E-Paper
BB_2025_Lead Zero Banner

বিপ্লব নয়, তার সম্ভাবনামাত্র

উপনিবেশ আর অর্থনীতি শব্দ দুটো এক সঙ্গে উচ্চারিত হলে ভারতবাসী হিসাবে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা আমাদের কি অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী করতে পেরেছে?

ইন্দ্রজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:২৭
Share
Save

এ বছর অর্থশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার ভাগ করে নিয়েছেন তিন জন— তিন জনই আমেরিকার নাগরিক। প্রথম জন জন্মসূত্রে তুরস্কের লোক, নাম: ড্যারন আসেমগ্লু, এমআইটি-র অধ্যাপক; দ্বিতীয় জন সাইমন জনসন— ইনি জন্মসূত্রে ব্রিটিশ, এমআইটি-র অধ্যাপক; তৃতীয় জন জেমস রবিনসন, পুরোপুরি আমেরিকান, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর অধ্যাপক। অর্থনীতির যে বিভাগে তাঁদের গবেষণা, সেই বিষয়টির পারিভাষিক নাম ‘পলিটিক্যাল ইকনমি’, বাংলায় যাকে বলতে পারি রাজনৈতিক অর্থনীতি। বিষয় হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর অর্থনীতি দুটো সঙ্গত ভাবেই আলাদা মনে হতে পারে— অন্তত পাঁচ দশক সময় ধরে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, কলেজের ক্লাসে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিতে এ দুটো ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের। ছিল, মানে বছর কুড়ি-ত্রিশ আগে অবধি। তার পর আবার তাত্ত্বিক স্তরে বিষয় দু’টির পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। এ বারের নোবেলজয়ী তিন অর্থনীতিবিদের লেখা অজস্র গবেষণাপত্র এবং বই সেই ঘনিষ্ঠতার অকাট্য প্রমাণ। তাঁরা দেখিয়েছেন, কী ভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর অর্থশাস্ত্রের সমন্বয় ঘটানো সম্ভব। তাঁরা আধুনিক অর্থনীতির যুক্তি, তর্ক, মডেল, বিশ্লেষণ-পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নানান সমস্যার সমাধান কষে দেখিয়েছেন।

তাঁদের লেখায় তিনটে শব্দবন্ধ বারংবার চোখে পড়বেই: ‘ঔপনিবেশিক ইতিহাস’, ‘প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা’ আর ‘অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি’। অবশ্য, তাঁদের তত্ত্বের সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত কোনও সাধারণ ভারতবাসীও জানেন যে, আমাদের দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার পিছনে লুকিয়ে আছে প্রায় তিনশো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এক ‘কোম্পানি’র ইতিহাস, তাদের কার্যকলাপ। আজও শুধু স্বাধীন ভারতের নয়, ইউরোপীয় দেশগুলোর উপনিবেশ আর তাঁদের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানের ছাপ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা-আফ্রিকা-এশিয়া-অস্ট্রেলিয়ার অগণিত দেশের অর্থব্যবস্থা-পরিকাঠামো-উন্নয়নের কক্ষপথে রয়েছে।

উপনিবেশ আর অর্থনীতি শব্দ দুটো এক সঙ্গে উচ্চারিত হলে ভারতবাসী হিসাবে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা আমাদের কি অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী করতে পেরেছে? ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রায় আট দশক পার করেও আমরা গরিব— বড় জোর উন্নয়নশীল— এক দেশ। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হয়ে তা হলে আমাদের কী লাভ হল? নোবেল প্রাপকত্রয়ী অবশ্য আমাদের আশ্বস্ত করেছেন— গত শতাব্দীর শেষার্ধে ১৭৫টি দেশের অর্থনৈতিক তথ্য দিয়ে, পরিসংখ্যার বিশ্লেষণে, প্রমাণ করেছেন যে, গণতন্ত্র ও আর্থিক বৃদ্ধির পারস্পরিক সম্পর্ক মজবুত। কোনও দেশে গণতন্ত্র কায়েম থাকলে, সেই দেশে দেরিতে হলেও, সমৃদ্ধি আসে।

যে কোনও দেশই চলে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের ভরসায়। দেশের আইন কেমন হবে, সে আইন কতখানি যুক্তিসঙ্গত ভাবে বা নিরপেক্ষ ভাবে প্রযুক্ত হবে, সরকার গঠিত হবে কোন নিয়মে, কী ভাবে কররাজস্ব আদায় করা হবে আর কী ভাবেই বা সরকার সম্পদের পুনর্বণ্টন করবে, সবই প্রতিষ্ঠানের প্রশ্ন। গণতন্ত্র কায়েম থাকা মানেই বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানও বেঁচেবর্তে আছে। তিন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জানাচ্ছেন, এই সব প্রতিষ্ঠানই আমাদের পিছনে ফেলে দিচ্ছে; এগুলো, পরিভাষায় যাকে বলে, ‘ইনএফিশিয়েন্ট’ বা অকুশলী।

মজার কথা হল, গণতন্ত্র নিজেই এখানে এক প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়। যে ভাবে আধুনিক গণতন্ত্র চালানো হয়, নোবেলজয়ীদের গবেষণার সুর বলবে, সেটাই অকুশলী। গণতন্ত্রে সরকার চালানোর দায়িত্ব নেন সমাজের ‘এলিট’ গোষ্ঠী, আর দেশের বাকি সাধারণ মানুষ সেই গণতন্ত্রে যোগ দেন। এটা তাই এই দুই দলের মধ্যের একটা ‘গেম’; এই খেলার বিশ্লেষণ করতে দরকার গেম থিয়োরি বা দ্বন্দ্বতত্ত্ব। নোবেলজয়ীরা ঠিক তা-ই করেছেন।

তবে এই ‘গেম’টা তো এক বার খেলা হয় না; বছরের পর বছর ধরে বারংবার গণতন্ত্র ধরে রাখার তাগিদে দুই পক্ষ এই ডাইনামিক বা সময়সাপেক্ষ গেম খেলে চলেছেন। এই গতিমান পদ্ধতির অঙ্গ হিসাবে সাধারণ মানুষ চাইলে এলিটদের পরিচালনায় চালিত গণতন্ত্রের বদলে কোনও এক দিন বিপ্লবের ডাক দিতেও পারেন বইকি। তবে, তাতে লাভ নেই— গণতন্ত্র জিন্দাবাদ; এই গেমের ইক্যুইলিব্রিয়াম বা সন্ধি হিসাবেই গণতন্ত্র বেঁচে থাকে। শ্রমজীবীর বিপ্লব নয়, বিপ্লবটা যে হতে পারে, এই ধারণা ও সম্ভাবনাটাই দীর্ঘজীবী হয় শুধু। গণতন্ত্রের আড়ালে এলিট এই প্রতিষ্ঠান কেবল বিপ্লবকে যে মেরে ফেলে তা নয়, উদ্যোগ-উদ্যম, জ্ঞান-প্রযুক্তির ব্যবহারকেও রুখে দেয়; নতুন কোনও ব্যবস্থাকে চালু করতে দেয় না।

ফলে, আমাদের হাতে থাকে এক ইনএফিশিয়েন্ট ব্যবস্থা— অসম বণ্টন। প্রসঙ্গত বলি, ‘পলিটিক্যাল ইকনমি’ বিংশ শতকের গোড়ার দিকেও ছিল; ইটালীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তথা অর্থনীতিবিদ ভিলফ্রেডো প্যারেটো এ-হেন অসাম্য দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না— তাঁর নামেই আজকের দিনে আমরা যে কোনও বণ্টন ব্যবস্থাকে ‘প্যারেটো-এফিশিয়েন্ট’ করে তোলার দাবি করি।


অর্থনীতি বিভাগ, কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Indian Economy indian politics Economy

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।