শ্যুটিংয়ের দ্বিতীয় দিনে বাড়ির উপরের বারান্দায় বসেছে এস্রাজের আসর। 'বেলাশুরু' পরিবারের সবাই শুনছেন বিজনের বাজনা। বিজন, অর্থাৎ সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। শ্যুটিংয়ের আগে শেষ মহড়া দিয়ে নিচ্ছে সে। নিজের কাজের ব্যাপারে বিজন বরাবরই খুব সিরিয়াস। আপ্রাণ তালিম নিয়ে যাচ্ছে এস্রাজে।
‘বেলাশেষে’-র সময় যখন আমরা 'তুমি তবে নীরবে' গানটি এস্রাজে ব্যবহার করেছিলাম, শ্যুটিংয়ের শটের শেষে সৌমিত্রদা বলেছিলেন, "চোখের জলটা পেয়েছ?" মনিটরে অবশ্য বোঝা যাচ্ছিল না, সৌমিত্রদা বললেন, "বড় পর্দায় পাবে। চোখে চিকচিক করছে, আমি জলটা ফেলিনি।"
রবীন্দ্রনাথের গান, তা-ও আবার এস্রাজে বাজানো। প্রথম সম্পাদনা হয়ে যাওয়ার পরেই জনৈক ছবি প্রযোজক, অপ্রধান সহকারী বললেন, "এ সব আজকের দিনে চলে না। ওই এস্রাজের জায়গাটা বাদ দেওয়া উচিত, অহেতুক দীর্ঘায়িত করছে সিনেমাকে।"
আমরা কথা রাখতে পারিনি তাঁদের, ছবিতে পুরোটাই রেখেছিলাম। ইউটিউবে সামগ্রিক দর্শক সংখ্যা এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষের বেশি। 'বেলাশেষে' আরও একবার প্রমাণ করেছিল রবীন্দ্রনাথের গান আজও কোথায় পৌঁছে দিতে পারে একটি সিনেমাকে।
শুভায়ু সেন মজুমদার, আমার মনে হয় ওর হাতে জাদু আছে। 'বেলাশেষে' আর 'বেলাশুরু'র সব এস্রাজের গান ওরই বাজানো। শুভায়ু যখন এস্রাজে রবীন্দ্রনাথের গান বাজায়, তখন সেটা আলাদা মাত্রা পায়। ওর বাজনার সঙ্গে একটা ভাগ্যের ব্যাপারও কাজ করে। 'মুক্তধারা', 'অলীক সুখ', 'রামধনু', 'বেলাশেষে', 'প্রাক্তন', 'পোস্ত'—আমার সব সিনেমাতেই ওর বাজনা রয়েছে। 'বেলাশুরু'তেও তাই দ্বিগুণ উৎসাহে আরও সাহস নিয়ে আমরা আবারও ব্যবহার করেছি রবীন্দ্রনাথের গান।
এস্রাজে বেজেছে, 'ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা প্রভু তোমার পানে'। ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ২৮ জৈষ্ঠ্য রবীন্দ্রনাথ এই গান লিখেছিলেন। পূজা পর্যায়ের গান এটি। বিজনের এস্রাজ মোহিত হয়ে বসে শুনছে সকলে। ক্যামেরা ট্রলিতে, এগোচ্ছে। সৌমিত্রদা, মানে বিশ্বনাথ আর বুড়ির শট। বুড়ি, অপরাজিতা আঢ্য। বাবার হাতটা জড়িয়ে সে বসে আছে। বাবার কাঁধে মাথাটা রেখে। বেলাশেষেতে যে জল চোখে আটকে ছিল, সাত বছর পর বেলাশুরুতে অঝোর ধারায় সৌমিত্রদার চোখ বেয়ে পড়ছে।
বিশ্বনাথ তার মেয়েকে দমদমের এক দম্পতির কথা বলছে। পবিত্র চিত্ত নন্দী আর অঙ্কিতা নন্দীর গল্প। ওদের দুজনের গল্পই 'বেলাশুরু'র অনুপ্রেরণা। পবিত্রদা তাঁর স্ত্রীকে সারা পৃথিবী ঘুরিয়েছেন। ২১ বার পুরী নিয়ে গিয়েছেন। কত স্মৃতি তাঁদের জীবনে। বিশ্বনাথ বলছে, "আর আমার জীবনে তো কিছুই নেই! ৫০ বছরের বিবাহিত জীবনে কোনও স্মৃতি নেই, আরতিকে দেখানোর মতো।"
বিশ্বনাথ কাঁদছে। সব থেমে গিয়েছা। দু‘জনের চোখে জল। সৌমিত্রদা চশমা খুললেন দুটো চোখ ভিজে গেছে। মনিটরের পাশে স্বাতীদি। আরতি বিশ্বনাথকে দেখছে।
মহামারির সময়ে সৌমিত্রদা তখন হাসপাতালে ছিলেন, শেষ বারের মতো। ড: অরিন্দম কর, ওঁর চিকিৎসা করছিলেন। অরিন্দম আমার ভাল বন্ধু। একদিন ফোন করে বলল, মিউজিক থেরাপি করতে চায়। সৌমিত্রদার পছন্দের কিছু গান পেনড্রাইভে দিতে পারব নাকি জিজ্ঞাসা করল। যদি গান শুনে মস্তিষ্কে কোনও স্পন্দন ফিরে আসে?
আমি কিছু গান পাঠিয়েছিলাম, তার মধ্যে ‘তুমি রবে নীরবে’ যেটা ‘বেলাশেষে’তে ছিল সেটাও। ‘বেলাশুরু’র অপ্রকাশিত এই দুটো গান, 'ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা' আর 'রাখ রাখ রে, জীবনবল্লভে'—এই দুটো গানও ওতে রাখা ছিল।
আমি জানি না, আমরা কেউ জানি না, শেষ কোন গান সৌমিত্রদা হাসপাতালে শুনেছিলেন। জানি না, শেষ কোন গান ওঁর প্রাণে স্পন্দন জাগিয়েছিল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy