আমার মন কোথায় গেল?’ এই প্রশ্ন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে কখনও আতান্তরে ফেলিতে পারিবে না। তাঁহার মন সর্বদাই একাভিমুখী। সেই মন সর্বদাই লোক ভুলাইবার কথা ভাবিতেছে। অমিত মিত্রকে তিনি খাজাঞ্চিখানার ভার দিয়াছেন বটে, কিন্তু সিন্দুকের চাবি নীল পাড় সাদা শাড়ির আঁচলের খুঁটে বাঁধা। ফলে, মিত্রমহাশয় বড় জোর লোক ভুলাইবার নীতির খেসারতের পরিমাণ হিসাব কষিতে পারেন, কিন্তু বঙ্গেশ্বরীর মুখের উপর ‘মিসটেক, মিসটেক’ বলিবার অধিকার— দুর্জনে বলিবে, সাহস— তাঁহার নাই। তিনি বিলক্ষণ জানেন, আর বড় জোর দুই বৎসর আছে, তাহার পরই দেনার দায়ে রাজ্য ফৌত হইয়া যাইবে। কোন পথে হাঁটিলে রাজ্যের আর্থিক অবস্থার খানিক হইলেও সুরাহা হইতে পারে, তাহাও অর্থমন্ত্রীর জানা। কিন্তু, জানিলেই তো আর হয় না, কালীঘাটের সর্বাধিনায়িকাসমীপে তাহা জানাইতেও হয়। অমিত মিত্র সম্ভবত ততখানি অ্যাডভেঞ্চারপ্রবণ নহেন।
অমিত মিত্র মুখ ফুটিয়া বলিতে পারিবেন না যে লোকের মন ভুলাইবার উদগ্র তা়ড়নাতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গকে রসাতলে টানিতেছেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসাব কষিয়া দেখাইয়া দিতে পারেন, ক্লাবে-ক্লাবে খয়রাতি, মৌলবিভাতা হইতে হরেক কিসিমের উৎসব, সব মিলাইয়া তিনি যত টাকা নিতান্ত বাজে খরচ করিয়াছেন, রাজ্যের মোট ঋণের বোঝার তুলনায় তাহা যৎসামান্য। তাঁহার পাটিগণিতে ভুল নাই। ভুল তাঁহার মনে। রাজ্য যখন দেনার দায়ে হাঁসফাঁস করিতেছে, তখন একটি পয়সাও কেন অপচয় করা হইবে, সেই উত্তর তাঁহার নিকট নাই। রাজকোষ হইতে যে টাকা তিনি উড়াইয়াছেন, সেই অপচয় না হইলেও দেনার বোঝার ইতরবিশেষ হইত না বটে, কিন্তু বোঝা যাইত, তিনি সমস্যাটিকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিতেছেন। অবশ্য, মন ভুলাইবার খেলায় এই খয়রাতিই একমাত্র নহে। সিঙ্গুরের আত্মঘাতী আন্দোলন যেহেতু তাঁহার ভিত্তি, অতএব শিল্পহীনতাই পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ হইয়াছে। তিনি যে জমি না লইবার জেদ ধরিয়াছেন, তাহাও তো ভোটারের মন ভুলাইবারই ছক। শিল্প হিসাবে তেলেভাজা যে উচ্চমার্গের নহে, এবং রাজ্যের অর্থনীতির মুখ ঘুরাইবার সাধ্য যে তাহার নাই, মুখ্যমন্ত্রীও বোঝেন। কিন্তু, সেই উপলব্ধি তাঁহার রাজনীতির দিশা পাল্টাইতে পারে নাই। পারিবে, তেমন আশামাত্র নাই।
পশ্চিমবঙ্গের রাজকোষ যে গাড্ডায় পড়িয়াছে, তাহা হইতে উদ্ধারের দুইটিই পথ। এক, রাজ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করা, যাহাতে বর্তমান কাঠামোতেই অধিকতর রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়; দুই, রাজস্ব আদায়ের নূতনতর রাস্তা খোলা। পশ্চিমবঙ্গকে বাঁচিতে হইলে দুইটি পথেই সমান গতিতে হাঁটিতে হইবে। জমি অধিগ্রহণ না করিবার জেদে মুখ্যমন্ত্রী প্রথম পথটিকে মারিয়াই রাখিয়াছেন। অমিত মিত্র বলিবেন, তাঁহার আমলে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়িয়াছে। কিন্তু, তাহা যে যথেষ্ট হয় নাই, সেই হিসাবও অর্থমন্ত্রীর দেরাজেই আছে। এবং, রাজস্ব বৃদ্ধির একটি বড় ক্ষেত্র প্রবেশ কর, যাহা দীর্ঘমেয়াদে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক স্বাস্থ্যের পক্ষে প্রাণঘাতী। তাঁহার উচিত, অবিলম্বে বিভিন্ন পরিষেবা ব্যবহারের জন্য কর আদায়ের ব্যবস্থা করা। জলের উপর চার্জ বসানো যেমন। সরকারি পরিবহণ সংস্থাকে লাভজনক করিয়া তোলা যেমন। কিন্তু, বঙ্গেশ্বরী সেই পথও রুধিয়াছেন। জলের জন্য পয়সা দাবি করিলে, বাসভাড়া বা়ড়াইলে যদি ভোটাররা চটিয়া যায়! রাজ্য রসাতলে যায় তো যাউক, ভোটারের মন ভুলাইবার প্রচেষ্টায় কোনও খামতি মুখ্যমন্ত্রী মানিয়া লইবেন না। অতএব, সর্বনাশের আশায় বসিয়া থাকা ভিন্ন অমিত মিত্রের আর কিছু করিবার নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy