বেনিয়ম: রামপুরহাটে একটি মোটরবাইকে হেলমেটহীন তিন যুবক। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম
একটা সময় ছিল, যখন, বাড়ি থেকে বেরনোর সময় বরাবর মা-ঠাকুরমা কপালে হাত ঠেকিয়ে বলতেন, ‘দুর্গা-দুর্গা’। বলতেন, যাতে বাড়ির ছেলেমেয়ে পথে বেরিয়ে বিপদে না পড়ে!
এখনও বহু বাড়িতেই মায়েরা এ কথা বলেন, সন্তান বাড়ি থেকে দূরে কোথাও যাওয়ার সময়। সন্তান স্কুলে যাবে, কলেজে যাবে, কর্মস্থলে যাবে। বাসে যাবে, ট্রেনে যাবে, সাইকেল বা মোটরবাইকে যাবে। পথে কতই না বিপদ ওঁত পেতে থাকে! তেমনই এক মূর্তিমান বিপদ পথ দুর্ঘটনা। বলেকয়ে যা আসে না। কিন্তু, কত পরিবারকে পথে বসিয়ে দেয় একটা দুর্ঘটনা। দিন দিন পথ দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে—এটা আশঙ্কার। হাজার কর্মসূচি, হাজার সচেতনতার প্রচারেও রাশ টানা যাচ্ছে না দুর্ঘটনায়।
আজও সকালবেলা খবরের কাগজ হাতে না পেলে মনটা কেমন জানি হয়ে পড়ে। বহুদিনের অভ্যাস এই ইন্টারনেটের যুগেও ভাটা পড়েনি। কিন্তু এখন কাগজ খুললেই একটা আশঙ্কা দানা বাঁধে, চেনা-পরিচিত কেউ দুর্ঘটনায় পড়ল না তো! এত বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে চারদিকে, মনে এই আশঙ্কা আসতে বাধ্য। আমাদের জেলাও কম যাচ্ছে না। প্রায় রোজই সংবাদপত্রে পথ দুর্ঘটনায় হাতহতের খবর পড়ে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। আর এই দুর্ঘটনাগুলির মধ্যে অধিকাংশই এখন দেখছি মোটরবাইক দুর্ঘটনা। সবচেয়ে চিন্তার যেটা, সেই দুর্ঘটনায় হতাহতদের বেশির ভাগই কমবয়সি। বাইক নিয়ে ছেলেছোকরাদের বেপরোয়া গতি এবং দুর্ঘটনা এখন প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছে।
অলিতে-গলিতে, শহর-গ্রামের বড় রাস্তায়, জাতীয় সড়কে রোজই দেখি, মোটরবাইকে উদ্দাম গতিতে চলেছে কিশোর-তরুণ-যুবকেরা। গতি, গতি, এবং আরও গতি—এই তাদের মন্ত্র। এই গতির মোহই যে বিপদ ডেকে আনছে, তা-ও ভুলতে বসেছে এক শ্রেণির বাইক-চালক।
সরকারি পরিসংখ্যানও বলছে, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে গাড়ি চালকদের দোষ বেশি। গত কয়েক দিনে আমাদের এই রামপুরহাট মহকুমাতেই পথ দুর্ঘটনায় বেশ কয়েক জন মারা গেলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বাইক-আরোহীও। মনে পড়ে যাচ্ছে, নতুন বছরের প্রথম দিনেই ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কথাও। ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে রামপুরহাট শহরে কাছেই বিনোদপুর গ্রামের চারটি তরতাজা ছেলে একটাই মোটরসাইকেলে চেপে যাচ্ছিল কোথাও। কারও মাথাতেই হেলমেট ছিল না বলে সংবাদপত্রে প্রকাশ পেয়েছে। দ্রুতগতি ট্রাকের মুখোমুখি পড়ে চার জনই মারা গেলেন। এক তরুণকে তো ট্রাকটি ছেঁচড়ে নিয়ে গেল প্রায় ৩০ কিলোমিটার! পরদিন এই সংবাদ পড়ে শিউরে উঠেছিলাম। ভেবে আশ্চর্য লাগে, ১৮-২১ বয়সের এই চারটি ছেলে শুধুমাত্র মায়ের কোল খালি করল না, সমাজের সম্পদও হারিয়ে গেল
চিরদিনের মতো।
অবাক হই এই ভেবে যে, এমন মর্মান্তিক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে বড় করে বেরোলেও এক শ্রেণির মানুষ মোটরবাইকের বেপরোয়া গতিতে লাগাম দেওয়া কিংবা হেলমেট পরে বাইক চালানোর কথা ভাবেন না কিছুতেই। কিশোর থেকে বড়—সব বয়সের মানুষই এই প্রবণতার শিকার। ভাবতেও খারাপ লাগে যে, তরতাজা যে প্রাণগুলো অসময়ে দুর্ঘটনার বলি হচ্ছে শুধুমাত্র গতির নেশায় বা নিয়মভঙ্গের কারণে, তারা তো শুধু আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তাই না। একরাশ শূন্যতা রেখে যাচ্ছে তাদের পরিবারে। কত বাবা-মা তাঁদের যোগ্য সন্তানকে অসময়ে হারিয়ে দিশাহারা। আরও বৃহত্তর দৃষ্টিতে দেখলে মানবসম্পদের এই ক্ষয় সমাজের এক বিশাল ক্ষতি।
কিশোর বয়স থেকেই এখন দু’চাকার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ ছেলেদের। তাদের শখ-আহ্লাদ মেটাতে অনেক বাবা-মা বয়সের আগেই সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন মোটরবাইক বা স্কুটারের চাবি। লাইসেন্স নেই, হেলমেট পরার বালাই নেই—দু’চাকায় স্টার্ট দিয়ে সেই যে গতির নেশা পেয়ে বসল, সেটাই যে এক দিন বিপদ ডেকে আনবে, সে হুঁশ থাকল না তার।
প্রশাসনের উপর সব দায় ঝেড়ে ফেলে দেওয়া বোধহয় সমীচীন নয়। সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। সাবধান হতে হবে চালক-আরোহীদের। বড় ভূমিকা রয়েছে পরিবারের। ‘চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম’—এই আপ্তবাক্য মানলে ছেলেমেয়েদের বাড়ি থেকে মোটরবাইক বা স্কুটি নিয়ে বেরোতে দেখলেই সতর্ক করা দরকার এই বলে যে, ‘কোথায় যাচ্ছ? হেলমেট নিয়েছে তো? কখন ফিরবে?’ জানতে চাওয়া দরকার, তারা লাইসেন্স নিয়েছে কিনা। এবং সব শেষে বারবার বলে দেওয়া— ‘‘সাবধানে চালাবি কিন্তু। তাড়াহুড়ো করিস না।’’ অনেকই বলবেন, আজকের ছেলেমেয়েরা এত কথা শোনেই না! তবু চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বারবার ‘হ্যামার’ করতে হবে গতির ভয়াবহতা। নিয়মাবলি মেনে চলা। অর্থাৎ বাড়ির অভিভাবকত্ব থাকতেই হবে এবং শৃঙ্খলা পাঠ দিতেই হবে। সাধারণ নাগরিক হিসাবে যাঁর যেটুকু দাযিত্ব-কর্তব্য আছে, সেগুলোকে কাজে লাগানো যায়। দোষ না চাপিয়ে আমরা যদি প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করি, তা হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমানো যেতে পারে। সমাজের একটা অংশ হিসাবে অত্যন্ত জরুরিও সেটা।
লাইসেন্স বিহীন আরোহীদের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক চাপ থাকা দরকার। আঠারো বছরের নীচে দেখা যায় অনেকেই চালকের আসনে। সাইলেন্সার খুলে বিকট শব্দে নিজেকে গতিসম্পন্ন করার প্রবণতা কড়া হাতে দমন করতে হবে। সাধারণ মানুষেরও প্রতিবাদ করা দরকার এই শব্দদূষণের বিরুদ্ধে। শহরের রাস্তায় যেখানে সেখানে বা জাতীয় সড়কে স্পিডব্রেকার দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। দূর থেকে, বিশেষ করে রাতে সেগুলো বুঝতে না পারার ফলে শেষ মুহূর্তে ব্রেক কষায় দুর্ঘটনা আকছারই ঘটছে। এ ক্ষেত্রে যাঁদের হেলমেট থাকে, তাঁরা অনেকেটাই আশ্বস্ত হতে পারবেন। কিন্তু হেলমেট থাকে ক’জনের! যেটা সবেচেয়ে জরুরি, সেটাই অনেকের কাছে বোঝা! সুতরাং বাড়ির ছেলেমেয়ে হেলমেটহীন হলেই বাড়ির লোককে বারণ করতে হবে। স্পিডব্রেকারগুলি এমন ভাবে মার্কিং করা হোক, যেন দূর থেকে নজরে আসে। সঙ্কীর্ণ রাস্তায় গতি নিয়ন্ত্রিত হোক। মোটরবাইকে দুইয়ের অধিক সওয়ারি হলেই ধরে জরিমানা করা হোক।
ভারতের পূর্বতন ক্রিকেট অধিনায়ক মহম্মদ আজাহারউদ্দিনের সেই শোক বিহ্বল চেহারা সামনে ভাসে, যখন তাঁর প্রিয় বড় ছেলে বিখ্যাত বাবার কাছ থেকে উপহার হিসাবে পাওয়া প্রচণ্ড গতি সম্পন্ন মোটরবাইক চালাতে গিয়ে প্রাণ হারান। আঠারো বছরের প্রতিশ্রুতিমান খেলোয়াড় অকালে ঝরে পড়েছিল গতির নেশায়। তাই অত্যন্ত সময়োপোযোগী পদক্ষেপ করা দরকার এই গতির নেশার বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শুরু করে প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত সকলে এবং সর্বোপরি জনগণের যোগদানের মধ্য দিয়ে এ কাজ করাই যায়। প্রচারের পাশে দৃষ্টান্তমূলক কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার, আমরা সত্যি কি চাই? যদি চাই, তা হলে সে চেষ্টা শুরু হোক আজ এবং এখন থেকেই। ‘প্রাণের মূল্য বুঝুন এবং বোঝান’— এটা সামগ্রিক দাবি হয়ে উঠুক।
লেখক প্রাক্তন ব্যাঙ্ককর্মী (মতামত নিজস্ব)
এই বিভাগে লেখা পাঠান নীচের ইমেল-এ
mail.birbhum@abp.in। অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন। অন্য কোনও পত্রিকা, পোর্টালে পাঠানো লেখা অনু্গ্রহ করে পাঠাবেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy