পাঁচ বছর আগে। সমবায় ব্যাঙ্কের সামনে রাজনৈতিক দলের বিক্ষোভ। মেদিনীপুর, ২০০৯।
দুঃখে বাঙালির গতি রবীন্দ্রনাথ। গত ১৫ জুন বীরভূমের কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কে তালা পড়ল। ফলে ৩৩৩টি কৃষি সমবায় সমিতি, আড়াই লক্ষ ছোট চাষির মাথায় হাত। ৩৫০ কোটি টাকার আমানতের নাগাল হারিয়ে ফের মহাজনের দ্বারস্থ বীরভূমের চাষি। মনে পড়ল, কালীমোহন ঘোষকে চিঠিতে (১৯৩০) রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “সুদীর্ঘকাল থেকে সমবায় নীতির পরেই আমার সকলের চেয়ে আশা ছিল কিন্তু সকলের চেয়ে এইটেই ব্যর্থ হয়েছে।”
বন্ধুদের থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে পতিসরে গরিব চাষিদের জন্য ব্যাঙ্ক খুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ (১৯০৫)। মূলধনের অভাব দূর করতে নোবেল প্রাইজের টাকার একটা বড় অংশ (৮২ হাজার টাকা) রেখেছিলেন সেখানে। রথীন্দ্রনাথ ‘পিতৃস্মৃতি’ বইয়ে লিখছেন, “কৃষিব্যাঙ্ক হয়ে প্রজাদের খুব উপকার হল কয়েক বছরের মধ্যেই তারা মহাজনদের দেনা সম্পূর্ণ শোধ করে দিতে পেরেছিল। কালীগ্রাম এলাকা থেকে মহাজনরা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হয়েছিল।”
শেষ হাসি হেসেছিল অবশ্য মহাজন। ১৯২৮ সালে কাজ শুরু করে বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক। নানা বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার করে এর আমানত বাড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সঙ্গে বিশ্বভারতীর টাকা রেখে, নিজের এবং অন্যান্য কর্মীদের ব্যক্তিগত টাকা রেখে, এমনকী গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে আমন্ত্রণ করে এনে বছরে হাজার টাকা বরাদ্দের ব্যবস্থা করেও হার মানতে হয়েছিল তাঁকে। মহাজনদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি শ্রীনিকেতনের সমবায় সমিতিগুলো। চাষ একফসলি, চাষিরা মহাজনি ঋণে জর্জরিত, তাদের সমবায়ের সদস্য অল্প, আমানত সামান্য। সমবায়গুলোকে হঠাতে আড়তদাররা চাষিকে বেশি দাম দিত ধানের। এমন মার খায় কৃষি সমবায়গুলো, যে এক সময়ে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কই তাদের ঋণ দিতে অস্বীকার করে। বাজারের লজিকে রবীন্দ্রনাথ হেরেছিলেন।
কিন্তু আর একটা কারণও কি ছিল না? রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনুগত সহকর্মী, প্রজাদের নিয়ে সমবায় শুরু করেন, কিন্তু তা রাজনীতি বাঁচিয়ে। গাঁধী গ্রামের মানুষের স্বনির্ভরতার আন্দোলনকে বৃহত্তর রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে জুড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের লড়াই ছিল রাজনীতি থেকে দূরে থেকে উন্নয়নের বিকল্প মডেল তৈরি করার। অথচ সমবায় প্রকল্পটাই আদ্যন্ত রাজনৈতিক। জমির মালিক, চালকল মালিক, ধান ব্যবসায়ী, সবাই যেখানে চাষির শ্রমকে কুক্ষিগত করতে অভ্যস্ত, সেখানে বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু চাষিকে স্বনির্ভর করার চেষ্টার মধ্যেই কাণ্ডজ্ঞানের অভাব ছিল। নোবেল প্রাইজের টাকা খুইয়ে তার খেসারত দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আজ খেসারত দিচ্ছেন চাষিরা। বীরভূমের কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কে তালা পড়ে গিয়েছে ১৫ জুন।
ব্যাঙ্ক ফেল করল কেন, প্রশ্ন করলেই শোনা যাবে, ‘পলিটিক্স’। সাধারণত ওই শব্দটি উচ্চারণের পর একটি দীর্ঘশ্বাস আর একটু মাথা নাড়াতেই কথা শেষ হয়। কিন্তু রাজনীতি কি এক রকম হয়? না কি, একই দলে নানা রাজনীতি হয়? বীরভূমের ব্যাঙ্কের মতোই খাদের কিনারা অবধি গিয়ে কী করে ফিরে আসতে পারল জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক? ২০১২ সাল থেকে দুই ব্যাঙ্কেরই বোর্ড পরিচালনা করেছে তৃণমূল। দুটো ব্যাঙ্কের সংকটের চেহারাটাও কাছাকাছি। বীরভূম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের প্রায় ৬২ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়ে যায়, যা ব্যাঙ্কের মোট সম্পদের ৫২ শতাংশ। জলপাইগুড়ির খেলাপি ঋণ ছিল ৫২ কোটি, যা মোট সম্পদের ৩৫ শতাংশ। যেখানে বিধি অনুসারে তা পাঁচ শতাংশ ছাড়ানোর কথা নয়। নানা নিষেধ জারি করে দুই ব্যাঙ্ককেই চিঠি পাঠায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
ঋণ খেলাপের কারণটাও দু’ক্ষেত্রেই এক ব্যাঙ্কের দায়িত্বে থাকা বাম নেতারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ পাইয়ে দিয়েছিলেন। উভয় ক্ষেত্রেই ঋণের বড় অংশটাই অল্প কয়েকটি অ্যাকাউন্টে। জলপাইগুড়িতে ৯ কোটি টাকা (বর্তমান খেলাপি ঋণের এক-তৃতীয়াংশ) নিয়েছেন স্রেফ এক জন, শপিং মল তৈরি করতে শিলিগুড়ির এক ব্যবসায়ী ধার নিয়েছিলেন। বীরভূমে প্রায় ১০ কোটি টাকা (খেলাপির এক-চতুর্থাংশ) এক ঠিকাদার ও তার ছেলের নামে। সেই সঙ্গে রয়েছে ভুয়ো গ্রাহক। ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন গোছের জিনিস কিনতে যত গ্রাহককে ঋণ দেওয়া হয়েছে (৫ কোটি টাকা কেবল একটা শাখা থেকে) তাঁদের ৭০ শতাংশের খোঁজ পাওয়া যায়নি বীরভূমে।
সংকট এক হলেও, সমাধানে তফাত হয়েছে। বীরভূম ব্যাঙ্ক মাত্র ২০ কোটি টাকা উদ্ধার করতে পেরেছে। ফলে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলাও বন্ধ করে দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। এ বার লাইসেন্স বাতিল হয়েছে, ১৭টি শাখায় তালা ঝুলেছে, গ্রাহকদের বিক্ষোভ সামলাতে র্যাফ নেমেছে। সবচেয়ে ফাঁপরে পড়েছে অন্তত ৯৫টি কৃষি সমবায় সমিতি, যাদের ৭০ শতাংশেরও বেশি আমানত গচ্ছিত রয়েছে ওই সমবায় ব্যাঙ্কে। এই খরিফ মরসুমে কৃষিঋণ দিতে পারছে না তারা। নতুন ধার দেওয়ার আগে পুরনো ঋণ আদায় করা হয়। তা-ও পারছে না। উঠে যাওয়ার মুখে এই সমিতিগুলো।
জলপাইগুড়ি ব্যাঙ্ক কিন্তু তার অনাদায়ী ঋণ দ্রুত কমিয়ে এনেছে। খেলাপি ঋণ এখন মোট সম্পদের মাত্র ১৫ শতাংশ। আগামী বছরের মধ্যে বাকি ঋণ আদায় হয়ে যাবে, ২০১৬ সালে ব্যাঙ্ক বেরিয়ে আসবে লোকসানের গ্রাস থেকে, বেশ জোরের সঙ্গে বললেন ব্যাঙ্কের কর্মীরা।
কী করে পারল জলপাইগুড়ি? ঋণ-খেলাপিদের ছবি ফ্লেক্সে ছাপিয়ে পাড়ায় পাড়ায় আটকে দিয়েছিল ব্যাঙ্ক। রাতবিরেতে তাগাদা দিয়েছিল বাড়ি বাড়ি গিয়ে। একবার জলপাইগুড়ির আনন্দপাড়ায় এক মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি (চার লক্ষ টাকা খেলাপি) গিয়েছেন কর্মীরা। স্ত্রী দরজা খুলে আমতা আমতা করতে লাগলেন। খানিকটা জোর করেই ঘরে ঢুকে কর্মীরা দেখেন, রোগা পাতলা মাস্টারমশাই পিছনের জানলা গলে লাফিয়ে নেমেই ছুটলেন। শেষে তাঁর ইস্কুলে গিয়ে বেতন থেকে টাকা কাটার ব্যবস্থা হল। তেমনই, জেলার এক উচ্চপদস্থ অফিসারের বকেয়া ঋণ আদায় করতে ব্যাঙ্ক ধরেছে রাজ্যের মুখ্য সচিবকে। তাঁর ‘অনুরোধ’ আসতেই সুড়সুড় করে টাকা ফেরত দেন অফিসারটি।
আইনকেও জলপাইগুড়ি কাজে লাগিয়েছে অন্য ভাবে। যেখানেই দেখা গিয়েছে, ম্যানেজাররা যথাযথ কাগজ ছাড়াই ঋণ দিয়েছেন, সেখানেই তাঁদের নামে বিশ্বাসভঙ্গের ফৌজদারি ধারায় মামলা করে, ষড়যন্ত্রে সহকারী হিসেবে গ্রাহককে জোড়া হয়েছে। ম্যানেজাররা গ্রেফতার হতেই অনেকে তড়িঘড়ি ঋণ মিটিয়েছেন। এক ভদ্রলোক হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করতে নির্দেশ এল, বকেয়া টাকা ফেরত দিলে জামিন পাবে। এক লপ্তে ৪০ লক্ষ টাকা ফেরত দেন তিনি। “ওই রায়টা আমাদের খুব কাজে লেগেছে,” বললেন ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান সৌরভ চক্রবর্তী।
বীরভূম ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম সেখানে বলছেন, “আইন তো আইনের পথই চলবে।” তাঁরা মূলত দায়রা আদালতে মামলা করেছেন, সে সব মামলা চলছেই। জলপাইগুড়িতে কিন্তু আইনের খানিক বাইরে গিয়েও চাপ দিয়েছেন, স্বীকার করছেন ব্যাঙ্কের কর্তারাও। এক জন বললেন, “এক হিমঘর মালিককে গিয়ে আমরা বললাম, টাকা দাওনি, আমরা হিমঘর দখল করব। তখনই টাকা দিয়ে দিল। চাইলে মামলা করতে পারত। ওটুকু ঝুৃঁকি নিয়েছি।”
বীরভূমের অবশ্য একটা বাড়তি অসুবিধে ছিল। ২০০৭ সালে নতুন ঋণ দেওয়া নিষেধের পর, ২০১২ সালে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জলপাইগুড়িতে সেখানে কেবল অকৃষি ঋণের উপর কিছু নিষেধ ছিল। ফলে বাড়তি আমানত সংগ্রহ করেও খেলাপি ঋণের অনুপাত কমাতে পেরেছে জলপাইগুড়ি। তবু মোটের উপর ব্যাঙ্ককে ফিরে দাঁড় করানোয় যে মরিয়া ভাব জলপাইগুড়িতে দেখা যাচ্ছে, বীরভূমে তা যাচ্ছে না। কেন?
একটা ইঙ্গিত মেলে রাজনীতিতে। ২০১২’য় বীরভূম সমবায় ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণ যখন এল তৃণমূলের হাতে, তত দিনে জেলার বিধানসভাগুলো সবই দলের দখলে। বাম পঞ্চায়েতগুলোও কার্যত দখল করেছে তারা। সেখানে নতুন জমি দখলের জন্য সমবায়কে ব্যবহার করার তাগিদ কেন হবে, তার খুব ব্যাখ্যা মেলে না। তৃণমূলের যে দুই নেতা পর পর ব্যাঙ্কের দায়িত্ব পান, তাঁরাও জেলায় প্রতিষ্ঠিত: বিকাশ রায়চৌধুরী দলের শ্রমিক সংগঠনের জেলা সভাপতি, নুরুল ইসলাম সিউড়ি ২ ব্লক সভাপতি। তাঁরা খেলাপি ঋণ আদায়ের যা উদ্যোগ নিয়েছেন, কার্যত ব্যক্তিগত সদিচ্ছায়।
জলপাইগুড়িতে কিন্তু ২০১২ সালে তৃণমূলের অবস্থান ছিল তৃতীয় বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের পরে। সৌরভ চক্রবর্তী রাজ্য স্তরের নেতা হলেও, জলপাইগুড়িতে জমি খুঁজছেন। সমবায় ব্যাঙ্ক দখল করে, ধুঁকতে থাকা কৃষি সমবায়গুলোকে চাঙ্গা করে, নতুন ১৫টি কৃষি সমবায় খুলে যে জমি তিনি তৈরি করেন, তার ভিত্তিতেই তৃণমূল এখন জেলায় এক নম্বর দল, দাবি করছেন সৌরভবাবু। এখন তিনি তৃণমূলের জলপাইগুড়ি জেলা সভাপতি।
তা হলে নকশাটা এই গরিবের সমর্থন আদায়ের চ্যালেঞ্জ যখন থাকে, তখন রাজনীতির কাছে সমবায় জরুরি অস্ত্র। যখন সন্ত্রাস, প্রলোভন, বা অন্য কোনও কায়দায় গরিবের ভোট নিশ্চিত হয়েই থাকে, তখন সমবায়ের ভাগ্য নির্ভর করে নেতার ইচ্ছার উপর। তাঁর দক্ষতা, উদ্যোগ থাকলে সমবায় বাঁচবে। নইলে গরিব চাষির টাকা নেতার তাঁবেদারের হাতে যাওয়ার সিধে রাস্তা তৈরি।
এই কি সমবায় রাজনীতির শেষ কথা?
বীরভূমে যখন সমবায় ব্যাঙ্ক ডুবতে বসেছিল, তখন একশোরও বেশি কৃষি সমবায় এককালীন ৪০ লক্ষ টাকার শেয়ার দেয় ব্যাঙ্ককে, আরও ১৫ কোটি টাকার শেয়ার এক বছরের জন্য ব্যাঙ্কে রাখার সম্মতি জানিয়ে রাখে। এই সমিতিগুলোর মধ্যে কিন্তু বাম-পরিচালিত সমিতিও অনেক ছিল। ব্যাঙ্কের পাশে দাঁড়াতে দলের পরিচয় তোয়াক্কা করেনি তারা। অথচ শেষ অবধি যখন কোনও চেষ্টাই ধোপে টিকল না, ব্যাঙ্কে তালা পড়ল, তখন প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরও স্তব্ধ করে দিল দলীয় রাজনীতি। সারদা কাণ্ডের পর অতিরিক্ত সতর্ক শাসক দল মিটিং-মিছিল, অবস্থান বিক্ষোভ হতে তো দেয়ইনি, একটা জনস্বার্থ মামলা অবধি হয়নি এক মাসেও।
গরিবের উপর অন্যের আধিপত্য ঠেকাতে সমবায় গড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে দিন রাষ্ট্র, রাজনীতি তাঁর পাশে ছিল না। আজ সমবায় রাষ্ট্রের নীতি। কিন্তু রাষ্ট্র, রাজনীতি যা দেয়, আধিপত্যের শর্তে দেয়। সমবায় ব্যাঙ্ক যদি বা চলে, সমবায় নীতি ব্যর্থ হয়েই চলেছে।
তথ্য সহায়তা: দয়াল সেনগুপ্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy