Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Satyajit Ray

সেটে গিয়েই ইচ্ছে হয়েছিল সত্যজিৎ রায়কে একবার ছুঁয়ে দেখব: দেবর্ষি দত্তগুপ্ত

‘গুপী বাঘা ফিরে এল’ ছবির ১২ জন বিক্রমের অন্যতম দেবর্ষি দত্তগুপ্ত অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন আনন্দবাজার ডিজিটালের সঙ্গে।

‘গুপী বাঘা ফিরে এল’ ছবিতে বিক্রমের ভূমিকায় দেবর্ষি। এখন আর তিনি অভিনয় করেন না।

‘গুপী বাঘা ফিরে এল’ ছবিতে বিক্রমের ভূমিকায় দেবর্ষি। এখন আর তিনি অভিনয় করেন না। ফাইল চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২১ ১৩:১৯
Share: Save:

তিনি সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায়ের স্কুলে পড়তেন। সেই সুবাদে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন ‘গুপী বাঘা ফিরে এল’ ছবিতে। সেটে গিয়ে তাঁর ইচ্ছে, জ্যান্ত সত্যজিৎ রায়কে ধরে দেখবেন! তার পরে? ছবির ১২ জন বিক্রমের অন্যতম দেবর্ষি দত্তগুপ্ত অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন আনন্দবাজার ডিজিটালের সঙ্গে।

প্রশ্ন: সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সরাসরি কাজ করেছেন?

দেবর্ষি: সন্দীপ রায়ের ‘গুপী বাঘা ফিরে এল’ ছবিতে যে ১২ জন ছোট ছেলেকে তান্ত্রিক দাদু অপহরণ করেছিলেন, তাদেরই এক জন ছিলাম আমি। ছবিটি সন্দীপবাবু পরিচালনা করলেও মানিক জেঠু সেটে সব সময়ে থাকতেন।

প্রশ্ন: কী ভাবে যোগাযোগ হল?

দেবর্ষি: অনেকেই জানেন না, সত্যজিৎ রায়ের ছবির সব শিশু শিল্পী পাঠভবনের পড়ুয়া। কারণ, সন্দীপ রায় পাঠভবন থেকে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে আমিও তা-ই। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে। এক দিন ক্লাসেই শিক্ষকের সঙ্গে আমাকে দেখতে এলেন পূর্ণেন্দুদাদু। মানিকজেঠুর সঙ্গে কাজ করতেন তিনি। আমি খুব দুষ্টু ছিলাম। ভেবেছিলাম, আমাকে বুঝি শাস্তি দিতে এসেছেন। এক সপ্তাহ পরে তাঁরা আমার বাড়ি এলেন। আমি নিশ্চিত, বাড়িতে নালিশ এসেছে। দুষ্টুমির জন্য স্কুল থেকে বার করে দেওয়া হবে। পরে জেনেছিলাম, ওঁরা মা-বাবার অনুমতি নিতে এসেছিলেন। আরও মজার ব্যাপার, আসল বিক্রম ছাড়া বাকি ১২ জন বিক্রমই পাঠভবনের!

প্রশ্ন: তার পর?

দেবর্ষি: পুজোর ঠিক আগে ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয় টানা ১৬ দিন শ্যুটিং করেছিলাম। প্রথম দিন গিয়েই মুখোমুখি মানিকজেঠুর। সত্যজিৎ রায় আমার কাছে তখন ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু। ভগবানতুল্য ব্যক্তিত্ব। বাড়ির সকলেই ওঁর অন্ধ ভক্ত। ঠাকুরমা আমাকে ছবিতে কাজ করার অনুমতি দিয়েছিলেন শুধু ওঁর নাম শুনে।

প্রশ্ন: কেমন দেখলেন?

দেবর্ষি: বিশাল লম্বা এক জন মানুষ। স্টুডিয়োর ফ্লোরে এক কোণে বসে থাকতেন। হাতে মোটা খাতা। তাতে সব লিখে রাখতেন। প্রচণ্ড গম্ভীর। আমরা ভয়ে ধারপাশে ঘেঁষতামই না। খুব ইচ্ছে করত, এক বার সত্যিকারের সত্যজিৎ রায়কে ধরে দেখব, মানুষটা কেমন! ভয়ের চোটে সেটাও হয়ে উঠছিল না। ৩-৪ দিন পরে অনেক সাহস করে সন্দীপকাকুকে মনের ইচ্ছে জানালাম। ততদিনে তিনি, ললিতাকাকিমা ‘কাছের মানুষ’ হয়ে গিয়েছেন। শুনে দু’জনেই হেসে ফেলেছিলেন। তার পর আমাদের কয়েক জনকে নিয়ে গেলেন মানিকজেঠুর কাছে। পায়ে হাত দিতেই আদর। কিন্তু তখনও কী গম্ভীর! তবে এটা বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি আমাদের বেশ পছন্দ করছেন।

প্রশ্ন: রায় পরিবার শিল্পীদের নাকি প্রচণ্ড যত্ন করেন?

দেবর্ষি: যত্নের বহর দেখে আমাদের মাথা ঘুরে গিয়েছিল। দুপুরের খাবারে এলাহি আয়োজন। এক দিন মাছ হলে পরদিন পাঁঠার মাংস। ১৬ দিনের শ্যুটিংয়ে ১২ বিক্রমের দু’জনের জন্মদিন ছিল। সেটে কেক কেটে উদ্‌যাপন হয়েছিল। ‘‘বিকেলে তোরা কী খাবি?’’ জিজ্ঞেস করা হত আমাদের। আইসক্রিম, চকোলেট তো অফুরন্ত। সবটাই কিন্তু মানিকজেঠুকে জিজ্ঞেস করে সন্দীপকাকু করতেন। তার পরেও আমাদের সম্মান দিয়ে আমাদের ইচ্ছার কথা জানতে চাওয়া হত। একদিন সকলের মা-বাবাকেও শ্যুটিং দেখার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। দুপুরে খেতে দেওয়া হয়েছিল ওরকম এলাহি খাবার। সব দেখেশুনে মা-বাবারা নিশ্চিন্ত, ছেলেরা বাড়ির থেকেও বেশি যত্নে আছে।

প্রশ্ন: সত্যজিৎ রায়ের কাছে বায়না করেননি?

দেবর্ষি: ওঁকে কিছু বলার সাহসই হয়নি কোনও দিন। তবে সন্দীপকাকুর কাছে বায়না করেছিলাম। ষষ্ঠীর দিন আমাদের শেষ শ্যুটিং ছিল। কাজ মিটতেই সবাই ধরেছিলাম, আমরা ঠাকুর দেখতে যাব। সন্দীপকাকু আর কাকিমা বাস ভাড়া করে উত্তর কলকাতার সব ঠাকুর দেখিয়েছিলেন।

প্রশ্ন: এত ভয় পেতেন! সত্যজিৎ রায় খুব বকুনি দিতেন?

দেবর্ষি: আমাদের ৩০-৪০ বার শট নিতে হলেও মানিকজেঠু বা সন্দীপকাকু রাগ করতেন না। তা ছাড়া, ওঁরা এত ভাল ভাবে বোঝাতেন যে ভুল আমরা খুব কমই করতাম। কিন্তু বড়দের ছাড় ছিল না। একবার আমার কোমরে বাঁধা গামছার গিঁট লাঞ্চ ব্রেকের পরে ভুল দিকে বাঁধা হয়েছিল। সেটে আমরা যে গুহার মধ্যে শট দিচ্ছি, সেখানে আলো-আঁধারি। তার মধ্যেও সেই ভুল চোখে পড়েছিল মানিকজেঠুর। সঙ্গেসঙ্গে ওই রকম গলায় কী জোর বকুনি! আমি খুব অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, মানিকজেঠুর চোখে কি সত্যি সত্যি মানিক জ্বলে? তাই অন্ধকারের মধ্যেও ভুলটা দেখতে পেয়েছিলেন! বড় হয়ে বুঝেছি, ভীষণ খুঁতখুঁতে ছিলেন। তাই ভুল একেবারে মেনে নিতে পারতেন না।

প্রশ্ন: আপনাদের সঙ্গে বসে গল্প করতেন তিনি?

দেবর্ষি: অসুস্থতার জন্য তত দিনে ওঁর হাঁটাচলা খুব সীমিত হয়ে গিয়েছিল। তাই চুপ করে এক দিকে বসে সবটা দেখতেন। একবার আমাদের খাওয়ার সময়ে এসেছিলেন। আর ১ বন্ধুর জন্মদিনে কেক কাটার সময়েও ছিলেন। যদিও আমাদের সঙ্গে খাননি। আর কথা কারও সঙ্গেই তেমন বলতেন না।

প্রশ্ন: আর কোনও ছবিতে কাজ করেছেন?

দেবর্ষি: বাড়ি থেকে আর অনুমতি পাইনি। তা ছাড়া, আমিও অভিনয়ে আগ্রহী নই।

প্রশ্ন: পারিশ্রমিক কী পেয়েছিলেন?

দেবর্ষি: একটা ঘড়ি আর খামে ভরা ৫০ টাকার ১০টা নোট। মানে ৫০০ টাকা। একটা টাকাও তার থেকে খরচ করিনি। খাম ভর্তি যেমন ছিল, আজও তেমনই আছে। খামের উপরে জেঠু নিজে হাতে নাম লিখে দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন: সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় কাজ করা হল না, আফসোস হয়?

দেবর্ষি: আমার অন্য আফসোস। প্রিমিয়ারে আমাদের সকলের নিমন্ত্রণ ছিল। ছবি দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছিল, বিরতির সময়ে প্রেক্ষাগৃহের সকলে আমাকে চিনতে পারবেন। ডেকে কথা বলবেন আমার সঙ্গে। বিরতি হল। আলো জ্বলল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কেউ চিনতেই পারলেন না! খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মা-বাবা অনেক দিন পর্যন্ত তাই নিয়ে মজা করেছন। তবে স্কুলে বন্ধুদের কাছে খুব কদর বেড়ে গিয়েছিল। সত্যজিৎ রায়ের ছবির অভিনেতা বলে কথা। আমি কি আর যে সে ছেলে!

অন্য বিষয়গুলি:

Satyajit Ray film Bengali Cinema
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy