Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

মায়ার চেয়েও অনেক দামি

আমাদের চেনাজানা সংসারত্যাগীদের কেউ ঘর ছেড়েছেন ভক্তিরসে মজে, কেউ আধ্যাত্মিকতার টানে, কেউ আবার ‘আগন্তুক’-এর মনমোহনের মতো দেশ-দুনিয়াকে দেখতে, মানুষ চিনতে। কিন্তু ফুটফুটে তিন বছরের সন্তানের মায়া কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়া সহজ কথা নয়।

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৭ ০৬:০০
Share: Save:

সন্ন্যাস নিতে চেয়েছেন মধ্যপ্রদেশের সুমিত রাঠৌর আর তাঁর স্ত্রী অনামিকা। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে নয়, প্রিয়জনকে হারিয়ে নয়। পরিপূর্ণ সংসার ফেলে তাঁরা সন্ন্যাস নেবেন স্বেচ্ছায়। ধর্মের টানে।

এমনই তো হওয়ার কথা। যাঁরা সন্ন্যাস নিতে চান, তাঁদের ছেড়ে আসতে হয় নিজের চেনা গণ্ডি, প্রিয়জন। একে একে খুলে ফেলতে হয় সমস্ত বন্ধন। তবেই না তিনি সমস্ত পিছুটান ছেড়ে মুক্ত হতে পারেন! এমন সংসার ত্যাগের নিদর্শন তো এই দেশের ইতিহাসে অজানা নয়! তা হলে রাঠৌর দম্পতিকে নিয়ে কেন এত কৌতূহল, হইচই? হইচই, কারণ অগাধ সম্পত্তির মালিক সুমিত ও অনামিকা শুধুই নিজেদের বিত্ত, সংসার, আত্মীয়বন্ধুকে ছেড়ে আসতে চাইছেন না। ছিঁড়ে ফেলতে চলেছেন তাঁদের তিন বছরের কন্যার সঙ্গে সম্পর্কটিও।

আর ঠিক এইখানটায় এসেই ছ্যাঁকা লেগে যায়। আমাদের চেনাজানা সংসারত্যাগীদের কেউ ঘর ছেড়েছেন ভক্তিরসে মজে, কেউ আধ্যাত্মিকতার টানে, কেউ আবার ‘আগন্তুক’-এর মনমোহনের মতো দেশ-দুনিয়াকে দেখতে, মানুষ চিনতে। কিন্তু ফুটফুটে তিন বছরের সন্তানের মায়া কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়া সহজ কথা নয়। এই প্রস্তুতি সত্যিই বিরল। এবং একই সঙ্গে তা জন্ম দিয়ে যায় একটি অমোঘ প্রশ্নেরও— এক জন মা কী করে পারলেন নিজের সন্তানকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে?

এই প্রশ্ন ওঠে, কারণ আমরা ধরেই নিই, এক জন বাবার চেয়ে মায়ের সঙ্গে সন্তানের বন্ধনের গভীরতা কিছু বেশি। কথায় বলে, মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাকি নাড়ির বন্ধন! কিন্তু শুধুই কি তা-ই? সে বন্ধন তো সন্তান মাতৃজঠরে থাকার সময়টুকুর জন্যই বরাদ্দ। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরই তা কেটে ফেলা হয়। আসলে সন্তানের সঙ্গে মায়ের বন্ধনটা প্রধানত মনের। প্রথম তাকে হাতের বেড়ে ধরা, স্পর্শ করা, খাওয়ানোর মধ্যে দিয়ে সেই সম্পর্কের শুরু। তার পর কখন যেন মায়ের নিজস্ব সময়গুলোও নড়েচড়ে জায়গা করে দেয় সন্তানের প্রয়োজনকে এগিয়ে দিতে। তার হাসিতে মায়ের হেসে ওঠা, তার অসুখে ঝিমিয়ে থাকা, তার সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হওয়া— এ সবের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে মন। তাই তার অনুপাতও ব্যক্তিবিশেষে বাড়ে-কমে। মেয়ে অঙ্কে চার নম্বর কম পেয়েছে বলে কেউ শয্যা নেন। আবার কেউ জটিল রোগাক্রান্ত ছেলে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে যান।

বন্ধনটা মনের বলেই কিন্তু তাকে ছেঁড়াও সম্ভব। একমাত্র মানুষই তা পারে। মনের ওপর এতখানি নিয়ন্ত্রণ মানুষ ছাড়া অন্য কারও মধ্যে নেই। অন্য প্রাণীরা, যারা জন্মের পরই সন্তানকে পরম মমতায় আগলে রাখে, কিংবা হেলায় ছেড়ে চলে যায়, তারা এমনটা করে খানিকটা প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে। মানুষ কিন্তু এটাই করে যুক্তির প্রেরণায়। সেখানে আবেগ যেমন থাকে, তেমনই থাকে উচিত-অনুচিতের বোধও। কখনও বা প্রয়োজনের প্রশ্নও। যে জননী এইমাত্র তাঁর সন্তানটিকে রাস্তার ধারে ফেলে রেখে গেলেন, তাঁর কাজটিও তো এক রকমের বাঁধন ছেঁড়াই। ওই কাজ করার সময়টুকুতে হয়তো তাঁর চোখে জল উপচে উঠেছে, হয়তো বা পা দুটো থরথরিয়ে কেঁপেছে। কিন্তু সে আবেগে তিনি কিছুতেই ধরা দেননি। কারণ তিনি জানেন, নিজের সঙ্গে তখনও সন্তানকে জড়িয়ে রাখলে হয়তো বা কারও বাঁচা হবে না।

আর যে মায়েরা ‘স্বেচ্ছা’য় সন্তানকে ছেড়ে চলে যান বলে আমরা ভাবি? যাঁদের আসলে আমরা ‘সংসার-ভাঙানি’ বলি? ভেবে দেখলে, তাঁদের অনেকের ক্ষেত্রেই কিন্তু এই ছেড়ে যাওয়া নিজ ইচ্ছায় ঘটে না। হয়তো তিনি আরও ভাল ভাবে বাঁচতে চেয়েছেন, আরও একটু শান্তির, আরও একটু আনন্দের খোঁজ পেয়েছেন। হয়তো সেই মুহূর্তে সন্তানের চেয়ে এই খুশিটুকু কুড়িয়ে নেওয়া তাঁর কাছে অনেক বেশি মূল্যবান। তাঁর মনই তখন তাঁকে তাড়িয়ে বাঁধন ছিঁড়িয়েছে। সুতরাং, মা ও সন্তানের সম্পর্ককে কোনও একটিমাত্র বাক্যে ব্যাখ্যা করা চলে না। অনেক সূক্ষ্ম অনুভূতির তার জড়িয়ে থাকে এর সঙ্গে। ‘কী করে পারল’-র চেয়েও ‘কেন পারল’-র খোঁজটা তাই বেশি প্রাসঙ্গিক। জরুরিও।

এ কথা সত্যি, ছেড়ে যাওয়ার আপাত কোনও তাগিদ অনামিকা রাঠৌরের ছিল না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রয়োজনটা হয়তো তাঁর কাছে মায়ার চেয়ে অনেক বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হয়তো তিনি ভেবেছেন, তাঁর মন যে ভাবে এই ‘অন্য জীবন’কে বেছে নেওয়ার দিকে আকৃষ্ট হয়েছে, তাতে আগামী দিনে সন্তানের পার্থিব প্রয়োজনগুলোর দিকে নজর দেওয়া সম্ভব হবে না। এই টানাপড়েনে শিশুকন্যাটি কখনও ভাল থাকতে পারে না। সে হয়তো ঠিক মায়ের ওম-টা পাবে না, তাঁর আদরমাখা বকুনি শুনবে না, কিন্তু পরিবারের অন্যদের স্নেহচ্ছায়া তো পাবে। তরতরিয়ে বড়ও হয়ে উঠবে।

মাথার ওপর থেকে যে হাত ইতিমধ্যেই সরে গেছে, তাকে আঁকড়ে রেখে লাভ কী! তার চেয়ে অন্য হাতগুলোকে আপন করে নেওয়াই ভাল।

অন্য বিষয়গুলি:

Religion Illusion Parents Daughter
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE