সন্ত্রাসের স্মৃতি: মাখড়া।
হারবার্ট ছবির একটি দৃশ্যে দেখা গিয়েছিল মা কালী এবং চারু মজুমদারের সহাবস্থান। ছাত্র আন্দোলনে নিহত সুদীপ্তের মৃত্যুর ঘটনা দেখেও মনে হয়েছিল, এই কোলাজ কি বাঙালির মানস জগতের এক চিরায়ত প্যাকেজ?
আর এখন তো কথায় কথায় জেলায় জেলায় খুনোখুনি। ষাটের দশকে হয়েছে, আজও হচ্ছে। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে ততই নাকি বাড়বে রাজনৈতিক হিংসা।
বাঙালি কি হিংসাশ্রয়ী?
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। লালকৃষ্ণ আডবাণী তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আমাকে বলেছিলেন, উত্তরপ্রদেশ বা বিহারে জাতপাতের সংঘর্ষ সবচেয়ে বেশি, পশ্চিমবঙ্গে তা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক হিংসায় পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে। বিজ্ঞান ভবনে আয়োজিত পুলিশের ডিজিদের সম্মেলনে এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনাও হয়। আজ এত বছর পর রাজনাথ সিংহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও সেই একই কথা বলছে। আজও রাজনৈতিক হিংসার প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ ফার্স্ট বয়। এখানে হিংসা মানে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
কিন্তু কেন এমন হয়? উনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁ নগরীতে কেন এত হিংসা? রাজনৈতিক উন্মত্ততা? ট্রিগার হ্যাপি অসহিষ্ণু পুলিশ? নীরদ চৌধুরী বলেছিলেন, বাঙালি বৈষ্ণব নয়, আসলে শাক্ত। গাঁধীর সঙ্গে সুভাষ বসুর সংঘাতকেও এই প্রেক্ষাপটেই দেখেছিলেন তিনি। মহাকরণে গিয়ে বিনয়-বাদল-দীনেশের আক্রমণই হোক আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২১ জুলাই, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক বিরোধী লড়াই থেকে কমিউনিস্ট বিরোধী লড়াই থেকে কমিউনিস্ট বিরোধী অভিযান, এমনকী, সত্তর দশকের নকশল আন্দোলন— সবই সহিংস আন্দোলন। এক মার্কসবাদী রাজনীতি বিজ্ঞানী হারবার্ট আপতেকার বলেছিলেন, হিংসা হল একটা মাধ্যম যার মাধ্যমে ভাল লক্ষ্যেও পৌঁছনো যায়। আবার অন্তিম বা লক্ষ্যপ্রাপ্তির জন্য সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থাই যখন হিংসার ফসল তখন সেই হিংসার মোকাবিলা করতেও পাল্টা হিংসার আমদানি হয়। আধিপত্য কায়েমের এই ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত আছে হিংসা, যাকে বলা যায় ‘সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স’। আবার এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধও এক বিপরীতমুখী ঐতিহাসিক অনিবার্যতা।
সন্ত্রাসের বলি সুদীপ্ত গুপ্ত।
বাঙালির রাজনৈতিক সংস্কৃতি বহুত্ববাদী। কিন্তু সঙ্ঘজীবনে আত্মস্বার্থরক্ষা বাঙালির কাছে যতই বড় হয়ে ওঠে, পরমত সহিষ্ণুতা ততই কমে। অমর্ত্য সেনের ভাবনা অনুসারে আত্মপরিচয়ের আধিপত্য কায়েমের জন্য অন্য মত অন্য পরিচয়ের প্রতি আস্থা না রাখাই হিংসার উত্স। আর তাই বাঙালি হয় ইস্টবেঙ্গল নয় মোহনবাগান, হয় চিংড়ি নয় ইলিশ, হয় তৃণমূল নয় সিপিএম— ঠিক এমন একটা কালো বা সাদার দ্বৈততায় আক্রান্ত।
দ্বৈততা মানেই দ্বৈরথ নয়। ভাত বনাম রুটি না ভেবে ভাত এবং রুটি— এ ভাবেও তো ভাবতে পারি আমরা।
পশ্চিমবঙ্গে ব্রিটিশ রাজের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কাহিনি প্রায় আড়াই শতকের ইতিবৃত্ত। আধুনিক বাঙালি মানস সমাজের কোষ্ঠীবিচার করতে গিয়ে সমাজতাত্ত্বিক বিনয় ঘোষ বলেছেন, বঙ্গসমাজে প্রাধান্যকারী সংস্কৃতিই মূলধারার সংস্কৃতি হয়ে গিয়েছে আর মূলস্রোতই চাপা পড়ে হয়ে গিয়েছে প্রান্তিক। বাংলার গ্রামীণ মধ্য শ্রেণী ও নাগরিক মধ্য শ্রেণীও বহু ভাবে একত্রীভূত হয়েছে সংস্কৃতির বাঙালি ধারায়।
বিনয় ঘোষ বলেছিলেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর পর নতুন জমিদার শ্রেণীর অধীনে মধ্যসত্ব ভোগীর উদ্ভব হয়। বহু বছর পর যখন বামফ্রন্ট জমানায় কেরানি কমিউনিজমের উদ্ভব হল, তখনও মনে হল সেই প্রবাহই বয়ে চলেছে। কিন্তু সেই আপাত নিরীহ বাবু-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের মধ্যেও আছে আধিপত্যকামিতার সংস্কৃতি। আর পাশাপাশি পরিলক্ষিত হয়েছে সেই আধিপত্যর বিরুদ্ধে হিংসাশ্রয়ী লড়াই। বহু ক্ষেত্রে সেই লড়াইয়ে যতটা যুথবদ্ধতা দেখা যায় তা আপাতদৃশ্য। আসলে বহু ক্ষেত্রেই তাতে আছে নেতৃত্বের আত্মকেন্দ্রিকতা, রাজনৈতিক মোক্ষলাভের নীল নকশা।
ছাত্র রাজনীতিও হিংসাদীর্ণ।
বাম জমানায় যে দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জেলায় জেলায়, সেই সঙ্কীর্ণ দলীয় আধিপত্য আসলে সমাজকে অবৈধ ভাবে নিয়ন্ত্রণের জাল বিস্তার। শুরু হয় আমরা-ওরার বিভাজন। একে বলা যায় রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা।
পশ্চিমবঙ্গে একদা শাসক কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা আন্দোলনে মুখর হয়েছিলেন। সে আন্দোলনে হিংসা ছিল, ছিল পুলিশের দমননীতির হিংসাও। বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনের পর দেখা গেল মমতার জঙ্গি আন্দোলন। কেশপুর-গড়বেতা থেকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে হিংসা এসেছে বার বার। এমনকী, রাজ্যে যে দলটি দুর্বল সেই বিজেপি-র রাজ্য শাখাও বন্ধ-হরতাল, এমনকী, বাস পুড়িয়ে সফল আন্দোলনের দাবিদার।
এ দিকে এই ধারাবাহিক হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে তুলেছে। ব্রিটিশ পুঁজি প্রথমে বিদায় নিয়েছে। ‘ফ্লাইট অফ ক্যাপিটাল’, সেখান থেকে সিঙ্গুরে টাটার বিদায়, রাজ্যে এক দিকে রাজনৈতিক হিংসা, অন্য দিকে শিল্প ও বাণিজ্যের বিদায়।
আসলে বঙ্গ সংস্কৃতিবাদ মানেই সকলের মিশে যাওয়া নয়। অমর্ত্য সেন বলেছেন ‘প্লুরাল মোনোকালচারালিজম’ (বহু এক সংস্কৃতিবাদ)। বিভিন্ন সংস্কৃতি যখন রাতের অন্ধকারে জাহাজের মতো পরস্পরের পাশ কাটিয়ে চলে যায় তখন তারা এক জায়গায় বসবাস করলেও তা বহু সংস্কৃতিবাদের সার্থক নিদর্শন নয়।
অনতিদূরের স্মৃতি: নন্দীগ্রাম।
নিজস্ব পরিচয়বোধের এই ক্ষুদ্রায়ন আমাদের বাংলাকে আরও হিংসার পথে ঠেলে দিয়েছে। বিশ্বাসকে যোগে যেথায় বিহারো— সে শুধু একটা গানের লাইন।
এ কথা সত্য, যে কোনও গোষ্ঠীজীবনে সংঘাত ও হিংসা অনিবার্য। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায়, জাতি বনাম জাতি— এ সব নানা ভাবে হিংসার বহিঃপ্রকাশ। এই সব দ্বন্দ্ব নিরসন করতে গিয়ে রাষ্ট্রর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। এই মনোভাবের মধ্যেই আছে হিংসার সবথেকে বড় সম্ভাবনাময় উত্স। এখানে সিপিএম, তৃণমূল এ সবই হয়ে যায় ক্ষুদ্র পরিচয়। বামপন্থীরাও হিংসাকে রাজনৈতিক অনুশীলন ও সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলেছেন। আজ তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতাসীন বটে, কিন্তু সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বিদ্যমান।
বরং সময় এসেছে। এখন দলমত নির্বিশেষে সকলের উচিত গণতন্ত্রের আওয়াজ তোলা। একমাত্র প্রকৃত গণতন্ত্রই পারে এই হিংসার আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতিকে বিদায় জানাতে। অনেক হয়েছে হিংসা, অনেক হয়েছে সিপিএম-তৃণমূল, তু তু ম্যায় ম্যায়। এ বার নবজাতকের জন্য এক নতুন অঙ্গীকার করতে কি আমরা পারি না? পশ্চিমবঙ্গকে নবজাতকের বাসযোগ্য করতে কি ইচ্ছে করে না আমাদের?
—ফাইল চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy