প্রাচীন ভারতে বর্ণবিভাজন থাকলেও শূদ্র সমাজের নাকি বিশেষ মর্যাদাও ছিল। শূদ্রদের বৈশ্যের পর্যায়ে রাখা হয়েছিল এবং প্রাচীন ভারতে সামাজিক বিদ্রোহের ঘটনা ছিল কম। রবীন্দ্রনাথ যাঁদের বলেছিলেন সভ্যতার পিলসুজ তাঁরা ক্রমে মর্যাদা হারিয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন উচ্চবর্ণের মানুষের হাতে। পটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক-অধ্যাপক সীতারাম ঝা শ্যাম তাঁর ‘বেদ উত্তর সামাজিক ন্যায়’ নামক হিন্দি পুস্তকে দেখিয়েছেন ঋকবেদেও সামাজিক ন্যায়ের কথা বলা হয়েছিল। মনুসংহিতা পাঠ করলেও বোঝা যায়, ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু পরিশ্রমবিমুখ সুবিধাভোগী এক শ্রেণি নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার জন্য সমাজের উপর কী ভাবে কদর্য শোষণের নীতি আরোপ করে। সমস্যা হচ্ছে, সেই শোষণ স্বাধীনতার ৭০ বছর পরও আজও চলছে।
আসুন। আজ আপনাদের এক টাটকা অভিজ্ঞতার কাহিনি শোনাই। ১৫ অগস্টের প্রাক্কালে স্বাধীনতা হারানোর কাহিনি।
ললিত মোদি ইস্যুতে সংসদ যখন উত্তাল তখন বৃহত্তম গহণতন্ত্রের এই ‘মন্দির’টি থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরত্বে যন্তরমন্তরে ধর্নাস্থলে চলছে এক বিচিত্র জাতিযুদ্ধ। হরিয়ানার হিসার গ্রাম থেকে ৮০০ জন দলিত আর নানা বর্গের তফসিলি জাতির মানুষ পালিয়ে চলে আসেন উচ্চবর্ণের স্থানীয় জাঠদের অত্যাচারে। এই নিম্নবর্গের দলিতদের অভিযোগ, উচ্চবর্ণের অত্যাচারে গ্রামে তাঁরা থাকতে পারছেন না সেই ২০১২ সাল থেকে। আজও তাঁরা গ্রামে ফিরতে পারছেন না। বরং প্রতিদিন এই দলিত পালিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বই কমছে না।
হরিয়ানার এই দলিত গ্রামবাসীর কথা জানতে পেরে মেহেরৌলির কুতুবমিনারের কাছে অবস্থিত কুতুব মসজিদের এক প্রবীণ মৌলবী এখানে এসে ওঁদের সঙ্গে কথা বলে ওঁদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দেন। ফলে গত ৮ অগস্ট মৌলবী সঈদ মিঞার পৌরোহিত্যে এই ৮০০ জন মানুষ হিন্দু থেকে মুসলমান হয়ে যান। যেমন, যাঁর নাম ছিল সতীশ কাজলা, তিনি এখন হয়ে গিয়েছেন আবদুল কালাম। সম্ভবত প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে তাঁর বিশেষ পছন্দ ছিল।
এ দিকে দলিত হিন্দু পরিবারের মুসলমান হয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে দৌড়ে আসেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখপাত্র বিনোদ বনসল বলেন, ‘‘এ এক ধরনের শোষণ। আমাদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু কর্মী ওখানে দৌড়ে যান, কারণ আমাদের কাছে খবর আসে যে গরিব কিছু দলিত মানুষের অসহায়তা ও দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তাঁদের ধর্মান্তর করা হচ্ছে। আমরা এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলাম।’’ ঘটনা হল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা আসবেন সেই খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন মুসলমান সমাজের কিছু মৌলবীও। সেখানে দু’তরফের মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়, বাগবিতণ্ডার পরিবেশও সৃষ্টি হয়। তবে তা নিয়ে কোনও পুলিশি হস্তক্ষেপ হয়নি। পুলিশি সূত্রে জানানো হচ্ছে, যেহেতু তাদের কাছে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি, ফলে তদন্ত করার কোনও প্রশ্ন উঠছে না। ধর্নাকারীরা পুলিশের অনুমতি নিয়েই ধর্নায় বসেছেন, ফলে আপত্তি করার কিছু নেই।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এই ঘটনার প্রতিবাদ করলে কী হবে, যন্তরমন্তরে গত তিন বছর ধরে ঘরসংসার পেতে যাঁরা হিসারের ভাগানা গ্রাম থেকে এসেছেন, তাঁরা বলছেন, তাঁরা স্বেচ্ছাতেই মুসলমান হয়েছেন। তিন বছর ধরে তাঁরা অপেক্ষা করেছেন, সুবিচার চেয়েছেন। ভাগানা গ্রামের সংঘর্ষ সমিতির আহ্বায়ক জগদীশ কাজলা শুধু নন, হেমন্ত কালিয়ার মতো আরও অনেকেই যন্তরমন্তরের সামিয়ানার নীচে বসে বললেন, ‘‘আমরা নিচু জাত। আমাদের তাই হিন্দু বলে মনে করা হত না। অত্যাচার আর সহ্য করতে না পেরে আমরা দিল্লি পালিয়ে এসেছিলাম।’’
যন্তরমন্তরের এই রাস্তাটা দেখলে মনে হয় যেন নানা যাযাবরের ঠিকানা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে নানা সমস্যা নিয়ে কত মানুষ যে এখানে এসে থাকেন তার কোনও ইয়ত্তা নেই। সকলেরই মনে হয, এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতের রাজধানীর রাজপথে এসে পৌঁছলেই বোধবহয় প্রত্যন্ত মানুষের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু ভাগানা গ্রামের এই মানুষদের সমস্যাটা কী হয়েছিল?
সমস্যার আদিতে কিন্তু আছে একখণ্ড জমি। তারপর এল নারী নির্যাতনের কাহিনী।
বাগানা গ্রামে ছিল হাজারখানেক দলিত পরিবার। ওই গ্রামেই আরও এক হাজার পরিবার অন্য জাতের লোক যেখানে জাঠেদেরই অধিপত্য। এই গ্রামে একটা খেলার মাঠ নিয়ে ২০১২ সালে অশান্তি শুরু হয়। দলিত ছেলেরা বিকালে এই মাঠে খেলত। উচ্চবর্ণের জাতের তাতে আপত্তি। উচ্চবর্ণের ছেলেরা নিচু জাতের ছেলেদের সঙ্গে কেন খেলবে? অতএব সংঘর্ষ প্রথমে ছোটদের মধ্যে। তারপর তাতে যোগ দিল বড়রা। স্থানীয় খাপ পঞ্চায়েত ফরমান জারি করল সংখ্যালঘু দলিত পরিবারের ধোপা-নাপিত বন্ধ!
এই দলিতদের মধ্যে আবার যারা একটু বড়লোক তাদের একজন কুমোর জাতের। মাটির জি্নিস তৈরির ব্যবসা করে কিছু টাকা করেছে, সেই লোকটি অতুল কুম্ভর—নেতা হয়ে উঠেছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ভূপিন্দর সিংহ হুডা যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন জাঠ বিরোধী নেতারা এমনকি স্থানীয় বিজেপি নেতারাও এদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিতে বদল তো দূরের কথা অত্যাচার বাড়তে থাকে। তাই পালিয়ে এসে দিল্লিতে নির্বাগ করা। কিন্তু এখানে আসার এবং বেঁচে থাকার অর্থ দোগান দিচ্ছে কে? কুম্ভর জানাচ্ছেন, ‘‘আমরাই জোগাড় করছি কোনওমতে। কোনও রাজনৈতিক নেতা বা দলের কাছে আমরা হাত পাতিনি। তাহলে তাদের তকমা লাগাতে হতো।’’
পালিয়ে আসা রীতু নামের মেয়েটি বলছিল এর পর দলিত মেয়েদের ধরে ধরে ধর্ষণ করা শুরু হয়েছে! রীতুর বয়স ২২। দিল্লিতে এসে স্থানীয় এক কলেজে বি এ পাসকোর্সে ভর্তি হয়েছে। যন্তরমন্তর থেকেই রোজ কলেজ যাচ্ছে। কি অদ্ভুত জীবন! রীতু বলছিল, ‘‘এমনিতে আমরা অস্পৃশ্য, শুধু ধর্ষণ করার সময় ওদের এ সব মনে থাকে না।’’ বছরখানেক আগে কেজরীবাল এসেছিলেন এই ধর্নায়। তিনি সব শুনে যান। কিন্তু তাতেও কোনও ফল হয়নি।
হিসারে জেলাশাসকের অফিসের সামনেও বিক্ষোভ কম হয়নি। ২৩ মার্চ খাপ পঞ্চায়েত সামাজিক ও আর্থিক বয়কট করার পর চারটি মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়। তথন প্রথমে ৮০টি পরিবার ভয়ের চোটে যন্তরমন্তরে পালিয়ে আসে। হরিয়ানায় এ বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন প্রবীণ বিজেপি নেতা মনোহর লাল খট্টর। তিনি জাঠ নন, আরএসএস-এর ঘনিষ্ঠ। সঙ্ঘ পরিবারের বক্তব্য, উচ্চ এবং নিম্ন বর্ণ— সবাই হিন্দু সেই বেদের যুগ থেকে। জাঠ নন এমন এক জন নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী করতে চেয়েছে সঙ্ঘ পরিবার। তবু আজও এই পরিবারের কোনও সুরাহা হলো না। অম্বেডকর বলেছিলেন, হিন্দু হতে গিয়ে দলিত সত্তা বিসর্জন না দিতে। সেটা করলে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা চিবিয়ে খাবে।
আর এ সবের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন কিছু মৌলবী। মৌলবীদের দেখেই দৌড়ে এসেছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কিছু সাধু। আর এই ‘টাগ অব ওয়ার’-এর শিকার হরিয়ানার প্রত্যন্ত গ্রামের এক ক্ষুদ্র দলিত সমাজ।
স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও এই চিত্র বদলালো না। আমরা কবে এই চিত্রপট থেকে স্বাধীন হব? বিপর্যস্ত এই নিম্নবর্গের প্রতিরোধের ভাষা দরকার। প্রত্যাখানের জবাবে সে হবে নতুন ভারতের ভাষা। কিন্তু কী ভাবে তৈরি হবে সেই প্রতিরোধী আকল্প? এক দিকে বিশ্বায়ন অন্য দিকে নিম্নবর্গের বিচ্ছিন্নতা। এ এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণ। এই বিচ্ছিন্নতার মুক্তি কোথায়? কোন ১৫ অগস্টে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy