দলিত-জনজাতির শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার উচ্চবর্ণদের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি। এই তথ্য আবার দেখিয়ে দিল যে, এক ভারতের মধ্যে বাস করে একাধিক দেশ। এ ক্ষেত্রে কথাটা আক্ষরিক অর্থেই বলা চলে, কারণ সাহারা মরুভূমির দক্ষিণের দেশগুলি, অর্থাৎ আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশগুলির সঙ্গে ভারতের পুষ্টিচিত্রের তুলনা করে একটি প্রশ্ন দীর্ঘ দিন সকলকে ভাবিয়েছে— আর্থিক উন্নয়নে ভারত আফ্রিকার দেশগুলির চেয়ে এগিয়ে থাকলেও, অপুষ্টির নিরিখে ভারতীয় শিশুরা কী করে আফ্রিকার দরিদ্রতম অঞ্চলের শিশুদের চেয়েও পিছিয়ে? শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টির প্রকাশ ‘স্টান্টিং’, অর্থাৎ শিশুর বয়সের গড় উচ্চতার তুলনায় খর্বাকৃতি। এই ‘স্টান্টিং’-এর হার সাহারার দক্ষিণের উনিশটি দেশের শিশুদের মধ্যে ৩৪%, অথচ ভারতে ৩৬%। সম্প্রতি ২০১৯-২১ সালের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার পরিসংখ্যানকে জাতের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে দুই গবেষক দেখিয়েছেন, ‘বিকশিত’ ভারতের মধ্যে রয়েছে আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলির চেয়েও দরিদ্র এক জনসমাজ, যার অধিবাসীরা তফসিলি জাতি ও জনজাতির মানুষ। একবিংশ শতকের দুই দশক পার করেও যে জাতিগত পরিচিতি ভারতের শিশুদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে, তা আরও এক বার স্পষ্ট হয়ে গেল।
অপুষ্টির সঙ্গে বর্ণ-লিঙ্গ পরিচয়ের যোগ অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু উচ্চবর্ণের শিশু এবং দলিত-জনজাতির শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার কতখানি বেশি, সে তথ্য আঘাত না করে পারে না। ভারতের উচ্চবর্ণ শিশুদের তুলনায় সাহারার দক্ষিণের দেশগুলির শিশুদের স্টান্টিং-এর শিকার হওয়ার সম্ভাবনা ২০% বেশি। যেখানে দলিত-জনজাতিদের সন্তানদের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা আফ্রিকার শিশুদের চেয়েও বেশি। দু’টি দেশের মধ্যে যত পার্থক্য, তার চাইতেও বেশি দূরত্ব ভারতের সমাজের দুই অংশের মধ্যে। ভারতে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য যে এখনও প্রধানত জাতিগত ধারাতেই প্রবাহিত হচ্ছে, সে বিষয়ে সংশয় নেই। শিক্ষার স্তর, জমির মালিকানা, কর্মনিযুক্তির সুযোগ, ব্যবসায় রোজগারের অঙ্ক— এ সব কিছুর সঙ্গেই জাতি-পরিচিতির ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। গত কয়েক দশকে নানা সমীক্ষায় তা প্রকাশিত হয়েছে। দলিত-জনজাতির মধ্যে দারিদ্র তীব্র— তফসিলি জনজাতির দু’জনে এক জন, তফসিলি জাতির তিন জনে এক জন দারিদ্রসীমার নীচে। পাশাপাশি, দলিত-জনজাতির উপরে হিংসার ঘটনাও সমানে ঘটে চলেছে; তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ স্থান পাচ্ছে দলীয় রাজনীতির প্রচারেও। ২০১৪ সালের একটি সমীক্ষা দেখিয়েছিল যে, চার জন ভারতীয়ের এক জন এখনও কোনও কোনও জনগোষ্ঠীকে ‘অচ্ছুত’ বলে মনে করেন। পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন সরকারি নীতির ব্যর্থতার আক্ষেপ। শ্রেণি-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সব ভারতীয় শিশুর জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে ভারত সরকার দায়বদ্ধ। এই উদ্দেশ্যে খাদ্যের অধিকার (২০১৩), শিক্ষার অধিকার (২০০৯)-এর মতো আইনও পাশ করেছে ভারত।
তা সত্ত্বেও দরিদ্র ও প্রান্তিক শিশুদের মধ্যে ক্ষুধা ও অপুষ্টির প্রকোপ হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না একের পর এক জাতীয় সমীক্ষায়। অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প, মিড-ডে মিল প্রকল্প, এবং ‘খাদ্যের অধিকার’ আইনের অধীনে রেশনে সুলভ চাল-গম সরবরাহে রাজকোষের বিপুল খরচ হচ্ছে। অথচ, দলিত-জনজাতির শিশুদের স্বাস্থ্যচিত্রে পরিবর্তন হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ প্রকল্পগুলির দুর্বলতা। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের খাবার, মিড-ডে মিলের খাদ্যের পুষ্টিগুণ নিয়ে, বিশেষত প্রোটিনের স্বল্পতা নিয়ে অসন্তোষ আদালত অবধি গড়িয়েছে, কিন্তু সরকারি বরাদ্দ সুষম পুষ্টির উপযোগী হয়নি। এই কার্পণ্যের ফল আবারও প্রতিফলিত হল অর্থনীতির দুই গবেষকের বিশ্লেষণে। জার্নাল অব ইকনমিক্স, রেস, অ্যান্ড পলিসি পত্রিকায় প্রকাশিত এই বিশ্লেষণ আরও এক বার জাতিগত-বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে সব শিশুর অধিকারের সুরক্ষায় তৎপর হওয়ার প্রয়োজনে জোর দিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy