গ্রেফতারের সংবাদ জমাইয়া উপভোগ করিবার আগেই জামিনের সংবাদ আসিয়া গেলে উপভোগ-সর্বস্ব সমাজের আর থাকে কী। ভাল করিয়া প্রফুল্ল হইবার আগেই কিনা বিষণ্ণতায় গ্রস্ত হইতে হয়। লন্ডন হইতে বিজয় মাল্যর সংবাদ আসিতে ঠিক তাহাই হইল। তাঁহার বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগেও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দড়িটি ভাল করে কোমরে না পরাইতেই তিনি জামিন পাইয়া গিয়াছেন, শুনিয়া ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এবং রাজনীতিক মহল রীতিমতো ভগ্নহৃদয় হইয়া পড়িল। শেষ পর্যন্ত জনমানসের বিবেচনায়, গ্রেফতারের ক্ষণস্থায়ী বাস্তবটি উপেক্ষা করিয়া গ্রেফতারি পরোয়ানার খবরটুকুই উল্লাসের সহিত পালনের সিদ্ধান্ত হইল। ভারতীয় মানস-ভূমিটি এই রকমই। লক্ষণীয়, মাঝখান হইতে কী ভাবে উপেক্ষিত হইল অন্য একটি গুরুতর বিষয়— ব্রিটিশ আদালতের কার্যবিধিতে জামিন নামক প্রক্রিয়াটির গুরুত্ব। শুধু ব্রিটিশ কেন, এই প্রসঙ্গে মার্কিন আইন ও বিচারের আদর্শটিও স্মরণ করা যায়। রজত গুপ্তর ক্ষেত্রে মার্কিন আদালত দ্রুত জামিনের ঘোষণা করায় একই রকম বিস্ময়ের প্রস্ফুরণ ঘটিয়াছিল। এই ক্ষেত্রগুলি ভারতীয় আবেগের কাছাকাছি বলিয়া উদাহরণ হিসাবে দেওয়া সহজ। তবে ব্রিটেন কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জামিন বস্তুটি যে নাগরিক অধিকারের অনতিক্রম্য অংশ হিসাবে স্বীকৃত, তাহা ভারতীয় সমাজকে আর এক বার মনে করাইয়া দেওয়া দরকার। নিয়মমাফিক গ্রেফতারির পরবর্তী ধাপটিই নিয়মমাফিক জামিন। সুসভ্য বিচারব্যবস্থার ইহা গোড়ার কথা।
মজার ব্যাপার, নামে ব্রিটিশ-প্রভাবিত হইলও ভারতীয় আইনবিধির প্রায়োগিক বিশেষত্বটি ভিন্ন: অভিযোগ আসা মাত্রই জেলে পুরিয়া ফেলা। শুনানি ও বিচার শুরু তাহার পর। অগণিত ক্ষেত্রে জামিন চলিতে থাকে বছরের পর বছর, শুনানির সময়ও বহু ক্ষেত্রে হইয়া ওঠে না। ভারতীয় বন্দিদের এক বিরাট অংশই মামলাধীন বন্দি। কাহারও ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হইবার জায়গায় আসেই নাই, কাহারও ক্ষেত্রে স্ববিরোধী তথ্যপ্রমাণের স্তূপ: অথচ অভিযুক্ত কিন্তু বন্দিই থাকিতেছেন। অসমতার পরিমাণও প্রভূত: একই অপরাধে অভিযোগ-দলিল তৈরি হয় নাই বলিয়া অন্যরা জেলের বাহিরে, কিন্তু দলিল তৈরি বলিয়া আর এক অভিযুক্ত জেলের ঘেরাটোপে! অসুস্থ বা অশক্ত হইলেও বন্দিত্বের ব্যত্যয় নাই। মূল কথাটি হইল, ‘অভিযুক্ত’ বলিয়াই তাঁহারা ‘অপরাধী’ বলিয়া পরিগণিত, ইহাই ভারতীয় দস্তুর।
দস্তুরটি অত্যন্ত আপত্তিকর। ব্রিটিশ আইনের মতো ভারতীয় আইনেরও স্পষ্ট করিয়া দেওয়া উচিত, যত ক্ষণ পর্যন্ত অপরাধ অপ্রমাণিত, তত ক্ষণ ‘অভিযুক্ত’ ‘অপরাধী’ নহে। ব্যবধানটি গুরুতর, এই ব্যবধানের সূত্রেই জামিনের অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অধিকার। জামিনের কারণে যদি ফাঁকতালে কিছু অপরাধীর শাস্তি না-ও হয়, তাহাতেও বিচারের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না। কিন্তু কোনও নিরপরাধ ব্যক্তি যদি ভুলক্রমেও শাস্তিপ্রদত্ত হন, তবে গণতান্ত্রিক বিচারের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। আর, কাহাকেই বা শাস্তি বলে? যদি কোনও অভিযুক্ত বহু বৎসর জেলে থাকেন, তাহা কি শাস্তি নয়? পরবর্তী কালে যদি তিনি বিচারে নিরপরাধ সাব্যস্ত হন? গণতান্ত্রিক দেশে ইহা চূড়াম্ত অনৈতিক নহে? ফলত, আদালতের কাছে আর্জি, জামিন দ্রুত করিবার বন্দোবস্ত হউক, প্রয়োজনে আইন সংশোধন করিয়া আদালত-নিরপেক্ষ ভাবে পুলিশকেই জামিন দিবার অধিকার দেওয়া হউক। সুপ্রিম কোর্ট গত মাসে একটি নির্দেশিকায় জানাইয়াছে, বিবেচনাধীন জামিনের বিশাল সংখ্যা আদালতগুলিকে দ্রুত ছাঁটিয়া ফেলিতে হইবে, এবং নূতন অভিযোগের ক্ষেত্রে জামিন দিতে সাত দিনের বেশি লওয়া যাইবে না। প্রশ্ন হইল, সাত দিনই বা কেন? ব্রিটিশ আদালতের দৃষ্টান্ত মানিয়া, একেবারে হাতেনাতে জামিন নয় কেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy