বিশ্ব জুড়ে ঊনত্রিশ লক্ষেরও বেশি কর্মী এখনও প্রত্যেক বছর তাঁদের কর্মস্থলেই মারা যান, প্রায় চল্লিশ কোটি শ্রমজীবী নানা ভাবে আহত হন কাজের জায়গায়। কর্মস্থলের পরিবেশের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রচুর শ্রমিক, যদিও তাঁদের মাত্র ১৫ শতাংশ যথাযথ স্বাস্থ্য পরিষেবা পান। নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ পাওয়া কর্মী ও শ্রমিকের মৌলিক অধিকার, যা থেকে আজও তাঁরা অনেকেই বঞ্চিত। সে কথা মনে রেখে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ২০০৩ সাল থেকে পালন করে আসছে ‘কর্মস্থলে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য দিবস’, প্রতি বছর ২৮ এপ্রিল যা উদ্যাপিত হয়।
২০২৫ সালে এই দিনটি জোর দিয়েছে ডিজিটাল দুনিয়া এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রমরমার উপর। কৃত্রিম মেধার জন্য অনেক কাজ সহজ ও সংক্ষিপ্ত যেমন হচ্ছে, তেমন তার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে কর্মীরা পড়ে যাচ্ছেন অসম্ভব মানসিক উদ্বেগে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মতো প্রশিক্ষণ ও সহায়তা বহু কর্মী পান না।
ভারতে অবশ্য যে কোনও কর্মস্থলে শ্রমজীবীর নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের প্রশ্ন তুললে তা প্রায় রূপকথার মতো লাগে। সম্প্রতি ঊনত্রিশটি শ্রম আইনকে সংহত করে চারটি শ্রম বিধি তৈরি হয়েছে— মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা, শিল্প সম্পর্ক, এবং পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কর্মক্ষেত্রের পরিস্থিতি। কিন্তু নতুন বিধি প্রণয়নের সময় থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের কতখানি কাজে আসবে এগুলি? কর্মস্থলে শ্রমিকের বঞ্চনার ইতিহাসটা এ দেশে দীর্ঘ। হয়তো শ্রমিক অনেক বলেই তাঁদের কদর কম! গিগ-রানাররা অপরের বোঝা পিঠে নিয়ে দিনরাত ছুটছেন, দুর্ঘটনা এঁদের নিত্যসঙ্গী। গত বছর শুধু গ্রীষ্মকালেই এঁদের একশোজন প্রাণ হারান অসুস্থ হয়ে। চল্লিশ হাজার কর্মীর ‘হিট স্ট্রোক’ হয়।
চিনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আতশবাজি শিল্পের দেশ ভারত। ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বলছে, তার আগের ছ’মাসে দেশ জুড়ে ৭৬ জন বাজি-শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে। দুর্ঘটনা বা বিষাক্ত পরিবেশ, যে কারণেই হয়ে থাক, মৃত্যুর প্রকৃত কারণ তাঁদের কর্মস্থল। বিশ্ব জুড়ে প্রতি বছর কাজের জায়গায় যাঁরা মারা পড়েন, তাঁদের এক-পঞ্চমাংশ কাজ করেন নির্মাণ শিল্পে। ভারতে নির্মাণ-শ্রমিকদের কতজন যথাযথ নিরাপত্তা পান? প্রাণরক্ষার প্রশিক্ষণ ও সামগ্রীর জোগান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নামমাত্র, অথবা তা-ও নয়।
তেমনই বিপদের মধ্যে কাজ করেন খনি-শ্রমিকরা। ১৯৫৬-র ২৬ সেপ্টেম্বর, আসানসোলের বড়ধেমো কয়লাখনিতে ধস নামার পর যে জলপ্লাবন আসে, তাতে কত জন মারা গিয়েছিলেন, কেউ হিসাব রাখেননি। জীবিত এগারো জন উদ্ধার হন দীর্ঘ একুশ দিন পর। এঁদের নিয়ে নাটক ‘অঙ্গার’ মঞ্চস্থ করে উৎপল দত্ত বাংলাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সচেতনতা ১৯৭৫ সালে ধানবাদে চাসনালার দুর্ঘটনা আটকাতে পারেনি— ৩৭৫ জন শ্রমিকের প্রাণ গিয়েছিল সেই খনির বিস্ফোরণ ও বন্যায়। নিচুতলার কিছু কর্মীর শাস্তির পর বিচার প্রক্রিয়ায় কেটে যায় সাঁইত্রিশ বছর। শেষে জীবিত দুই আধিকারিকের এক বছরের জেল ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা হয়। তা-ও আবার জামিন পেয়েছিলেন তাঁরা। ২০১৯ সালে মেঘালয়ে যে পনেরো জন খনি-শ্রমিক মারা যান, ২০২৪ সালে অসমের কয়লাখনিতে যে তিন জন প্রাণ হারান, তাঁরাও যেন আড়ালে চলে গিয়েছেন। আজও নিঃশব্দে যাঁরা পেটের দায়ে বাতিল খনিতে নামেন কিন্তু ফেরেন না, তাঁরা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর এই পরম্পরা ধরে রেখেছেন। কয়লাখনির শ্রমিকের নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্যের জন্য রয়েছে খনি আইন ১৯৫২, যা খনিকর্মীদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, দুর্ঘটনা প্রতিরোধ প্রভৃতির কথা বলে। এই আইনটি এখন পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কর্মক্ষেত্রের পরিস্থিতি (২০২০) বিধির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু আইনের জোর কতটুকু? ২০২০-২০২৪ সালের মধ্যে দু’শোরও বেশি খনি-শ্রমিক প্রাণ হারান।
বিশেষ ভাবে বলতে হয় দেশের মহিলা-শ্রমিকদের সমস্যার কথা। ঋতুকালীন সমস্যার জন্য ছুটি, মাতৃত্বের ছুটি, শিশুর যত্নের পরিকাঠামো, ইত্যাদির জন্য ভারতের কতগুলি কর্মস্থল প্রস্তুত? ‘চাইল্ড কেয়ার লিভ’-এর সদ্ব্যবহারে সততার প্রশ্ন তোলা হয় বারবার। অথচ, বহু শ্রমজীবী নারী মাতৃত্বের ছুটির সুবিধা পান না বলে তাঁদের সন্তানরা অবহেলিত হয়। কর্মস্থলে মহিলাদের নিরাপত্তা কত রকম ভাবে বিঘ্নিত হয়, তা তো প্রায়ই সংবাদে প্রকাশিত হয়। যৌন শোষণ, অপবাক্য প্রয়োগ, অপমান, উপহাস, ধর্ষণ এমনকি হত্যা, অপরাধের তালিকা দীর্ঘ। লিঙ্গবৈষম্যের নিরিখে বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে আমাদের দেশের স্থান শেষের দিকে— ১২৯ নম্বরে। কাজের বাজারের ৪০ শতাংশও ভারতীয় মহিলাদের দখলে নেই। ২০২৪-এর হিসাব বলছে, এ দেশের সমগ্র শ্রমআয়ের মাত্র ১৮ শতাংশের হকদার মহিলারা। কর্মস্থলে যৌন হয়রানি আটকাতে আইন তৈরি হয়েছে ২০১৩ সালে। তবু প্রায় ৪৬ শতাংশ ভারতীয় মহিলাকর্মী কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।
শ্রম বিধি এখনও কার্যকর হয়নি। হলেও ভারতে বহু আইনের মতো চারটি বিধি কেবল কাগুজে প্রতিশ্রুতি হয়ে থেকে যেতে পারে। তবে শ্রমিক নিজে যদি নিজের অধিকার আদায় করতে সংগঠিত হন, তা হলে ছবিটা বদলে যেতে পারে। ‘রক্তকরবী’র ৬৯ঙ-রা নন্দিনী হয়ে উঠতে পারেন। লড়াইটা কিন্তু প্রত্যেক দিনের।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)