Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

পাহাড়ের উপরে যেন পড়েছিল আলো

তাঁকে দেখে অবনীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, পাহাড়ের উপর যেন চাঁদের আলো পড়েছে, ভারতীয় চিত্রকলার পুনর্জাগরণের সেই মুহূর্তে নিবেদিতার অজানা ভূমিকার খোঁজ দিলেন রাজনারায়ণ পাল‘কৃষ্ণ-সত্যভামা’র ছবিতে সত্যভামায় পা ধরে বাসব তার মানভঞ্জনে রত। অবাক হলেন অতিথি— নারীর পা ধরে পুরুষের মানভঞ্জন!

শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:১৭
Share: Save:

তিন তিনটে ছবি। নিখাদ হাতে আঁকা। প্রথমটি ‘কৃষ্ণ-সভ্যতার’ তো পরের দুটি ‘মা-কালী’ আর ‘দশরথ-কৌশল্যা’র। সময়টা বিশ শতকের প্রভাতবেলা। স্থান কলকাতা শহরের সরকারি শিল্প বিদ্যালয়। সেখানে তখন শুরু হয়েছে দেশীয় শিল্প-চর্চ্চার কর্মযজ্ঞ। যার পুরোভাগে ঋত্বিকের ভূমিকা নিয়েছেন ঠাকুর বাড়ির শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি সেখানকার ভাইস-প্রিন্সিপাল। তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছেন জনৈক আইরিশ দুহিতা। অবনীন্দ্রনাথ তাঁকে ছাত্রদের শিল্পকর্ম দেখাচ্ছেন।

‘কৃষ্ণ-সত্যভামা’র ছবিতে সত্যভামায় পা ধরে বাসব তার মানভঞ্জনে রত। অবাক হলেন অতিথি— নারীর পা ধরে পুরুষের মানভঞ্জন! দৃষ্টিকটু বটে, খারাপ দেখায়। শিল্পীকে এ জাতীয় ছবি আর আঁকাতে নিষেধ করলেন। যদিও মা কালীর ছবি তাঁকে তৃপ্তি দিয়েছিল। তবু দীর্ঘ বস্ত্র পরিহিতা সে কালীমূর্তি যেন স্বাভাবিকতার গণ্ডি খানিকটা অতিক্রম করেছিল। মাকালী যে দিগ্‌বসনা, প্রলয়ঙ্করী। শিল্পীকে তিনি কালী সম্পর্কে স্বামীজীর লেখা কবিতাখানি (‘Kali the Mother’) একটিবার পড়তে বললেন।

তৃতীয় ছবি ‘দশরথের মৃত্যু-শয্যা’য় রামচন্দ্রের বনাগমনের শোকে মৃত দশরথের দেহের পদমূলে উপবিষ্ট কৌশল্যার বিয়োগ ব্যথা মূর্ত। হাতে তার একখানা পাখা। ছবিতে ফুটে ওঠা শান্তির বাতাবরণ অতিথির মন ছুঁয়ে গেল। এ যেন মা সারদার গৃহের প্রশান্তি। তবে স্মিত হেসে তিনি বললেন, কৌশল্যা রাজরানি। তাঁর হাতে তালপাতার পাখা? রাজরানির হাতে হাতির দাঁতের পাখাই শোভা পায়। শিল্পীকে ডেকে বললেন, যাদুঘরে হাতির দাঁতের পাখা রাখা আছে, তিনি যেন একবারটি গিয়ে তা দেখে আসেন।

যাঁর চিত্রকলা সম্পর্কে জনৈক আইরিশ অতিথি এ মন্তব্য করেছিলেন, কলকাতার সরকারি শিল্প বিদ্যালয়ে নবাগত সে ছাত্রটি পরবর্তীকালে হয়ে উঠবেন বিশ্ববিশ্রুত চিত্রকর নন্দলাল বসু। আর দ্রষ্টা-সমালোচকের ভূমিকায় আইরিশ দুহিতা মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল, আমাদের ভগিনী নিবেদিতা। ব্রহ্মচারী গণেন্দ্রনাথনকে সঙ্গে নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। যাবার সময় বললেন, “গণেন একে তুমি আমার বাগবাজার বোসপাড়া লেনের বাড়িতে নিয়ে এসো।”

সুরেন গাঙ্গুলিকে নিয়ে এর কিছু দিন পরই নন্দালাল হাজির হয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। কিন্তু সে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা নিদারুণ। বোসপাড়া লেনের একটা ছোট্ট দোতলা বাড়ির আরও ছোট্ট এক ঘর। মেঝেতে কার্পেট পাতা। তার ওপর সোফা। বসতে বলা হলে, নন্দলাল-রা সোফায় গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলেন। তা’ দেখে নিবেদিতা তাদের আসন করে বসতে বললেন। আসন করে বসা মানে তো মাটিতে বসা। নন্দলালদের মনে মনে রাগ হল। বোধ হয় বুঝতে পারলেন তিনি। স্বীকার করলেন, বুদ্ধের দেশের লোক হয়ে তাদের সোফায় বসতে দেখে তার ভাল লাগে না। আর মাটিতে আসন করে বসাতে তাদের যেন ঠিক বুদ্ধের মত লাগছে। দেখাচ্ছেও বেশ। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে সে দিকে চেয়ে থেকে, কি দেখলেন কে জানে, খুশিতে উচ্ছল হয়ে সঙ্গী ক্রিস্টিনাকে ডেকে তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

এরপর থেকে শুরু হল বাগবাজারে নিবেদিতার কাছে নন্দলাল বসুর যাতায়াত। সঙ্গী কখনো সুরেন গাঙ্গুলী, অসিত কুমার হালদার, তো কখনও বা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এক দিন নন্দলাল তাঁর ‘জগাই-মাধাই’ ছবিখানা দেখালেন তাঁকে। খুব খুশি হলেন দেখে। জানতে চাইলেন, ওদের মুখচ্ছবি কোথায় পেলেন। নন্দলাল জবাব দিয়েছিলেন, গিরিশবাবুর, মানে গিরিশ্চন্দ্র ঘোষের মুখ দেখে এঁকেছেন। এ কথায় হেসে ফেলেছিলেন নিবেদিতা। খানিক চুপ করে থেকে বলেছিলেন, ছবি সবসময় ধ্যান করে আঁকবে। এই তো আমাদের ভারতীয় ছবি আঁকার রীতি। ছবিটিতে জগাইয়ের কোমরে একখানা থেলো হুঁকো গোঁজা দেখে নিবেদিতা মন্তব্য করেছিলেন, জগাইয়ের আমলে তামাক খাবার চল ছিল না। ছবি আঁকার সময়, বিষয়ের সমসাময়িক আচার-ব্যবহার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। নন্দলাল বসুর জীবন ছবি দিয়ে ঘেরা। জীবনভর একের পর এক ছবি এঁকেছেন। আর লোকে ধন্য ধন্য করেছে। শিল্প-রসজ্ঞ নিবেদিতা প্রথম দেখাতেই বুঝেছিলেন, এ ছেলে ভবিষ্যতে শিল্পের পথে অনেক দূরকে নিকট করবে। আর সে লক্ষ্যে তাঁকে পৌঁছে দিতে প্রয়োজনে অঙ্গুলী নির্দেশও করেছিলেন আজন্ম শিল্পরসিক বিবেক-শিষ্যা।

বিশ শতকের সূচনায় বাংলার শিল্প-চেতনায় যে প্রতিশ্রুতি প্রস্ফুটিত হচ্ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসুর হাত ধরে অনতিকালের মধ্যে তা’ ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভূ-ভারতে। পাশ্চাত্য শিল্প-আঙ্গিকের সাথে দূরত্ব গড়ে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এই নব্য শিল্পরীতি জাতীয় জাগরণে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিল। নতুনের পথে হাটা সেই ভারত-শিল্প যাদের প্রশ্রয়ে সৃষ্টির প্রথম ভোরে লালিত ও সুরক্ষিত হয়েছিল, নিবেদিতা তাদের অন্যতম। তৎকালীন নবীন শিল্প-গোষ্ঠির কর্মপ্রেরণার একটি উৎস। তবে কেবল অনুপ্রেরণাই নয়, চিত্র-কলায় ভারতীয় পদ্ধতি সম্পর্কে তার কাছ থেকে প্রভূত জ্ঞানও লাভ করেছিলেন তারা। প্রত্যেক দেশের জাতীয়জীবনের মূল সুরটি সাহিত্য, কলা সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে পূর্বসূরী হতে উত্তরসূরীতে সঞ্চারিত হয়। এ ধারা কোনো নির্দিষ্ট জাতির স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্যকে প্রতিষ্ঠা দেয়। আর একথা জানতেন বলেই ভারতের জাতীয় শিল্পের জাগরণে ঐকান্তিক উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন ভারতপ্রেমী এই আইরিশ দুহিতা।

যাঁর হাত ধরে বাংলায় শিল্প আন্দোলনের শুরু, সেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নির্দ্ধিধায় স্বীকার করেছেন যে, শিল্পীজীবনের সূচনায় অন্য সবার মত তিনিও পাশ্চাত্য রীতির অনুসারী হয়েছিলেন। পরে ধীরে ধীরে ভারতীয় শিল্পরীতির সাথে একীভূত হয়ে যান। এর পেছনে ছিল নিবেদিতার সাহচর্য, ঐকান্তিক উৎসাহ। উদ্ধোধন-এর সম্পাদক স্বামী সুন্দরানন্দের কাছে তিনি একবার বলেছিলেন যে তাঁর শিল্প প্রচেষ্টার মূলে নিবেদিতার প্রেরণা অনুপ্রেরণার কাজ করেছিল। শুধু অবনীন্দ্রনাথেরই নয়, দেশীয় সৌন্দর্য্য, শিল্প ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি সমস্ত ভারতীয়র চোখ খুলে দিয়েছিলেন তিনি।

নিবেদিতার সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের প্রথম দেখা কলকাতায় মার্কিন-কনসালের দেওয়া এক অভ্যর্থনা সভায়। ১৯০২ সালে বিখ্যাত জাপানি মনীষী ওকাকুরা ভারতে আসেন। তাঁকে ঘিরে বাংলার শিল্প জগতে সে সময়ে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, যার থেকে দূরে থাকতে পারেননি ঠাকুর বাড়ীর শিল্পীরাও। অবনীন্দ্রনাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ কেউই নয়। ওকাকুরার আগমন উপলক্ষে মার্কিন কনসালের বাড়ীতে সেই অভ্যর্থনা সভায় অবনীন্দ্রনাথ প্রথম দেখেন নিবেদিতাকে। শ্বেতশুভ্র ঘাঘরা পরিহিতা, কন্ঠে রুদ্রাক্ষের মালা শোভিতা সে নিবেদিতা যেন মর্মর তপস্বিনীর মূর্তি। ওকাকুরা যেমন, ঠিক তেমনটি নিবেদিতা। দু’টি তারা যেন মিশেছে এক বিন্দুতে। প্রথম দর্শনের সেই সময় অবনীন্দ্রনাথ ধরে রেখেছেন তাঁর লেখনিতে— ‘সাজগোজ ছিল না, পাহাড়ের ওপর চাঁদের আলো পড়লে যেমন হয়, তেমনি ধীরস্থির মুর্তি তার। তার কাছে গিয়ে কথা কইলে মনে বল পাওয়া যেত।’ শিল্পী মনে এমনই প্রভাব ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের লোকমাতা।

শিক্ষক, মহাদেবানন্দ মহাবিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Sister Nivedita Renaissance Fine Arts
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE