই সবেতেই এআই-এর প্রয়োগ হচ্ছে। কোনও রোগীকে পরীক্ষা করা, রোগের ধরন বোঝা, মেডিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট তৈরি করতেও প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। ওষুধ নিয়ে উচ্চস্তরে গবেষণা করতে গেলেও এখন প্রযুক্তিরই প্রয়োগ হচ্ছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে নিত্যনতুন আবিষ্কারেও সেই প্রযুক্তিরই প্রয়োগ হচ্ছে। খুব দ্রুত কোনও রোগের নিরাময়ের উপায় খুঁজে বার করা, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মতো জটিল বিষয়গুলিতেও গবেষকেরা প্রযুক্তিরই সাহায্য নিচ্ছেন। তাই ডিজিটাল যুগে আধুনিক প্রযুক্তিকে হেলাফেলা করলে চলবে না বলেই মত তাঁর। তবে মিতালির পরামর্শ, প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ যাঁরা জানেন তাঁরাই এর সুবিধা নিতে পারবেন। সাধারণ মানুষ না জেনেবুঝেই নিত্যদিনের সমস্যার সমাধান খুঁজতেও যদি প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে চান, তা হলে তার ফল হিতে বিপরীত হতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy