মাইগ্রেনের ব্যথা ভোগাচ্ছে কমবয়সিদের। ছবি: সংগৃহীত।
গরম পড়লে মাথাব্যথা, বৃষ্টি নামলে মাথায় যন্ত্রণা, অফিসে জরুরি মিটিং চলছে, দেখবেন হঠাৎ মাথায় ঢিপঢিপ করে ব্যথা শুরু হল। এই মাথাব্যথার সমস্যা যেন একচেটিয়া হয়ে গিয়েছে। আর যেমন-তেমন ব্যথা নয়, যে এক বার হল আর সেরে গেল। এক বার শুরু হলে ব্যথা কমার নামই নেই। একটা গোটা দিন তো বটেই, টানা দুই থেকে তিন দিন ধরে দেখবেন মাথাব্যথা ভোগাচ্ছে। এই ধরনের মাথাব্যথা একটানা চলতে থাকলে চিকিৎসকেরা মাইগ্রেনের ব্যথা কি না তা পরীক্ষা করে দেখেন। একটা সময় মনে করা হত, বয়স্করাই বুঝি এমন ব্যথায় ভোগেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, কমবয়সিদের মধ্যেও মাইগ্রেনের ব্যথা দিন দিন বাড়ছে।
কেন কমবয়সিরা মাইগ্রেনে ভুগছে, তার অনেক কারণও আছে। এখন কাজের চাপ অনেক বেশি, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার দৌড়ে বেশি মানসিক চাপও নিয়ে ফেলছেন কমবয়সিরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল, ল্যাপটপে সময় কাটাচ্ছেন। কাজ থেকে বাড়ি ফিরেও চোখ আর মনের বিশ্রাম নেই। তখনও মোবাইলে চ্যাট বা সিনেমা দেখতে ব্যস্ত। একটানা স্ক্রিনের দিকে চোখ আর মনে পাহাড়প্রমাণ চিন্তাভাবনা, মাইগ্রেনের ব্যথাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তার উপর ভুলভাল খাওয়ার অভ্যাস, নেশা তো আছেই।
তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী মোনালিসা চট্টোপাধ্যায় দীর্ঘ দিন ধরে মাইগ্রেনের ব্যথায় ভুগছিলেন। তিনি বলছেন, আগে কলকাতায় অফিস ছিল। হঠাৎই বেঙ্গালুরুতে স্থানান্তরিত হতে হয়। এক দিকে পরিবর্তিত পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া, অন্য দিকে নতুন অফিসে কাজের চাপ সামলাতে গিয়ে চিন্তাভাবনা অনেক বেড়ে যায়। একটা সময়ে তিনি দেখেন, প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা ভোগাচ্ছে। এই ব্যথা যখন-তখন আসে আর একটানা চলতে থাকে। এক বার যন্ত্রণা শুরু হলে মনে হয় চারপাশটা যেন দুলছে। চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। একটু আলো চোখে পড়লেই মাথা যেন ছিঁড়ে যায়, গা গোলাতে থাকে। কানে কোনও শব্দ নেওয়াই যায় না। মাথা যন্ত্রণা কমাতে একটা সময় সিগারেট খাওয়াও শুরু করেছিলেন মোনালিসা। তাতে ব্যথা আরও বাড়ে। পরে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিয়মিত মেডিটেশন করে আর সিগারেট ছেড়ে দিয়ে এখন অনেক ভাল আছেন।
মাইগ্রেন এখন ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। এই প্রসঙ্গে চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ সৌমেন মণ্ডল জানিয়েছেন, মাইগ্রেনের ব্যথায় বেশি ভোগেন মহিলারাই। কারণ অনেক।
১) ব্যস্ত জীবনে সঠিক ডায়েটের অভাব, শরীরচর্চা করেন না অনেকেই, তার উপর সংসার ও পেশা সামলাতে গিয়ে প্রচণ্ড মানসিক চাপ তো আছেই।
২) মহিলাদের ইস্ট্রোজেন হরমোনের তারতম্য। এই হরমোনটি স্নায়ু এবং মস্তিষ্কের সব ক্রিয়াকলাপে অংশ নেওয়া রাসায়নিকের উপর প্রভাব ফেলে। সেখান থেকেই মাইগ্রেনের যন্ত্রণার সূত্রপাত।
৩) কোনও মহিলার পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম থাকলে বা হরমোনজনিত সমস্যা থাকলে, তার থেকেও মাইগ্রেনের ব্যথা হতে পারে।
৪) গর্ভনিরোধক ওষুধ একটানা বেশি খেলেও তার থেকে মাইগ্রেন হতে পারে। এই ধরনের ওষুধ শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বিগড়ে দিতে পারে।
৫) জিনগত কারণেও মাইগ্রেনের ব্যথা হতে পারে। পরিবারে কারও থাকলে, সে থেকেও এই ব্যথা চাগাড় দিতে পারে।
দেবস্মিতা সদ্য বিয়ে করেছেন। ঘন ঘন গর্ভনিরোধক পিল খাচ্ছিলেন। আর সেটা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই। সেই সঙ্গে সিগারেট খাওয়া তো ছিলই। একটা সময়ে গিয়ে দেখেন, প্রচণ্ড মাথাব্যথা ভোগাচ্ছে তাঁকে। প্রথমে ভেবেছিলেন রোদে ঘুরে মাথাব্যথা। পরে দেখেন, ব্যথাটা যখন-তখন হচ্ছে। আর দীর্ঘ সময় ধরে থাকছে। ভয় পেয়ে চিকিৎসকের কাছে যান। ভেবেছিলেন ব্রেন টিউমার হয়েছে, পরে ধরা পড়ে মাইগ্রেন। চিকিৎসকও তাঁর জীবনযাপনের ধরন খুঁটিয়ে জেনে ধরতে পারেন ব্যথার কারণ বেশিমাত্রায় গর্ভনিরোধক বড়ি এবং অবশ্যই ধূমপান।
মাইগ্রেন হল ‘নিউরোলজিক্যাল’ রোগ। চিকিৎসকেরা বলেন, মাথার এক দিকেই ব্যথা হয় বেশি। সারা ক্ষণ দপদপ করতে থাকে। সাধারণত ৪৮ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা অবধি ব্যথা থাকতে পারে।
মাইগ্রেনের ব্যথার অনেক রকম লক্ষণ আছে। সকলের ক্ষেত্রে যদিও এক নয়। আইটি কর্মী মিতালি বিশ্বাস গত কয়েক মাস যাবৎ মাইগ্রেনের ব্যথায় ভুগছেন। তিনি জানিয়েছেন, অফিসে কাজের ফাঁকে প্রচুর চা ও কফি খেতেন। শুরুতে বোঝেননি। পরে দেখেন, যত বার কফি খাচ্ছেন, মাথায় ব্যথা শুরু হচ্ছে। ব্ল্যাক কফি খেয়েও দেখেছেন ব্যথা কমেনি। মিতালি জানিয়েছেন, যখন মাথায় ব্যথা হত, তখন মনে হত মাথার পিছন দিকে ও ঘাড়েও ব্যথা হচ্ছে। তিনি চোখ খুলে রাখতে পারতেন না। ব্যথা হলেই শুয়ে পড়ার চেষ্টা করতেন। অফিসে থাকলে বিশ্রাম কক্ষে চলে যেতেন আর বাড়িতে থাকলে ঘরের আলো নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে থাকতেন। তাতে কিছুটা আরাম হত। লোকজনের থেকে শুনে মাথাব্যথার ওষুধ খেয়েও সারেনি তাঁর। পরে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে মাইগ্রেনের জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ খেয়ে ও চা-কফি খাওয়া কমিয়ে দিয়ে এখন ভাল আছেন।
মাইগ্রেন যাদের আছে, তাদের সব সময়েই সতর্ক থাকতে হয়, এমনটাই মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী। তাঁর মতে, এই রোগ যে হেতু নাছোড়বান্দা, তাই সচেতনতাই এর আসল দাওয়াই। রক্তচাপ যাদের বেশি, তাদের মাইগ্রেনের ব্যথা যখন-তখন বেড়ে যেতে পারে। বেশি চিন্তা, মানসিক চাপ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা শুরু হলে তখন রক্তচাপের হেরফের হয়। সে কারণেও ব্যথা বাড়ে। কখন কোন খাবার থেকে ব্যথা হচ্ছে, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হয়। কারও চা-কফি থেকে ব্যথা বাড়ে, কারও সিগারেট বা মদ্যপান করলে ব্যথা বেড়ে যায়। আবার ঠান্ডা নরম পানীয় খেয়ে মাইগ্রেন বেড়েছে, এমনও দেখা গিয়েছে।
হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনা যদি মনে ধাক্কা দেয়, তার থেকেও মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়তে পারে। মানসিক চাপ যত বাড়বে, ততই ব্যথার প্রকোপ বাড়বে। তাই মন হালকা রাখা আর অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা না করারই পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
মাইগ্রেনের কোনও চিকিৎসা আছে কি?
মাইগ্রেনের ব্যথা হলে অনেকেই যন্ত্রণা প্রশমনের ওষুধ খান। চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞের মতে, এই ব্যথা পুরোপুরি সারে না। নির্দিষ্ট কিছু ওষুধে ব্যথা কমানো যায় মাত্র। তাড়াতাড়ি রোগ নিরাময় করতে হলে যন্ত্রণার উৎস খুঁজে বার করা প্রয়োজন। প্রচণ্ড রোদ লাগলে, ঘুম কম হলে কিংবা অতিরিক্ত মানসিক চাপ হলে ব্যথা কয়েক গুণ বেড়ে যেতে পারে। তাই কী কারণে মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে, তা জানতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। দীর্ঘ দিনের মাথাব্যথাকে গ্যাস-অম্বলের কারণে ব্যথা বা সাইনাসের ব্যথা বলে ফেলে রাখেন অনেকে। পরে দেখা যায় মাইগ্রেন মারাত্মক ভাবে বেড়ে গিয়েছে। আবার ব্রেন টিউমারের কারণে মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হতে পারে। তারও একটি উপসর্গ হতে পারে মাইগ্রেনের ব্যথা। তাই মাথা যন্ত্রণা একটানা হতে থাকলে ফেলে না রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।
এমন অনেক সুগন্ধি আছে, যা রোগীর যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেয়। এগুলি সব সময়ে ব্যক্তিভিত্তিক। তাই রোগীকে বুঝতে হবে, কোন খাবারে সমস্যা হচ্ছে, কোন গন্ধে ব্যথা বাড়ছে। তবেই চিকিৎসক সাহায্য করতে পারবেন।
খাদ্যাভ্যাস বদলে মাইগ্রেন নিয়ন্ত্রণ করা যায়। চিকিৎসকেদের পরামর্শ, যাঁদের মাইগ্রেন রয়েছে, অতিরিক্ত কফি তাঁদের জন্য ক্ষতিকর। তবে মাইগ্রেনের অনেক ওষুধে কফির উপাদান থাকে। তাই পরিমিত কফি মাইগ্রেনের ব্যথায় উপশম দেয়। চকোলেট, রেড ওয়াইন, ড্রাই ফ্রুটস, চিজ় জাতীয় খাবারও তাঁরা এড়িয়ে চললে ভাল।
অতিরিক্ত মদ্যপান মাইগ্রেন বাড়িয়ে দিতে পারে। সে দিকেও নজর দেওয়া জরুরি।
মাইগ্রেনের রোগীরা অনেক সময়ে আলো সহ্য করতে পারেন না। চোখ যেন ঠান্ডা থাকে, সেই জন্য টিন্টেড গ্লাসের চশমা তাঁদের দেওয়া হয়। এতে রোগীর চোখ অনেক আরাম পায়।
কোনও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কারণ হতে পারে। তাই চিকিৎসকের কাছে গেলে, আপনি কী কী ওষুধ খান বা খাচ্ছেন, সেটা বলে নিতে ভুলবেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy