সমাজমাধ্যমে সঙ্গীতশিল্পীদের অনুষ্ঠানের প্রচারের নেপথ্যে কী কারণ? গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
শীতের মরসুম। বছরশেষে শহর থেকে মফস্সল, পাল্লা দিয়ে বাড়বে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন। সেই সঙ্গে বাড়বে শিল্পীদের অনুষ্ঠানের প্রচার। এক সময় প্রিয় শিল্পীর অনুষ্ঠানের খবর অনুরাগীর কাছে ঠিকই পৌঁছে যেত। কিন্তু সমাজমাধ্যমের বাড়বাড়ন্তে এখন বদলে গিয়েছে পরিস্থিতি। কবে, কোথায়, কখন অনুষ্ঠান— শুধু এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েই ক্ষান্ত থাকছেন না শিল্পীরা। ‘কাউন্টডাউন’ থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানের পরে সেখানকার ছবি, রিল ভিডিয়ো, অনুরাগীদের প্রতিক্রিয়া— সবই জায়গা করে নিচ্ছে তাঁদের সমাজমাধ্যমের পাতায়। কিন্তু এই ‘প্রচার’-এর নেপথ্যে কারণ কী? তা কি শুধুই নতুন প্রজন্মের চোখে ‘প্রাসঙ্গিক’ থাকার স্বার্থে? না কি সমাজমাধ্যমে অনুষ্ঠানের প্রচার সেরে শিল্পীর আখেরে কোনও লাভ হয়? বাংলা সঙ্গীতজগতের জনপ্রিয় কয়েক জন সঙ্গীতশিল্পীর সামনে আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে রাখা হয়েছিল কিছু প্রশ্ন।
শিল্পী অনুপম রায়ের কনসার্ট ঘিরে নতুন প্রজন্মের উন্মাদনা সব সময়েই থাকে। সমাজমাধ্যমে তাঁর কনসার্টের প্রচারও নজরকাড়া। এই নতুন ‘ট্রেন্ড’ কি পাশ্চাত্য শিল্পীদের অনুকরণের ফল? অনুপম এই বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত হতে পারলেন না। বললেন, ‘‘ওদের সঙ্গে আমাদের কনসার্টের পার্থক্য রয়েছে। ওদের ওখানে শিল্পীদের টিম থেকে ‘ট্যুর’ ঘোষণা করা হয়। আমরা এখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাক পাই। সেখানে মেলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কলেজের ফেস্ট পর্যন্ত রয়েছে।’’ একই সঙ্গে অনুষ্ঠানের ছবি, ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে পোস্ট করার বিষয়টা কখন কনসার্টের অংশ হয়ে উঠেছে, তা শিল্পীদের অজান্তেই ঘটেছে বলে মনে করছেন অনুপম।
অনুপম জানালেন, অনুষ্ঠানের রিল, ছবি এবং সমাজমাধ্যমে তা সঠিক ভাবে পোস্ট করার জন্য আলাদা টিম থাকে। তাঁর কথায়, ‘‘শিল্পীর কাজ গান করা। সেখানে এই বিষয়গুলোর প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে, কারণ অনুরাগীরাও এগুলো দেখতে পছন্দ করেন।’’ এরই সঙ্গে অনুপম যোগ করলেন প্রচার প্রসঙ্গ। তাঁর যুক্তি, ‘‘শিল্পীদের সব অনুষ্ঠান সংবাদমাধ্যমে খুব বেশি প্রচার পায় না। তাই মনে হয়, শিল্পীরা বিজ্ঞাপনের বিষয়টা নিজেদের হাতেই তুলে নিয়েছেন।’’ সমাজমাধ্যমে প্রচারের ফলে শিল্পীদের শো পেতে সুবিধা হয় কি না, এই প্রশ্নের উত্তর অনুপম ভবিষ্যতের হাতেই ছেড়ে দিতে চাইছেন। তবে তাঁর পাল্টা যুক্তি, ‘‘আমি পরিচিত। আমার হয়তো প্রচার না করলেও ডাক আসবে। কিন্তু এমন অনেক শিল্পী রয়েছেন, যাঁদের হয়তো কেউ চেনে না। তাঁরা ভাল ভাবে প্রচার করতে পারলে কিন্তু মানুষ জানতে পারবেন যে, তাঁদের শোয়ে ঠিক কী কী হয়। এটা তো কোনও নতুন শিল্পীর কাছে একটা বড় সুবিধা।’’
সঙ্গীতশিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তী নিজে সমাজমাধ্যমে নেই। কিন্তু তা বলে তাঁর অনুষ্ঠানের প্রচার কিন্তু থেমে থাকে না। মূলত শিল্পীর ফ্যানক্লাব ‘আগুনপাখি’র তরফেই সমাজমাধ্যমে তাঁর অনুষ্ঠানের প্রচার সারা হয়। নচিকেতা বিষয়টিকে ‘সময়ের দাবি’ হিসেবেই উল্লেখ করলেন। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষ তো এখন ফোনেই বেশির ভাগ সময় কাটান। তাই হয়তো এই ধরনের প্রচারও বেড়েছে। আমি নিজে একটা ক্যাবলা ফোন ব্যবহার করি। এগুলো কী ভাবে করতে হয়, সেটা আমি নিজে জানিও না।’’ সমাজমাধ্যমে প্রচার করে শোয়ের সংখ্যা বাড়ে বলে মনে করেন না নচিকেতা। তাঁর কথায়, ‘‘নজরকাড়া ছবি বা ভিডিয়ো থেকে দেশের মানুষ হয়তো জানলেন যে, আমি অমুক জায়গায় অনুষ্ঠান করেছি। কিন্তু আমার শোয়ের সংখ্যা আগে যা ছিল, এখনও তো তা-ই আছে।’’
শিল্পীদের এই নতুন প্রবণতার বিপরীত পথেই হাঁটতে পছন্দ করেন শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিল্পীর অনুষ্ঠানের প্রচার তাঁর কাছে ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’। বর্তমান সময়টা প্রচারসর্বস্ব বলেই মনে করেন শিল্পী। কিন্তু, নিজের ক্ষেত্রে তিনি সমাজমাধ্যম থেকে দূরত্ব বজায় রাখার পক্ষপাতী। কখনও কোনও গান গেয়ে পছন্দ হলে তাঁর ঝলক পোস্ট করে থাকেন ফেসবুকে। কিন্তু নিয়মমাফিক প্রচারে তাঁর আপত্তি রয়েছে। শ্রীরাধা বললেন, ‘‘আমি যখন গানের জগতে এসেছিলাম, তখন প্রচার থাকলেও তার ব্যাপকতা আজকের মতো ছিল না।’’ তিনি আরও বললেন, ‘‘আমি খুবই সাধারণ। কিন্তু আমার নিজের কিছু বিশ্বাস রয়েছে। গান আমার কাছে সাধনা। যাঁদের কাছে গান শিখেছি, তাঁদেরও হয়তো প্রচারের প্রয়োজন ছিল না। তাই মাসে ক’টা অনুষ্ঠান করব, সেই লক্ষ্যমাত্রা চিন্তা করে কখনও এগোইনি।’’ যাঁরা তাঁর গান ভালবাসেন, কোনও প্রচার ছাড়াই তাঁদের তরফে ডাক পাবেন বলেই বিশ্বাস করেন এই শিল্পী।
এখন বাংলা সঙ্গীতজগতে বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা বহু শিল্পীর প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। সেই প্রসঙ্গ তুলেই সঙ্গীতশিল্পী রূপঙ্কর বাগচী বললেন, ‘‘সংস্থাগুলো দাবি করে যে, এখন প্রাসঙ্গিক থাকতে হবে। দেখতে পাচ্ছি, আগে সংবাদমাধ্যমে শিল্পীর ছবি প্রকাশিত হলে শিল্পীদের যে প্রতিক্রিয়া দেখা যেত, সেটা এখন সমাজমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে।’’ নিজেকে ‘প্রথম সারির শিল্পী’ হিসেবে উল্লেখ করতে নারাজ রূপঙ্কর বললেন, ‘‘এ রকমও শিল্পীও তো রয়েছেন, যাঁরা পঞ্চম বা ষষ্ঠ সারিতে রয়েছেন। তাঁদের হয়তো কোনও গানই জনপ্রিয় হয়নি। কিন্তু সমাজমাধ্যমে কিন্তু তাঁরা বেশ জনপ্রিয় এবং অনেকে প্রচুর অনুষ্ঠান করেন।’’
কথাপ্রসঙ্গেই টলিপাড়ায় ইদানীং সমাজমাধ্যমে ফলোয়ারের সংখ্যার নিরিখে সুযোগ দেওয়ার প্রবণতার কথা উল্লেখ করলেন রূপঙ্কর। তবে বললেন, ‘‘পাঁচ-ছ'বছর আগেও নিজের এত ছবি তুলিনি, আজকে আমাকে যা তোলাতে হচ্ছে! সংস্থাগুলো দাবি করে, সমাজমাধ্যমে ছবি বা ভিডিয়ো দিলে শ্রোতারা নাকি আরও বেশি আকৃষ্ট হন। কিন্তু তার ফলে শোয়ের সংখ্যা বাড়ছে কি না, তা নিয়ে এখনও আমার সঠিক ধারণা নেই।’’ রূপঙ্কর আরও বললেন, ‘‘সমাজমাধ্যমে আমার এমন অনেক জনপ্রিয় গান রয়েছে, তা নিয়ে লাইভ কনসার্টে শ্রোতাদের তরফে অনুরোধ পাই না। তার মানে, সমাজমাধ্যমের সেই শ্রোতারা কি লাইভ কনসার্টে আসেন না?’’ বর্তমান সময়ে সমাজমাধ্যম থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। সে কথাই মনে করিয়ে দিলেন রূপঙ্কর। এই বিষয়ে সঙ্গীতশিল্পী ইমন চক্রবর্তীও সহমত পোষণ করলেন। সমাজমাধ্যমে ইমনও নিয়মিত তাঁর শোয়ের প্রচার করেন। শিল্পীর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘সমাজমাধ্যম এখন আমাদের জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই সমাজমাধ্যমকে আমি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি।’’
সময়ের সঙ্গে বাংলায় সঙ্গীতানুষ্ঠানের রীতিনীতিতে যে বদল ঘটেছে, তা স্বীকার করে নিলেন শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র। বললেন, ‘‘আগে যখন অনুষ্ঠান করতাম, তখন উদ্যোক্তারা যেটুকু প্রচার করতেন, সেটাই ছিল সম্বল।’’ লোপামুদ্রা বিশ্বাস করেন, নিজের ঢাক নিজে পেটানোর মধ্যে কোনও সমস্যা নেই। তাঁর কথায়, ‘‘আমার সমসাময়িক অনেক শিল্পীই এই ধরনের প্রচার করেন না, আমি করি। কারণ মানুষের মানসিকতাই তো এখন নির্ধারণ করে দিচ্ছে ফেসবুক! সমাজমাধ্যমই যেন শেষ কথা বলছে!’’
লোপামুদ্রা আরও জানালেন, সমাজমাধ্যমে প্রচারের ক্ষেত্রেও অনেক রকম সমস্যা রয়েছে। বললেন, ‘‘এটা এআইয়ের যুগ। সেখানে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করা গানগুলোরও তো নকল হতে পারে। মজার বিষয়, আমাদের যে রিল ভিডিয়ো পোস্ট করা হয়, তার সঙ্গে কিন্তু নিজেদের মৌলিক গান দিতে পারি না কপিরাইট আইনের জন্য। সেখানেও মেটা থেকে দেওয়া গানের মধ্যে থেকেই আমাদের বেছে নিতে হচ্ছে। সেটা কিন্তু রেকর্ড করা গান। সত্যিই খুবই অদ্ভুত একটা সময়ের মধ্যে রয়েছি।’’ বিষয়টি নিয়ে নিজের দলের সঙ্গেও এক সময় মতানৈক্য হয়েছিল শিল্পীর। লোপামুদ্রা জানালেন, প্রত্যেকেরই মত, এই ভাবে প্রচার না করলে নাকি এখন শিল্পীকে অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগতে হবে। লোপামুদ্রা বললেন, ‘‘আমি অন্য একটা ফোন নম্বর দিয়েও দেখেছি, ফোন কিন্তু আসছে। তার মানে, কোথাও কিন্তু সমাজমাধ্যম শিল্পীকে একটু হলেও সুবিধা দিচ্ছে।’’ তবে শিল্পী মনে করিয়ে দিলেন, দিনের শেষে সঙ্গীতই শেষ কথা বলে। তাই শুধু প্রচারের উপর ভরসা করে খুব বেশি দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy