পরিবেশের দিকে নজর না দিয়ে বড় মাপের শিল্পের দিকে ঝোঁকার মাসুল গুনছে পৃথিবী। কিন্তু একটা পৃথিবীর মধ্যে তো অনেক পৃথিবী আছে। ঘটনা হল, উন্নত দেশগুলির শক্তির চাহিদা অনেক বেশি, আর তার মাসুল গুনছে কম উন্নত দেশগুলির পরিবেশ। তবে তার পাশাপাশি অন্য সমস্যাও আছে। বিশেষ করে ভারতের মতো দেশের। তাদের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। তার অনিবার্য পরিণাম, শক্তির চাহিদা বিপুল ভাবে বাড়বে। তার জোগান আসবে কোথা থেকে? সেই জোগান পরিবেশের আরও কতটা দূষণ ঘটাবে? প্রযুক্তি নিশ্চয়ই উন্নত হবে, সবুজ হবে, কিন্তু তার পরেও প্রশ্নটা থেকে যাবে।
একটু হিসেব দেওয়া যাক। এখন পৃথিবীতে বছরে মাথাপিছু গড়পড়তা শক্তি লাগে ২.৪ কিলোওয়াট। অবশ্যই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন অনুপাত। যেমন ইংল্যান্ডে ৫ কিলোওয়াট, আমেরিকায় ১০, সাধারণ বাংলাদেশি মানুষের প্রায় পঞ্চাশ গুণ। ২০৩০ সালের মধ্যে শক্তির চাহিদা অন্তত দেড়গুণ হবে। এই শক্তির আশি শতাংশই আসে ফসিল জ্বালানি থেকে। মানে প্রধানত কয়লা এবং পেট্রোলিয়ম ও প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে। বাকিটা অন্যান্য নানা উৎস থেকে, যেমন জলবিদ্যুৎ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ, সৌরবিদ্যুৎ ইত্যাদি।
ভারতের ছবিটা কেমন? ষাট শতাংশ শক্তি আসে ফসিল থেকে, কয়লা থেকে পঞ্চাশ শতাংশ, গ্যাস থেকে দশ, তেল থেকে এক শতাংশেরও কম। জলবিদ্যুৎ মোটামুটি পঁচিশ শতাংশ। বাকিটা অন্যান্য সব উৎস মিলিয়ে। তার মধ্যে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ নিয়ে এত ঝামেলা, এত বিক্ষোভ, তা থেকে আসে মাত্র তিন শতাংশ। আগামী দিনে বাড়তি শক্তির চাহিদা ফসিল জ্বালিয়েই মিটিয়ে চলতে হলে পরিবেশ দূষণ বেলাগাম গতিতে বাড়বে। অন্য উপায় না ভেবে কোনও উপায় নেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জোর দিয়ে বলছেন, বাতাস, সৌর, পারমাণবিক, ভূগর্ভের তাপ ইত্যাদি বিভিন্ন বিকল্প উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকগুণ বাড়াতে হবে। আমদাবাদে এক হাজার মেগাওয়াট সৌরশক্তির কারখানা তৈরির সূচনা করলেন তিনি।
ভারতে সৌরশক্তির সম্ভাবনা বিপুল। সূর্য হল প্রকৃতির নিউক্লিয়ার ফিউশন, বিনে পয়সায় অফুরন্ত তেজ ও শক্তির জোগান দিচ্ছে, তাকে কাজে লাগানোর বিরাট আয়োজন চাই। কিন্তু ফোটোভোল্টাইক সেল এখনও খুব দামি। বিচক্ষণ গবেষণা করে তার দাম কমিয়ে আনা দরকার। পারমাণবিক শক্তির ইতিহাস যদি দেখা যায়, এক সময় খুব দামি ছিল, কিন্তু প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এখন মোটামুটি তাপবিদ্যুতের কাছাকাছি চলে এসেছে। এই উন্নতি সৌরশক্তির ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয়।
খুবই আশা পোষণ করি যে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশেষ জোর দিয়ে এই উৎসটির গুরুত্ব মোট শক্তির তিন শতাংশ থেকে বাড়িয়ে অন্তত দশ শতাংশে নিয়ে আসা হবে। কিন্তু এই আশা পূরণের পথে অবিশ্বাসের বাধা প্রবল, ফুকুশিমার বিপর্যয়ের পরে সে বাধা অনেক বেড়ে গেছে। এই বাধা অতিক্রম করতে হবে। সবচেয়ে দুঃখের কথা, গোটা পূর্ব ভারতে একটাও পারমাণবিক চুল্লি নেই। তার ফলে শুধু শক্তি সরবরাহ নয়, একটা সামগ্রিক উন্নয়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা।
আর একটি বড় সম্ভাবনার কথা বলে শেষ করব। তার নাম জিয়োথার্মাল এনার্জি, ভূগর্ভে সঞ্চিত তাপ থেকে পাওয়া শক্তি। এর প্রচুর ভবিষ্যৎ আছে, আমেরিকায় এই উৎস ত্রিশ শতাংশ শক্তির জোগান দেবে বলে হিসেব করা হয়েছে, মেক্সিকোতে দশ শতাংশ। কিন্তু ভারতে এখনও এই উৎস সন্ধানের উদ্যোগ, এক কথায়, বিগ জিরো। এই প্রেক্ষাপটেই বলতে ভাল লাগছে, বীরভূমের বক্রেশ্বরের কাছে ভূগর্ভ থেকে হিলিয়ম গ্যাস বেরোয়, আমরা সেখানে গবেষণা করছি। খুব শিগগিরই পরীক্ষা করব, ভূগর্ভে যত নীচে যাই, তাপ কত বাড়ছে, হিলিয়ামই বা কত পাওয়া যাবে? আমার বিশ্বাস, সাফল্য আমরা পাবই। প্রকৃতিই স্বয়ং নিজের বুক থেকে যে শক্তির জোগান দিচ্ছে, আমরা তা কাজে লাগাতে পারব।
‘এই পৃথিবী, এই বাতাস, এই দেশ, এই জল আমরা পূর্বপুরুষদের কাছে সম্পত্তি রূপে পাইনি, আমাদের ছেলেমেয়েদের এটা প্রাপ্য। কাজেই তাদের কাছ থেকে এই সম্পদ ধারে পেয়েছি, আমাদের নিশ্চিত কর্তব্য যেমন অবস্থায় পেয়েছিলাম অন্তত সেই অবস্থাতেই তারা যেন এই পৃথিবীকে পায়।’ মহাত্মা এ কথা বলে গেছেন। মনে রাখা আমাদের কর্তব্য।
ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার-এ হোমি ভাবা অধ্যাপক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy